Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

থার্টি ফাস্ট নাইটের উৎসব বর্জন করা উচিত

ডিসেম্বর ২৫, ২০১৪, ০৬:৩৬ এএম


থার্টি ফাস্ট নাইটের উৎসব বর্জন করা উচিত

  বর্তমান বিশ্বকে নতুন পরিভাষায় ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ এবং বিশ্ববাসীকে একই এলাকার বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । বিশ্ববাসী একই ছাদের নিচের বাসিন্দা হতে গিয়ে যে সকল শর্তে ঐক্যমত্য হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ন উৎসবগুলো সমস্ত বিশ্ববাসী একযোগে উদযাপন করবে । তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশসমূহের সকল উৎসব আমাদের সভ্যতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে মানানসই নয় । সুতরাং খেয়াল রাখতে হবে, যেন বিশ্বের এমন সব উৎসব পালন শুরু করা না হয় যাতে আমাদের নিজস্ব উৎসবের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং বিশ্বের অন্যান্য জাতির সেসব উৎসব আমাদের সমাজে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ না পায় । কাজেই বিশ্বায়নের যুগেও আমাদেরকে আমাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে লালন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে । আমাদের সংস্কৃতির সাথে অন্যান্য দেশের যে সকল উৎসব সাংঘর্ষিক সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং আনুষ্ঠানিক আন্দোলনের মাধ্যমে দেশবাসীকে এর কূফল সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে । কোন বিবেকবান জাতির জন্য শোভনীয় নয় যে, তারা অন্য দেশের সংস্কৃতিকে অন্ধভাবে অনুসরণ করবে । তাই নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদেরকে সেসব ক্ষতিকর উৎসবকে চিহ্নিত করে আশু বর্জন করতে হবে । এমন একটি বর্জনীয় উৎসব অথচ আমরা বিগত পনের বছর ধরে আমরা পালন করে আসছি “থার্টি ফার্স্ট নাইট” নামে । এ উৎসবটি পালন করলে যেমনি ভাবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিলীন হওয়ার উপক্রম  হয় তেমনি অনেক অসমাজিক কর্মকান্ডের বীজ সমাজে রোপিত হয় ।

থার্টি ফার্স্ট নাইটের ইতিহাস অনেক পুরাতন । ঈসা (আঃ) এর জন্মের প্রায় ৪৬ বছর আগে ব্যবিলনের  সম্রাট জুলিয়াস সিজার ইংরেজী নববর্ষ পালনের সূচনা করেন । তৎকালীন সময়ের মানুষের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ সভ্যতার গন্ডির বাহিরে বাস করার কারণে তাদের দৈনন্দিন জীবন পালনে উচ্ছৃঙ্খলতাই বেশি পরিলক্ষিত হত । সে উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে সময়ের আবর্তে হাজার বছর পরে আজ পৃথিবী নামক গ্রহবাসী অসভ্যতা-সভ্যতার আলোতে বাস করছে । সে জন্য মুসলিম প্রধানদেশগুলো ব্যতীত ইংরেজী নববর্ষ পালনের দিনটিকে যথেচ্ছা পালন করলেও মুসলমানরা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে থার্টি ফার্স্ট নাইটের নামে কোন মদ্যপ মানুষের অনুষ্ঠান পালন করতে পারে না । সাধারনত ঈসায়ী সালের শেষ মাস ডিসেম্বরের শেষ দিনের অর্ধরাত্র অতিবাহিত হওয়ার পর রাত ১২.০১ মিনিট থেকেই থার্টি ফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান আরম্ভ হয় । তবে গ্রিনিজমান সময় অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার শহর সিডিনিতে সবার প্রথম রাত ১২.০১ মিনিট বাজে । সিডনিতে যখন রাত ১২.০১ মিনিট বাজে তখন বাংলাদেশে সন্ধ্যা ৭.০১ মিনিট বাজার কারণে অনেকেই থার্টি ফার্স্ট নাইটের প্রথম প্রহর এ সময়ে উদযাপন করেন । বিভিন্ন দেশে থার্টি ফার্স্ট নাইটকে বিভিন্ন নামে নামকরন করা হয়েছে । তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল, ‘থার্টি ওয়ান ফার্স্ট নাইট’, ‘থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বর’ অথবা ‘মাদকের হাতে খড়ি’ দিবস হিসেবে অভিহিত করেছেন । নাম যাই হোক এ দিবসের উদ্দেশ্য ভাল নয় ।

