Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

পাঞ্জাবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হত্যা

আগস্ট ২৬, ২০১৫, ০৯:০০ এএম


পাঞ্জাবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হত্যা

   পাকিস্তানের সাবেক প্রধান মন্ত্রী বেনজীর ভূট্টো জঙ্গীদের হাতে প্রাণ দেওয়ার পর পাকিস্তানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব পাঞ্জাবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল (অব) সুজা খানজাদা প্রাণ দিলেন জঙ্গীদের হাতে। তার সঙ্গে আরো ১৬ জন নিহত হয়েছেন। জঙ্গীদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয়ে এই নৃশংস ঘটনা ঘটে। এ সময় তিনি তার অফিসে নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন।

পুলিশ জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিলো যে, এতে পুরো ভবন ধ্বসে পড়ে এবং আশপাশের বাড়ি ঘরের জানালা ভেঙে যায়। ২০-২৫ জন ভবনটির ধ্বংস তূপের নিচে আটকা পড়েছে। বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই তূপের নিচে চাপা পড়েছেন। উদ্ধার কর্মীরা ধ্বংস তূপের নিচ থেকে আটজনের লাশ উদ্ধার করেছে। বিস্ফোরণের কারণ জানা যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন এটা আত্মঘাতী হামলা। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন লস্কর-ই জাংভি। তারা অভিযোগ করেছে, সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে জুলাই মাসে এলইজির প্রধান মালিক ইসাক নিহত হওয়ার পর থেকেই খানজাদাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে।

২০১৪ সালের অক্টোবরে সুজাকে পাঞ্জাবের স্বরাষ্ট্র দফতরের ভার দেয়া হয়। দায়িত্ব নিয়েই তিনি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গুলোর বিরুদ্ধে চালানো বেশ কিছু বড় অভিযানে সক্রিয় ভূমিকা নেন। এমন কি রাজনৈতিক মহলেও জঙ্গীদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বরাবর আলকায়দা এবং তেহরিক-ই- তালেবান জঙ্গীগোষ্ঠী হুমকি দিয়েছিলো। এদিন শালিখান গ্রামে নিজের বাড়িতে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেছিলেন মন্ত্রী। তখন ৫০-১০০ জন লোক ওই ভবনে উপস্থিত ছিলেন। সেই সময় সকলের নজর এ্যাড়িয়ে এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি মন্ত্রীর বাড়িতে ঢুকে পড়েন।

তার পরই ঘটনাস্থলেই ১০ জনের মৃত্যু হয়। বিস্ফোরণের তীব্রতায় মন্ত্রীর বাড়ি ভেঙে পড়ে। ধ্বংস তূপের নিচে চাপা পড়ে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুজা খান জাদাসহ ২০-২৫ জন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিণতি এর চেয়ে ভালো হতে পারে না। পাকিস্তানের স্রষ্টা স্বয়ং জিন্নাহ সাহেব ধর্মকর্ম মানতেন না, এটা বহুল আলোচিত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যারা করেছিলেন তাদের মধ্যে কে-ই- বা পরহেজগার ধার্মিক ছিলেন? ধর্মরাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো এই দৃষ্টি থেকে যে, মুসলমানরা ইংরেজদের কাছে সুবিচার পাচ্ছে না। ইংরেজরা হিন্দুদের সুনজরে দেখে বলে তারা অনেক এগিয়ে গেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলমানরা নিজেদের মত করে উন্নতি করতে পারবে।

১৯০৫ সালে যে বঙ্গ-ভঙ্গ হয়েছিলো তার সমর্থন দিয়েছিলো পূর্ব বাংলার মুসলমান নেতৃবৃন্দ। ন্বপ্ন ছিলো যে, পূর্ব বাংলার মুসলমানরা অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হবে। এমন ধারণাও অনেকে পোষণ করেন যে, পূর্ব বাংলার সব চাষী মুসলমান আর আর সব জমিদার হিন্দু।পশ্চিম বঙ্গ থেকে উড়ে এসে হিন্দু জমিদাররা শোষণ করে, লুটপাট করে নিয়ে যায়। এসব আপেক্ষিক সত্য ধরেও যদি নেই তাহলে দেখা যাবে এসব ইসলাম প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত বক্তব্য নয়। সবই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বক্তব্য। মুসলীম লীগের একজন হিন্দু মন্ত্রী ছিলেন, নাম যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল।

