Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

৭ মার্চের ভাষণই আজকের গৌরবময় বাংলাদেশ

আখতার-উজ-জামান

মার্চ ৭, ২০২১, ০৬:১০ এএম


৭ মার্চের ভাষণই আজকের গৌরবময় বাংলাদেশ

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দীর্ঘ নয় মাসের দেশবিরোধী সব ষড়যন্ত্রকে মুছে দিয়ে আজ ৫০ বছর ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সকল বাধা পেরিয়ে। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি বরবারই বাংলার ইতিহাসকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে আমার লেখনিতে ঐতিহাসিক যুক্তিগুলো একইরূপে ধারণ করে থাকি।

বর্বরোচিত হিংস্রতার পরও বাঙালি চেতনা ধ্বংস করতে পারেনি হিংসাত্মক পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি। দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস এই পাকহানাদার বাহিনী একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর। 

তাদের এ লোমহর্ষক বর্বরতা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। এতো লাঞ্ছনা আর বঞ্চনা সহ্য করে আজকের এই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার মানচিত্র দেখার স্বাদ পেয়েছে প্রায় ১৮ কোটি বাঙালি। নিপাত হয়েছে ক্ষমতালোভী আর মায়ের ভাষাবিরোধী নরপিশাচ পাকিস্তানি হায়েনাদের। 

সব ষড়যন্ত্রের জাল পুড়িয়ে দিয়েছে এদেশেরই তরুণসমাজ থেকে শুরু করে সব বয়সি বাঙালি ও চেতনার জনগণ। মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল কিছু বাংলাদেশবিরোধী কুচক্রী মহলসহ পাকিস্তানের সাঙ্গোপাঙ্গরা। কিন্তু দেশের আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আর্তনাদ... বাংলাদেশ যেন স্বাধীনতা আর মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারে। কেননা মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর সেরা জীবের সব ভাষা বুঝতে পারেন।

একটা জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল কামানের মুখে। সমস্ত জাতির ভাষা যে বজ্রকণ্ঠ ধারণ করেছিল সেদিন, বিনা অপরাধে জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। 

সারাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা, নিরীহ মানুষদের ব্যাপকভাবে ধরপাকড় চালিয়ে পাক শাসকরা চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এরই মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

সেই ঘোষণা পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে দেয়া হয় সর্বত্র। সত্যিকারের স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষাপট একদিনেই তৈরি হয়নি। আমার মতে, এটা তৈরি হয়েছে ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-র ৬ দফা থেকে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে। ’৭০-এর নির্বাচন না মেনে নেয়ার প্রেক্ষিত থেকে। 

এসব পটভূমিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই সবকিছুর অবিসংবাদিত নেতা তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রসেনানিরূপে প্রতীয়মান হয়। ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলো মিটার বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। এই ঘোষণাপত্রে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। 

এর এক জায়গায় বলা হয়— ‘হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ও বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে প্রত্যেক জনগণকে সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার করতে হবে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক।

১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ভয়ালরূপ ধারণ করে। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি পেশ করে। কিন্তু তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান এ দাবি অগ্রাহ্য করে আন্দোলনকারীদের ওপর দমনপীড়ন শুরু করে। 

এই আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় প্রাণ হারান ছাত্রনেতা আসাদ, কিশোর মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাসহ আরও অনেকে। এসব ঘটনায় সরকারের ওপর চাপ বৃদ্ধি পেলে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। অবশেষে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং ২৪ মার্চ তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলে বিক্ষোভের অবসান হয়।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এবং ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের ৫টি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। উভয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদের সর্বমোট ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন পায়। 

অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮৮ আসন পেয়ে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা লাভ করে। হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশনামূলক উদাত্ত আহ্বানে গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ, বৃহস্পতিবার। আজ থেকে ৪৯ বছর আগে একটি ভয়াল কালো রাতে। ২৫ মার্চের আগে ঢাকা থেকে সব বিদেশি সাংবাদিক বের করে দেয়া হয়। সে রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামের হত্যাযজ্ঞ। 