সকল সংস্কৃতিই অপসংস্কৃতি নয় । তবে থার্টি ফার্স্ট নাইটের নামে যা করা হয় তার সম্পূর্নটাই অপসংস্কৃতিতে ভরপুর । কারো অনুকরণ বা অনুসরণ করা দোষের কিছু নয় । তবে খেয়াল রাখতে হবে যার অনুসরণ করা হচ্ছে সেটা কতটা কল্যানকর । পৃথিবীতে এমন অনেক ব্যক্তি বা বস্তু আছে যার অনুসরন বা অনুকরণ করলে উপকার হয় । আবার অনেক ব্যক্তি বা বস্তু আছে যার অনুকরন করলে হিতে-বীপরীত হয় । বাঙালী জাতির জন্য থার্টি ফার্স্ট নাইট এমন একটা উৎসব যেটা পালনের মাধ্যমে বাঙালীরা তাদের স্বতন্ত্র সত্তাকে বিকিয়ে দেয় । জ্ঞানীরা বলেছেন, কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তাদের এতিহ্য, সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দাও । আমরা বিদেশী সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং এতিহ্য পালন করতে গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি, সভ্যতার ও ঐতিহ্যকে হুমকির মুখে নিপতিত করেছি । একটি জাতিকে অকার্যকর করার জন্য যুব সমাজকে ধ্বংস করে দেয়াই যথেষ্ট । বর্তমানে যুব সমাজকে ধ্বংসের পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে অপসংস্কৃতি । থার্টি ফার্স্ট নাইটের নামে আমরা যে বস্তা পঁচা সংস্কৃতির অনুসরন করি তাতে আমাদের যুব সমাজ ধ্বংস হতে আর বেশী বাকী থাকার কথা নয় ।

থার্টি ফার্ট নাইট পালনের নামে গোটা দেশ অশ্লীলতার চাদরে ঢেকে যায় । মফস্বলের শহরের তুলনায় বড় শহরগুলোতে অশ্লীলতার মহড়া বেশি চলে । তবে যে গতিতে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে তাতে সারা দেশ দখল করতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয়না । বিভাগীয় শহরগুলোর অভিজাত ক্লাবগুলোসহ বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল এবং কিছু বাসায় রাতভর বসে অসামাজিক কর্মকান্ডের পসরা । কি থাকে না তাতে ? তরুন-তরুনীদের ধ্বংস করা জন্য যা চাই তার সবটার রসদ এ সকল অনুষ্ঠানে মওজুদ থাকে । এ রাত উদযাপন করতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের নিজস্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করে ।  গায়ে পানি ছিটানো থাইল্যান্ডের উৎসব, আঙুর খাওয়া স্পেনের উৎসব, এ রাতে না ঘুমানো কোরীয়দের উৎসব, ১২টি ঘন্টা বাজানো মেক্সিকোর উৎসব, শিক্ষকদের কাছে দীর্ঘায়ু কামানা করা ভিয়েতনামের উৎসব, পরিবারের সকল সদস্যরা একসাথে আহার করা আর্জেন্টিনার উৎসব এবং সাদা পোশাক পরিধান করা ব্রাজীলীয়দের উৎসব । অর্ধ-সভ্য দেশগুলোতে এরকম সভ্য আয়োজন হলেও বাংলাদেশের মত একটি সভ্যদেশে এ রাতে অসভ্যতার সীমা থাকে না । কোন ব্যাঙ যখন লাফ দেয় সেটা স্বাভাবিক মনে করে আমরা উপভোগ করতে থাকি কিন্তু যখন কোন মানুষ ব্যাঙের মত লাফালাফি করে তখন সেটাকে পাগলের কর্মকান্ড ছাড়া আর কিইবা বলা চলে ? আমাদের দেশে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করার নামে আয়োজন করা হয় গান-বাজনা, নাচ-গান, ডিস্কো বা ডিজে (উলঙ্গ নৃত্য), পটকাবাজি, আতশবাজি, বেপরোয়া মটসাইকেল চালনা,  আনন্দ শোভা যাত্রা, তরুন-তরুনীদের রাত ভর উল্লাস, মদ-বিয়ারসহ ননা মাদকদ্রব্য সেবনে প্রলুব্ধ করতে ওপেন এয়ার কনসার্ট, লাইভ ড্যান্স, বিদেশী সংগীতানুষ্ঠান এবং এমন সব অপসংস্কৃতির আয়োজন যা তরুন-তরুনীদেরকে বিভিন্ন অপকর্ম করতে প্রলুব্ধ করে ।

‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ অনুষ্ঠানের উৎসব উদযাপন করতে গিয়ে সাময়িক মোহে, মূহুর্তের ভালো-লাগায় হাজার পিতৃহীন সন্তান জন্মের উপলক্ষ তৈরি হয় । এ রাতে অবাধ মেলামেশার কারণে বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হয় । যে সকল ছাত্রীরা বা তরুনীরা এ রাতের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে বের হন তাদেরকে নানারকম শারীরীরক লাঞ্ছনা নিয়ে বাসায় ফিরতে হয় । প্রায় প্রতি বছর থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনকে কেন্দ্র করে ধর্ষনের মত মারত্মক ঘটনা ঘটে । তার মধ্যে দু’এটি প্রকাশ পেলেও অধিকাংশ বুকের মধ্যে সঞ্চিত হয়ে থাকে । বখে যাওয়া ছেলেরা তাদের মনস্কামনা পূরনের মানসে এ রাতটিকে টার্গেট করে । বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশ হয় থার্টি ফার্স্ট নাইটের অপকীর্তির কথা । ১৯৯৯ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর রাতে থার্টি ফার্স নাইট উদযাপন করতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বাঁধন নামের একটি মেয়ে ১০/১২ জন মদ্যপ যুবক কর্তৃক শালীনতা হানীর শিকার হয় । ২০১২ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর আবারও ঘটে অনূরুপ ঘটনা । ২০১৩ সালের পহেলা জানুয়ারী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জঘন্য ঘৃনিত একটি রিপোর্ট । তারা প্রকাশ করে, বন্দর রাজধানী চট্টগ্রামের একটি হোটেলের ৬ তলায় থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় অশ্লীল নৃত্যের । সে অনুষ্ঠানের অভ্যন্তরে নেশাজাতীয় দ্রব্য এবং কনডম বিক্রি করা হয় । বাংলাদেশের সভ্য মানুষেরা এ খবরটি পড়ে আশ্চার্য হয়ে গিয়েছিল । আমাদের দেশের পরিবেশ এতটা খারাপ হয়ে গেছে ? বিদেশী অপসংস্কৃতি এবং থার্টি ফার্স্ট নাইটের মত অনুষ্ঠানের কারনে আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত জন্ম হচ্ছে ধর্ষণের সেঞ্চুরিয়ান মানিকের মত অসভ্য, মা-বাবার হত্যাকারী অনেক ঐশীরা । ২০১৩ ও ’১৪ ঈসায়ী সালের প্রায় অধিকাংশ সময়ের আলোচিত ঘটনা ছিল ইভটিজিং । সরকার এবং প্রশাসন কোন অবস্থাতেই এর লাঘাম টানতে পারছিল না । প্রশাসন ইভটিজিং প্রতিরোধে যত কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করে ইভটিজিংয়ের মাত্রাও তত বাড়তে থাকে । সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন থার্টি ফার্স্ট নাইটসহ যতগুলো অপসংস্কৃতি, বিজাতীয় সংস্কৃতি আমাদের দেশে চালু আছে সেগুলো যদি বন্ধ করা যায় তবে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর দরকার হবে না । এটা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে ।