যেমন এখন বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতা হচ্ছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নিতাই রায় চৌধুরী। বিএনপি মুসলিম লীগেরই নব্য সংস্করণ। জিন্নাহ সাহেব দীঘদিন কংগ্রেস করেছেন। কবি ও কংগ্রেস নেত্রী সরোজিনী নাইডু তাকে হিন্দু-মুসলমান মিলনের দূত বলতেন। তার আশঙ্কা ছিলো যে গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেলের সঙ্গে তিনি নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় সুবিধা করতে পারবেন না। এজন্য তিরিশের দশকের দিকে মুসলীগ লীগের হাল ধরেন। বরং শেরে বাংলা ছিলেন ১৯০৬ সালে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার সময় অন্যতম ধাত্রী।

এখনো কোনো কোনো আধুনিক গবেষক হিন্দু জমিদারদের খুব কড়া ভাষায় সমালোচনা করে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলো বাঙালি মুসলমানরা ভোট দিয়ে, তারা ভোট দিয়োছিলো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের কথায়। ছাত্রনেতা শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন; এ কথা তার অসাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখা আছে। অথচ পাকিস্তান চলে গোলো উর্দু ভাষী জমিদারদের পকেটে, যাদের সঙ্গে বাংলার জনগণের কোন সম্পর্ক ছিলো না। পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব বাংলাকে তাদের শোষণের স্পট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বরাবর ইসলামের ধূয়া আর হিন্দু ভারত বিদ্বেষী অজুহাত খাড়া করে রেখেছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রকে তারা একটি ওয়েলফেয়ার স্টেটে রূপ না দিয়ে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ দিয়েছিলো। অথচ সাংবাদিক ম্যাস কারেন তার বইতে বলেছেন, পাক শোষকদের সঙ্গে রোজার দিনেও এক টেবিলে বসে মদ পান করেছেন। এই লাম্পট্যের দিকটি অধিকতর সজাগ জনগোষ্ঠী বাঙালিদের চোখে ধরা পড়েছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানি সরল জনগণের চোখে তা পড়েনি। ইংরেজ আমলে ধর্মকর্ম নিয়ে মশগুল থাকার ব্যাপারে ইংরেজ শাসকরা কোনো ব্যাঘাত ঘটায়নি বরং তারা নিজেরা সাগ্রহে সংস্কৃত কলেজ এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে।

তাদের দৃষ্টি ভঙ্গি ছিলো, ভারতীয় জনগণ ধর্ম নিয়ে থাকুক, আমরা টাইট মত উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করি। ইংরেজের সঙ্গে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যত সংঘর্ষ ঘটেছে ভারতীয়দের সঙ্গে তা ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। প্রথমে হিন্দুরা তাদের প্রিয় পাত্র ছিলো পরে মুসলমানরা প্রিয় পাত্র হয়। ১৯৪৬ সালে খাজা নাজিমুদ্দীন বলেছেন, ইংরেজরা আমাদের শত্রু নয়, আমাদের শত্রু হিন্দরা। দেশ ভাগ হতেই পারে, সোভিয়েট রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জার্মান-কোরিয়া ও ভাগ হয়েছে। ১৯৪৭ সালে যা হয়েছে তার নাম হিন্দু-মুসলমানের রেশারেশি, হিন্দু-মুসলমানের বিচ্ছেদ। এই গরল ভারতকে আক্রান্ত, করলেও তারা নিজ গুণে গণতন্ত্রের প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। আর পাকিস্তান ভারতকে শত্রু ভাবতে ভাবতে নিজ রাষ্ট্রকে বানিয়েছে তালেবানি রাষ্ট্র।

