Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪,

২১ আগস্টের গ্রেনেট হামলা

আগস্ট ১৭, ২০১৫, ০৭:১৩ এএম


২১ আগস্টের গ্রেনেট হামলা

   ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে এক নারকীয় ঘটনা ঘটেছিলো। সারা বাংলাদেশে বোমা হামলার বিরুদ্ধে ওই দিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিলো প্রতিবাদ সমাবেশের। প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা। মঞ্চটি করা হয়েছিলো ট্রাকের ওপর। দলের প্রায় সকল কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন সমাবেশে। দলীয় নেতাদের বক্তৃতা শেষে শেখ হাসিনা প্রধান অতিথির বক্তৃতা শেষ করে জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্মুহু বোমা বিস্ফোরিত হতে থাকে। এক নাগাড়ে ১৩টি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হয়। নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে ঘিরে ধরেন। তারপর তাকে বুলেট প্রুফ গাড়িতে উঠিয়ে দেন। এরপর শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করে পর পর ছয়টি গুলি করা হয়। বুলেট প্রুফ গাড়ি না হলে শেখ হাসিনা গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যেতেন। নেতাকর্মীরা তাৎক্ষণিক ভাবে মানবঢাল রচনা না করলেও তিনি গুলি বিদ্ধ হতেন। তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার মাহবুব আলম ঘটনা স্থলে গুলি বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিয়ে শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা করে গেছেন।

এই বোমা হামলায় ২১ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন। অসখ্য নেতাকর্মী আহত ও পঙ্গু হয়েছেন। হৃদয় বিদারক ভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছেন আওয়ামী লীগের মহিলা নেত্রী আইভি রহমান। তার দু’পা বোমায় উড়ে গিয়েছিলো। মৃত্যু যন্ত্রণা কত নিদারুণ ভাবে আইভি রহমানকে গ্রাস করেছিলো তার চিহ্ন ফুটে উঠেছিলো তার অনিন্দ্য কান্তি মুখমন্ডলে। এমন একজন নিষ্পাপ নারী আমার জীবনে আমি কমই দেখেছি। পা উড়ে যাওয়ার পর আইভি রহমান সজল-করুণ-নেত্রে চারদিকে, কখনও আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন। বাংলার আকাশ কি ক্রন্দন করে উঠেছিলো তখন? আইভি রহমানের মাধ্যমে কি সন্ত্রাসীরা সমগ্র নারী জাতির হৃৎপিন্ডে বোমা নিক্ষেপ করেনি? ঘটনাস্থল রক্তে ভেসে গিয়েছিলো। মৃতদের হাত-পা, দেহাংশ, পায়ের জুতা-স্যান্ডেল অসহায় ভাবে এক সঙ্গে গড়া-গড়ি যাচ্ছিলো। দৌড়া-দৌড়ি, ছুটাছুটি লেগেছিলো মানুষের মধ্যে, তাদের চিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ হয়েছিলো কিন্তু অবাক ব্যাপার যে, ঘটনাস্থলে সরকারি পুলিশ, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। আহতদের হাসপাতালে নেবার ব্যাপারে পুলিশ উল্টো বাধাগ্রস্ত করেছে। আহতদের হাসপাতালে যারা কাধেঁ করে নিয়ে যাচ্ছিলো, পুলিশ তাদের ওপর লাঠি চার্জ করেছে, টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে।

পুলিশ পারতো আহতদের সেবা করতে, পুলিশ পারতো শেখ হাসিনাকে নিরাপত্তা বিধানে উদ্যোগ নিতে। এর কিছুই করেনি পুলিশ। নিশ্চয়ই হাওয়া ভবনের নির্দেশ এমনই ছিলো। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উল্টো দিকে এবং রমনা ভবনের পূর্ব দিকে অবস্থিত বহুতল দালান ‘সিটি ভবনের’ ছাদ থেকে পুলিশের সহায়তায় এই গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছিলো। ছাদ থেকে কয়েকজন লোক এই গ্রেনেড হামলা করে। এসময় তাদের পাশে ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশের সদস্যরা ছিল। গ্রেনেড নিক্ষেপ শেষ হলে পুলিশের সদস্যরা গ্রেনেড নিক্ষেপকারীদের সিটি ভবনের ছাদের প্রান্ত থেকে সরিয়ে দেয়। ২১ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের সমাবেশে স্মরণ কালের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন প্রায় ৩০০ জন। এদের অধিকাংশকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

এর মধ্যে অনেকের রক্তের প্রয়োজন ছিল। রক্তের জন্য হাসপাতাল প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছিল হাহাকার। আওয়াগী লিীগের নেতাকর্মীরা চিৎকার করে বলছিলেন, ‘ভাইসব, আহতদের জন্য রক্তের দরকার।’ তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দেশে বোমা হামলার সকল ঘটনা বিএনপি-জামায়াত -জোট সরকারের মদদেই হয়েছে। তিনি জোট সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। এটা পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিলো যে, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে, আওমী নেতৃত্বকে সংকটে ফেলে দেবার টার্গেট থেকে এই ভয়াবহ বোমা হামলা চালানো হয়েছিলো। এই নৃশংস ঘটনা অবশ্যই বিনা উদ্দেশ্যে ঘটানো হয়নি। এই ঘটনার সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। একই আগস্ট মাসে দুটি বর্বরোচিত ঘটনা ঘটলো।