যদিও এই হত্যাযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দুু ছিলো ঢাকাসহ পুরোদেশ। স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিলো তাদের বিশেষ লক্ষ্য। ধর্মীয় সম্প্রদায় নির্বিশেষে পাকিস্তানি হায়েনার দল রোমহর্ষক বর্বরতা চালায়। একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলটি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। 

৬০০-৭০০ আবাসিক ছাত্রকে হত্যা করা হয়। নিরস্ত্র বাঙালি গণহত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট। মেজর জেনারেল ফরমানের নেতৃত্বে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন ধ্বংস ও পরাভূত করা এবং ২য় ও ১০ম ইপিআরকে নিরস্ত্র করা। যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করেছে।

জগন্নাথ হল এবং অন্যান্য ছাত্র হলগুলোতে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের চিত্রের ভিডিও ধারণ করেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজির (বর্তমান বুয়েট) অধ্যাপক নূর উল্লাহ। মধ্যরাতের আগেই, ঢাকা পুরোপুরি জ্বলছিল, বিশেষভাবে পূর্বদিকের হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলো। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতের ঘটনা আজো প্রত্যেক বাঙালিকে ভয়ার্ত ও আতঙ্কিত করে তোলে। বাঙালি রক্তে-আগুনে-কামানের গোলায় বিভীষিকাময় এ রাতের কথা কোনোদিন ভুলতে পারবে না। এটা অবশ্যই  কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিলো না, ছিলো পরিকল্পিত আক্রমণ— অপারেশন সার্চলাইট।

ইতিহাসের পাতায় এটি দীর্ঘ সময় না হলেও কোনো জাতির অগ্রগতির জন্য একেবারে কম সময়ও নয়। এই সময়ে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন যে আমরা কী করতে পেরেছি, কী পারিনি, মুক্তিযুদ্ধে এত আত্মদান ও ত্যাগের পেছনে আমাদের যে লক্ষ্য ও স্বপ্নগুলো ছিলো, সেসব কতটা পূরণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিলো গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতা; আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মর্মকথা ছিলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সব ধরনের অন্যায়-অবিচার, বৈষম্য থেকে মানুষের মুক্তি। এখন আমরা অনেক দূর এগোতে পেরেছি। 

একদিকে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে বর্তমান সরকার যেভাবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে, সত্যিই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলাদেশের জন্য।  সাড়ে সাত কোটি বাঙালি থেকে প্রায় ১৮ কোটি বাঙালির মনে এখন অনেক বড় প্রত্যাশা আর সত্যিকার বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়। জাতি আজ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বাংলাদেশে এখন সত্যিকারের গণতন্ত্র চর্চার প্রতিফলন ঘটবে। 

তাই পাকিস্তানি হায়েনারা এখনো মরিয়া এই ৫০ বছরের স্বাধীন আর সার্বভৌম বাংলাদেশকে কীভাবে ধ্বংস করা যায়। কিন্তু বাংলার জনগণ এখন আর সেই পূর্বের ষড়যন্ত্রের পুনর্জন্ম হোক এটা কোনোভাবেই হতে দেবে না। কারণ স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিচার চলছে এবং চলবে। এটাই বাঙালি জাতির প্রত্যাশা আর দৃঢ় প্রত্যয়।

বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করা জাতির জনকের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে আপামর জনতা যেভাবে ডাক দিয়েছে, এরই ধারাবাহিকতায় তারই সুযোগ্য মানসকন্যা, দেশরত্ন, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার, বিশ্বের দরবারে একটি রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করানো, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে। 

ঐতিহাসিক ভাষণকে লালন করে, মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামীদের মতোই স্বপ্ন ও সাহস নিয়ে এগিয়ে আসুক, এটিই আমার তথা বাঙালির জাতির প্রত্যাশা। 

লেখক : গবেষক, সাংবাদিক

আমারসংবাদ/এআই