Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের কথা

মার্চ ১৭, ২০১৫, ০৬:৫১ এএম


বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের কথা

 

১৭ মার্চ, আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। বাংলাদেশের স্থপতি তিনি, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতাদের কাতারে তিনি আপন গুণে স্থান করে নিয়েছেন। তার রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ-জটিল যাত্রা পথে দৃপ্তপায়ে, চলার মুহূর্তে তিনি কখনো অপকৌশলের আশ্রয় নেন নি। তিনি কখনো আন্ডার গ্রাউন্ডের রাজনীতি  করেন নি। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সমর্থক হলেও, মহামতি লেনিন, মাওসেতুঙ তার প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব হলেও তিনি গলাকাটা রাজনীতির উপাসক ছিলেন না। শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতি তিনি কখনো করেন নি। তার বিশ্বাসে, মননে সংসদীয় রাজনীতির ধারা প্রবাহিত ছিলো। জাতির পিতা তথা জাতির একমাত্র কর্ণধার হওয়ার কারণে,  বৈরি পরিবেশ সামাল দেয়ার জন্য তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বাকশাল গঠন করেছিলেন। তবুও তার দৃষ্টি, কার্যক্রম, পদক্ষেপ কোনোটাই সংসদীয়-লেবারেল চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি।

একথা অনেকে ভাবতে চায় না যে, ১৯৭২ সাল থেকেই তিনি চরমপন্থীদের সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তার ঘুম কেড়ে নেয়া হয়েছিলো, তাকে এক কবি, ‘হারামজাদা’ বলেছেন, এক ছাত্রনেতা তার ডাকসুর আজীবন সদস্য পদ বাতিল করেছেন, তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসার সদ্যগজানো উগ্রনেতারা গুলি করেছে। ২৪ ঘন্টা তার সমালোচনা করতো একশ্রেণীর পত্রিকা। তথাকথিত সর্বহারারা তার চোখের সামনে তার সংসদ সদস্যদের প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেছে। ধর্ম-অধর্ম, মার্কসবাদ, মাওবাদ, নাস্তিক, আস্তিক, দালাল-রাজাকার সব মত্যদর্শীরা একাজোট হয়ে তার ভাবমূর্তি টেনে ছিঁড়ে ফেলবার জন্য একজোট হয়েছিলো। বাঘা বাঘা তাত্ত্বিকরা তাকে বিদ্রুপ করেছে, বড় বড় লেখক-সাংবাদিকরা কলমে বিষমিশ্রিত কালি দিয়ে তাকে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেছে। ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু কমরেড মনিসিংহ এবং অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, ওই ঘোর দুঃসময়ে তারা বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন।

শুধুমাত্র গুজবের প্রবল হাওয়া সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বাতাবরণ তৈরি করেছিলো। যাদের তিনি উচ্চ পদে বসিয়েছিলেন তারা কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছেন, যারা উচ্চপদ পান নি তারা অস্ত্রেশাণ দিয়ে ক্রুদ্ধমূর্তিতে গোপনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুর হৃৎপন্ডি উপড়ে ফেলতে। বাংলাদেশের সমস্ত মসজিদ-মাদ্রাসা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়া দেয়া হয়েছিলো। বামপন্থী এবং ডানপন্থী উভয় পক্ষই তার মুন্ডুচ্ছেদ করার জন্য চন্ডাল ভাব ধারণ করেছিলো। বামপন্থীদের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একদলীয় সরকার কায়েম ছিলো, বিরোধী দল ছিলো না, ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিলো না, তবুও তারা বাকশালকে কাছা খুলে নিন্দা করেছে। অন্যদিকে ডানপন্থী-ধর্মোন্মাদের পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাজতন্ত্রের শাসকরা অর্ধশত বছর ধরে ক্ষমতা ভোগ করছিলো, তবুও বাকশালকে নিন্দার ছলে বঙ্গবন্ধুর ১৪ পুরুষ উদ্ধার করেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মওলানা ভাসানী একফোটাও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেননি। ভারত বিদ্বেষী, হিন্দু বিদ্বেষী এবং বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছেন। প্রতিমুহূর্তে তিনি বঙ্গবন্ধুর নিপাত কামনা করতেন। ধর্মোন্মাদ-সাম্প্রদায়িক দল গুলোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে জব্দ করার জন্য জোট গঠন করেছিলেন। আন্ডার গ্রাউন্ডে ‘মুসলিম বাংলা’ কায়েমের অপপ্রচার চলছিলো, ভাসানী তার সমর্থক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন, সে সব দল গুলোর  নেতারা ভাসানীর ছায়া তলে আশ্রয় নিয়েছিলো। প্রায় সমস্ত কিছুই তিনি সামাল দিয়ে উঠেছিলেন। তার ক্যারিশমা তখনো অন্ধকারে ঢাকা পড়েনি। স্থিতিশীল একটি সোনালী মুহূর্তে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের দিকে, শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে, তিনি তার রাজনীতির দ্বিতীয় অধ্যায় রবীন্দ্রনাথের মত কৃষি ভিত্তিক, গ্রাম উন্নয়ন ভিত্তিক, সমবায় ভিত্তিক, সমবন্টন ভিত্তিক আদর্শ সামনে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।


