আগস্ট ২১, ২০১৬, ০৭:৩৩ এএম
ঢাকার একটি নামকরা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র রাহুল। আর মাত্র দুই বছরের মধ্যে তাকে এস.এস.সি. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। অভিভাবকদের অনেক আকাক্সক্ষা আর স্বপ্ন তাকে ঘিরে। গোল্ডেন জিপিএ, ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ, প্রতিবেশির সন্তানের চেয়ে ভালো রেজাল্ট- অভিভাবকদের এমন অনেক প্রত্যাশার চাপে সে জর্জরিত। স্কুলের পর একাধিক কোচিং ও প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে পড়তে সে ক্লান্ত। এই চাপ, এই ক্লান্তি তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে খোঁজ কেউ নেয় না।আমাদের দেশের অতি সাধারণ আর বাস্তব চিত্র এটা। রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বল শহরগেুলোতেও আজ একই চিত্র। কোমলমতি ছেলেমেয়েদের সংবেদনশীল মনের কোনো খোঁজ না নিয়ে তাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পরীক্ষায় ভালো করার অসম প্রতিযোগিতায়। শুধু শৈশব নয়, বলা যায় সমগ্র শিক্ষা জীবনেই তাদের এ চাপ সামলাতে হয়। সব সময় তাদের মনে কাজ করে পিছিয়ে পড়ার শংকা।শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের যে চাহিদা, তা পূরণ না করলে স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হতে বাধ্য। সুষ্ঠু বিকাশের জন্য এ সময় শুধু শিক্ষা নয়, প্রয়োজন আরও অনেক বেশি কিছুর। শারিরীক গঠনের জন্য খেলাধূলা, মননশীলতা বিকাশের জন্য সংস্কৃতি চর্চা, মনের অনুভূতি ভাগ করে নেয়ার জন্য বন্ধুত্ব, নেতৃত্ব বিকাশের জন্য একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার সুযোগ সবকিছুই এ বয়সের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু শুধু প্রতিযোগীতার মনোভাব শিশু, কিশোর ও তরুণদের স্বাভাবিক বিকাশের এই ন্যুনতম চাহিদাগুলোকে আড়ালে ফেলে দিয়েছে। আর এরই সুযোগ নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল, তাদের ঠেলে দিচ্ছে মাদক, সন্ত্রাস আর জঙ্গীবাদের দিকে, যা বর্তমানে শুধু পরিবারের নয়, মাথা ব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ১৮ নম্বর অনুেেচ্ছদে বলা হয়েছে, সন্তান লালন পালনের মূল দায়িত্ব মা-বাবার, রাষ্ট্র এ বিষয়ে তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে। তাই সন্তানের দিকে লক্ষ্য রাখার প্রধান দায়িত্ব পরিবারকেই নিতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে ভালো করাটা অবশ্যই জরুরী, কিন্তু তা করতে গিয়ে সন্তানদের মনে কতটুকু চাপ পড়ছে, সে চাপ নেয়ার মতো সক্ষমতা সন্তানের আছে কি না- এসব বিবেচনা করার প্রাথমিক দায়িত্ব মা- বাবারই। আমাদের দেশে পরিবার প্রথা দিনে দিনে পরিবর্তিত হচ্ছে। এক সময়ের যৌথ পরিবার প্রথা আজ শহরে তো দেখা যায়ই না, গ্রামাঞ্চলেও তা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যেতে শুরু করেছে। পারিবারিক বন্ধন হচ্ছে শিথিল। ফলে বর্তমান প্রজন্মের সন্তানরা বেড়ে উঠছে একাকিত্বে, নিস:ঙ্গতায়। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে যেসব পরিবারের মা-বাবা দু’জনেই চাকুরী করে তারা সন্তানদের ঠিকমতো খোঁজ রাখেন না বা চাইলেও রাখতে পারেন না। তাদের ছেলে মেয়েরা বড়ো হয় মূলত গৃহপরিচারিকা বা কাছের কোনো আত্মীয়ের সাহচর্যে। সন্তানদের সাথে এ দূরত্ব ঘোচানোর জন্য তারা সন্তানদের বিভিন্ন আবদার বিনা বাক্যে মেনে নেন। হয় তাদের হাতে টাকা পয়সা দেন, দামী মোবাইল কিনে দেন অথবা মাঝে মাঝে একসাথে বাইরে কোথাও ঘুরতে যান। কিন্তু এর ফলে সন্তানদের মনোজগৎ বা আচার আচরণে কি পরিবর্তন হচ্ছে বা হতে পারে তা তারা নজরে রাখেন না। অল্প বয়সে একজন কিশোরের হাতে টাকা আসলে সে খুব সহজেই বিপথগামী হতে পারে। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বেহিসাবী টাকা খরচ করার প্রবণতা গড়ে উঠতে পারে। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, মাদকের মতো ভয়াল কোনো নেশার সহজ শিকার হতে পারে, যা মা-বাবা হয়তো জানতেই পারবে না। যখন জানবে তখন ফিরে আসার পথও অনেক কঠিন হয়ে যাবে। কম্পিউটার বা মোবাইলে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা যেমন জ্ঞানের বিকাশের পথকে সুগম করেছে তেমনি এর অপব্যবহার বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অনেক গবেষণা, অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিশ্বের কোনো দেশই এখন পর্যন্ত অনলাইন ব্যবহারে কিশোর ও তরুণদের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করতে পারেনি। হয় তারা বিভিন্ন পর্নো ওয়েবসাইটের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে অথবা মুক্ত চিন্তার অপব্যবহারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে না পেরে বা একাকীত্ব কাটাতে বিপথগামী হচ্ছে। মা-বাবারা যদি এসময় সন্তানদের সঙ্গ দিতেন, বন্ধু হয়ে সবকিছু জানার চেষ্টা করতেন তাহলে হয়তো তাদের এ বিপথগামীতা ঠেকানো যেত।