পৃথিবীতে যত হিন্দু আছে আর যত কম্যুনিষ্ট আছে তাদের নিধনের দায়িত্ব নিয়েছিলো পাকিস্তান। পাকিস্তানি শাসকরা যতটা সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেছে ততটা সভ্যতা, গণতন্ত্রও কালচারের চর্চা করেনি। এই সুযোগ নিয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পাকিস্তান কায়েম হয়েছে মোল্লা আর মিলিটারি তন্ত্র। এখনো তাই আছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করাতো দূরের কথা রাষ্ট্রকে ধর্মতন্ত্রের, মোল্লা তন্ত্রের আর সেনাতন্ত্রের আখড়ায় পরিণত করে। তাই পাকিস্তানের মাটিতে তালেবানের জন্ম হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে যে ক’টি মৌলবাদী রাষ্ট্র আছে, পাকিস্তান তার অন্যতম।

ইসলামী হিংস্রতার জন্ম হয়েছে পাকিস্তানে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমেরিকার নির্দেশে পাকিস্তান আফগানিস্থানের সমাজ তান্ত্রিক সরকার উৎখাতের প্রয়োজন গোড়াপন্থী, মোল্লাপন্থী, হিংস্র জঙ্গী তালেবানের জন্ম দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আফগানিস্থানে তালেবানরা কায়েম করেছিলো মৌলবাদী শাসনব্যবস্থা। সভ্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে তালেবানী শাসন ব্যবস্থার কোন সম্পর্ক ছিলো না। পাকিস্তানের রাজনীতি কখনো মুক্তচিন্তা নির্ভর, গণতন্ত্র নির্ভর, সিভিল সমাজ নির্ভর হতে পারেনি।

ভাবতে অবাক লাগে স্বয়ং জিন্নাহকে শ্লোপয়জনিং করে হত্যা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে প্রকাশ্যে দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। জুলফিকার আলী ভূট্টোকে বেজন্মা বলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। তার কন্যা সাবেক প্রধান মন্ত্রী বেনজীর ভূট্টোকে মোল্লারা আল্লাহর দুশমন আখ্যা দিয়ে হত্যা করে। পাকিস্তানি সমাজে হিংস্র, মোল্লাতন্ত্র, মৌলবাদী অপশক্তি এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, যে কোন শাসককে তাদের সঙ্গে আপোস করে রাষ্ট্র চালাতে হয়। মূলত পাকিস্তানে কোন কালচার্ড, মুক্তিচিন্তার চর্চা নেই, ইতিহাস চর্চা নিষিদ্ধ পাকিস্তানে।


পাকিস্তানে কোন প্রতিবাদী সিডিল সমাজ নেই। পাকিস্তানে প্রগতিশীল রাজনীতি কখনো মাথা তুলতে পারেনি। মোল্লা, মিলিটারি ও আমেরিকা পাকিস্তানকে বরাবর গ্রাস করে রেখেছে। কবি, সাংবাদিক, কলাম লেখক সোহরাব হাসান একটি চমৎকার বই লিখেছেন। নাম ‘পাকিস্তান নামা’। সেখানে তিনি বলেছেন, “পাকিস্তানে বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকট তার মূলেও ছিলো মোল্লাতন্ত্র, মুজাহিদ ও তালেবানের দুই দশকব্যাপী দৌরাত্ম্য। পাকিস্তানের সকল শাসকই মোল্লা তন্ত্রের সঙ্গে আপোস করে ক্ষমতায় ছিলেন এবং এখনও আছেন। পারভেজ মোশারফ বাইরে এমন ভাব দেখাচ্ছেন যে, তিনি ইসলামী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কঠিন জেহাদে অবতীর্ণ। আসলে ভেতরে তাদের ই আশ্রয়- প্রশ্রয় দিচ্ছেন। পাকিস্তানে কোন নির্বাচনেই মৌলবাদীরা দশকের ঘরে কোন আসন পায়নি।”

এ নিবন্ধটি লিখেছেন সোহরাব ২০০৪ সালে। এর প্রোযজ্যতা এখনো আছে। বাংলাদেশে মৌলবাদের অপপ্রভাব একেবারে কম নয়। বিএনপির মত বড় দলটি মৌলবাদী, জঙ্গী সংগঠন নির্ভর। এখন স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আছে বলে জঙ্গী মৌলবাদীরা বাংলাদেশকে গ্রাস করতে পারেনি। কিন্তু তাদের তৎপরতা খুব ধারালো। বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার হত্যা দুশ্চিন্তার বিষয় বাংলাদেশের জন্য।