তার মাথায় কাজ করেছিলো মানুষকে মোটা ভাত, মোটা কাপড় দেবার চিন্তা। তিনি মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার ব্রত সাধনায় মশগুল ছিলেন। আমলাদের তিনি ধানের ক্ষেতে নামিয়ে দিয়েছিলেন। কৃষকদের সার, বীজ, তেল, পাওয়ার পাম্প, কীটনাশক ঔষধ দিয়ে তার মেরুদন্ড মজবুত করে দিয়েছিলেন। বিপন্ন কল-কারখানা তিনি সবেমাত্র শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসছিলেন। তার অর্থমন্ত্রী ড. এ,আর মল্লিক মুদ্রাস্ফিতি কমাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সবেমাত্র তিনি অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খল পরিবেশ গোছাতে শুরু করেছিলেন। সমস্যার পাহাড়ের ওপর বসে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর মত বান্দা বঙ্গবন্ধু ছিলেন না। চক্রান্তকারিরা তাকে আর সময় দিলো না। তিনি ওভার কাম করতে পারলেন না।

অনেকে বলেন তিনি দু’বার দেশ স্বাধীন করেছেন। একবার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, আরেকবার  ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। জেনেভা কনভেনশন অনুরায়ী ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে পাঁচ বছর থাকার কথা ছিলো। তিনি  এক বছরও থাকতে দেননি। তার কথায় ভারত তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর প্রতিদানে কী পেলেন? তাকে সহ তার পরিবারের ৩২ জন সদস্যকে হত্যা করা হলো। জেল খানায় তার চারজন কর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। আজকাল অকালকুষ্মান্ড এক নাবালক তাকে ‘পাকবন্ধু’ বলে অশ্রদ্ধা দেখাবার সাহস পায়।

ভেবে বিস্মিত হই, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে, ১৯৬৯ সালে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নেমে এসে বললেন, এদেশের নাম হবে বাংলাদেশ। এতবড় সাহস কার ছিলো? অথচ পাকিস্তান আমলে ‘পূর্বপাকিস্তান’ এর পরিবর্তে ‘পূর্ব বাংলা’ বললে তার শাস্তি হোত। ১৯৫৩ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি জনপ্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীদের দিয়ে পরিবেশন করিয়েছেন। তারপর গানটিকে জাতীয় সঙ্গীঁতের মর্যাদা দিয়েছেন। ব্যাপারটা সহজ ছিলো না। দ্বি-জাতিতত্ত্ব প্রভাবিত, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক উন্মাত্ত দেশে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেয়া দুঃসাহসী কাজ। এই কাজটি বঙ্গবন্ধু করেছিলেন।


বাংলার কাদা-জল থেকে উঠে আসা নেতা তিনি। তিনি ছিলেন দিঘল পুরুষ। তার মত সুদর্শন, অনিন্দ্য-দিব্য কান্তি সুপুরুষকে কেবলমাত্র স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তার গায়ের রং ছিলো বাংলাদেশের মাটির মত। তাঁর মাথার কাঁচা-পাকা চুল বাংলার কাল বৈশাখি ঝড়, বলেছেন কবি মহাদেব সাহা। তার শরীরের রক্ত বাংলাদেশের নদ-নদীর পানি, তার গায়ের মাংস বাংলা দেশের মাটি। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েছিলেন; বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্যও তিনি সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি বার বার বলতেন, ‘ভিক্ষা করে কোন জাতি বাঁচতে পারে না।’ ঘুষ দূর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার কন্ঠে কথা বলতেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গঁবন্ধু ঘরে-বাইরে প্রতিহিংসা পরায়ন প্রতিপক্ষ মোকাবেলা করেছেন। তখন তাজউদ্দিন যে কোন কারণেই হোক বঙ্গবন্ধুর ওপর বিরূপ হয়ে তার সঙ্গে প্রায় প্রতিপদে দ্বি-মত পোষণ করছিলেন; তাজউদ্দীন নিজেই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। মোস্তাক ভেতরে বসে বঙ্গঁবন্ধু হত্যার নীলনক্শা প্রণয়ন করছিলেন, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন জিয়া, কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহমোয়াজ্জম হোসেন প্রমুখরা। সমান তালে তিনি দেশীয় ও আন্তজার্তিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করছিলেন। ভূট্টো এবং কিসিঞ্জার তার পেছনে লেগেইছিলেন। গোলাম আজমরা মধ্যপ্রাচ্য চষে বেড়াচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে অপপ্রচার করতে ।


সেনা প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ ছিলেন উদাসীন আর সেই সুযোগ নিয়েছিলেন উপসেনা প্রধান জিয়াউর রহমান। গোপনে গোপনে বক্তৃতা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন। খালেদ মোশারফের ভূমিকা ছিলো অদূরদর্শী, রহস্যময়। ১৯৭১ সালে মুজিব নগর যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তা বাস্তবায়ন হয়েছে।

ইতিহাসে তিনি ট্রাজিডর মহা নায়ক। তার মত বিশ্বের আরো মহানায়কেরা খলনায়কের হাতে জীবন দিয়েছেন। মহাত্মাগান্ধী, জন এফ কেনেডি, আব্রাহাম লিংকন, পেট্রিস লুমুম্বা, এমনকি মহামতি লেনিনও।

ইতিহাস থেকে তাকে বিদায় দেবার অনেক চেষ্টা হয়েছে, একজন সামরিক শাসককে তার চেয়ে বড় বানানোর অনেক চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সম্ভব হয়নি আর হবেও না।