যে সকল ছাত্র-ছাত্রী এবং তরুণ-তরুণীরা আগামী বাংলাদেশের কর্ণধার হবে তারা যদি এমন বিপথগামী হয়ে পড়ে তবে দেশের ভবিষ্যত চির অন্ধকারে ছেয়ে যাবে । তাই নিজ ও দেশের  ভবিষ্যতের স্বার্থে অভিভাবকদেরকে সচেতন হতে হবে । সন্তান-বিপথে গেলে অভিভাবকের ক্ষতিটাই সবচেয়ে বেশি হবে । অনেক আধুনিক বাবা-মা বলেন, আমরা আমাদের সন্তানদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছি । এ সব অভিভাবকরা এ কথা বলে পাড় পেয়ে যেতে পারেন না । আপনাদের আবেগপ্রবন, অপ্রাপ্ত বয়সের সন্তানেরা আপনাদের দেয়া স্বাধীনতাকে অপব্যবহার করে যা ইচ্ছা তা করে বেড়ালে সমাজে আপনাদেরকেই অপদস্থ এবং খেসারত দিতে হবে । সুতরাং আসন্ন থার্টি ফার্স্ট নাইটের আগেই সাবধান হোন । দরকার হলে কঠোর হোন । আপনার কঠোরতায় যদি আপনার স্নেহধন্য সন্তানের মঙ্গল হয় তাতে আপনার চেয়ে বেশি উপকৃত কেউ হবে না ।  প্রয়োজনে পরিবারের সকলে মিলে বাসায় বসে সামাজিক পরিবেশে আনন্দ করুন । আর যে সকল ছাত্র-ছাত্রী এবং তরুন-তরুনীরা বাবা-মা বা অভিভাবকদের ছেড়ে দূরে আছেন তার সংযমী হোন । মনে রাখতে হবে, আমার ভবিষ্যত আমার উপকারার্থে । আমি যত সভ্য-ভদ্র হতে পারব সমাজে আমার স্থান তত উর্ধ্বে হবে । খেয়াল রাখতে হবে, দেশি সংস্কৃতিকে ভূলে বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহন করতে গিয়ে আমরা যেন ‘বাঁদুড়ে’ রুপান্তরিত না হই । বাঁদুড়ের স্বভাব হলো, সে একূলেও থাকতে পারে না আবার ওকূলেও যেতে পারে না । আমরা সভ্যতার উষালগ্নে দাঁড়িয়ে আছি । উন্নত জীবন আমাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে । আমাদের নিজেদের ঐতিহ্য, সভ্যতা এবং সংস্কৃতি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি । সুতরাং বিদেশী সংস্কৃতির পিছে না ছুটে আমাদের সংস্কৃতিকে শক্তভাবে ধারন এবং পালন করি । তাতে আমরা যেমন উপকৃত হব তেমনি আমাদের দেশটাও বিশ্বের দরবারে নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে পরিচিত হবে । আসন্ন থার্টি ফার্স্ট নাইটের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে আসুন সকলেই শপথ করি–থার্টি ফার্স্ট নাইটের মত এমন সকল বিজাতীয় অপসংস্কৃতির গড্ডালিকায় গাঁ ভাসিয়ে না দিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি চর্চায় মনোযোগী হই । বাংলাদেশেকে সোনার দেশ, সংস্কৃতির দেশ, সভ্যতার দেশ এবং স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করি ।