শেখ হাসিনা যখন ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করছিলেন তখনই বিকট আওয়াজে বোমা বিস্ফোরিত হয়। নিশ্চয়ই এর তাৎপর্য আছে। জঙ্গীরা এই স্লোগান বরদাস্ত করতে পারে না, শেখ হাসিনাকে খতম করতে পারলে এই স্লোগান দেবার লোক থাকবে না মনে করে এই স্লোগান উচ্চারিত হওয়ার সময় গ্রেনেড মেরেছিলো জঙ্গীরা। এই বিভৎস হত্যাকান্ডের কোন বিচার করেনি চার দলীয় জোট সরকার। রাষ্ট্রীয় ভাবে সঠিক কোন তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়নি। উল্টো আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করেছিলো জামায়াত-বিএনপির লোকেরা। বলা হয়েছিলো যে, শেখ হাসিনা নিজেই নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে বোমা নিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ পরবর্তীকালে দেখা গেল এই হামলার সঙ্গে হাওয়া ভবন জড়িত। হাওয়া ভবনের দুই নায়ক- তারেক জিয়া ও তার পোষ্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর এবং জামায়াতের নেতৃবৃন্দ এই হামলার সঙ্গে জড়িত। দেশে যে অবৈধ ভাবে দশ ট্রাক অস্ত্র আনা হয়েছিলো তার সঙ্গেও এরা জড়িত ছিলো। ২০০৫ সালের ১৭ ই আগস্ট সারা দেশে একসঙ্গে যে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিলো, তার সঙ্গেও এই কুশিলবরা জড়িত ছিলো। পরবর্তীকালে এরা যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার জন্য বোমা হামলা চালিয়েছে, নির্বাচন বন্ধ করার জন্য পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মানুষ হত্যা করেছে, জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে সেই ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট থেকে।

বঙ্গবন্ধুর গোটা পরিবারকে বিনাশ করা এবং শেখ রাসেলের মত শিশুকে হত্যা করার ভিতর দিয়ে আওয়ামী নেতৃত্ব ধ্বংস করার চিত্র ফুটে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেল খানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা ওই একই উদ্দেশ্যে করা হয়েছিলো- আওয়ামী নেতৃত্বকে মেরুদন্ডহীন করা। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনের পর প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে ২৬ হাজার নৌকার ভোটার হত্যা করা হয়েছিলো। সংখ্যা লঘুরা নারীর ইজ্জত রক্ষা করতে পারেনি, ভিটা-বাড়িতে থাকতে পারেনি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দলে দলে বাস্তহারা হয়েছিলো। এরপর সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেব ও আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ আওয়াগী লীগের থিংক ট্যাঙ্কারদের হত্যা করার উদ্দেশ্য একটাই, সেটা হল আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন করা। তাই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী দলকে চিরতরে নির্মুল করার টার্গেট ছিল ২১ আগস্ট।


এ উদ্যোগের দর্শনগত দিক হচ্ছে এই দলটিকে ধ্বংস করতে না পারলে মনের অভিলাস মিটিয়ে ইতিহাস বিকৃত করা যায় না, ইতিহাসের খল নায়ককে নায়ক বানানো যায় না, দেশের মাটিতে মৌলবাদের চাষ করা যায় না, বাঙালি মনোরাজ্যে পাকিস্তানি দর্শনের বিষ ঢোকানো সম্ভব হয় না। বাংলা ভাই ও শায়খ রহমান, মুফতি হান্নানদের গড়ে তোলা হয়েছিলো আওয়ামী নেতৃত্ব খতম করার জন্য।

বাংলাদেশ যে একটি সেকুলার স্টেট-এই কাঠামো বিচুর্ণ করার সুদুর প্রসারী পরিকল্পনা থেকে ২১ আগস্টের ঘৃণিত, বিভৎস ঘটনা ঘটানো হয়েছিলো। শুধু নিন্দা করে এই অপশক্তিকে প্রতিহত করা যাবে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনমনীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ২১ আগস্টের নায়কদের বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করাতে হবে। উপযুক্ত শাস্তি ও দন্ড দিতে হবে। হত্যাকারীদের ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই। অতীতে আমাদের অনেক দুর্বলতা ছিলো, ত্রুটি ছিলো, শৈথিল্য ছিলো, চক্ষুলজ্জা ছিলো। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে অশুভ, অপশক্তি।

বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার অপব্যবহার হয়েছে, অপব্যাখ্যা হয়েছে, বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসানোর খেসারত দিতে হয়েছে। সেসব যন্ত্রনাদগ্ধ অভিজ্ঞতা সামনে রেখে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার নীল নকশা প্রণয়ন কারীদের ওপর আইনের শাসনের দন্ড প্রয়োগ করতে হবে।