Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

সিরাজগঞ্জের সিনেমা হলগুলো এখন ছাত্রাবাস-গোডাউন

শুভ কুমার ঘোষ, সিরাজগঞ্জ

শুভ কুমার ঘোষ, সিরাজগঞ্জ

মে ১৯, ২০২২, ০১:৩৬ পিএম


সিরাজগঞ্জের সিনেমা হলগুলো এখন ছাত্রাবাস-গোডাউন

দর্শক সিনেমা হল বিমুখ হওয়ায় একে একে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলার সবগুলি সিনেমা হল। মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ না হওয়ায় দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়ে একে একে সবগুলি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে একসময়ের বিনোদনের সবচেয়ে বড় এই মাধ্যম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সিরাজগঞ্জের প্রান্তিক জনগোষ্ঠি। একই সাথে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ, হল সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরা হারিয়েছেন সেই ব্যাবসার জৌলুস।

করোনা সংক্রমণ শুরু হলে সর্বশেষ বন্ধ হয়ে যায় সিরাজগঞ্জের দেড়শো বছরের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী মমতাজ সিনেমা হলটিও। ব্যাবসা না থাকায় বন্ধ করে দেওয়া ৩৪টি সিনেমা হলের অধিকাংশই এখন ছাত্রবাস, গোডাউন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন বা ভাড়া দিয়েছেন হল মালিকেরা। প্রান্তিক জনগণের বিনোদনের বৃহৎ এই মাধ্যমটি পুনরুজ্জীবিত করতে দর্শকপ্রিয় সিনেমা নির্মাণের বিকল্প নেই বলে দাবি দর্শক, সংস্কৃতি কর্মী, কলা-কৌশলী ও হল মালিকদের।

সরেজমিন সিনেমা হলগুলো ঘুরে দেখে, সিনেমা হল মালিক ও সংশ্লিষ্ঠদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একসময় শুধুমাত্র সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকাতেই ছিল নীলা, লক্ষ্মী, গোধুলি, মমতাজ ও মৌসুমি নামে পাঁচটি সিনেমা হল। এছাড়াও জেলার বেলকুচি উপজেলায় ১১টি, উল্লাপাড়ায় ৫টি, শাহজাদপুরে ৬টি, কাজিপুরে ৩টি, রায়গঞ্জে ২টিসহ বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৩৩ লাখ মানুষের বিনোদন চাহিদা পুরণে গড়ে উঠেছিল আরো অন্তত ২৯টি সিনেমা হল। কিন্তু বর্তমানে এসবই যেন নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের মতো। দর্শক না থাকায় লোকসানের শিকার হয়ে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে জেলা সদরের পাঁচটিসহ জেলার সকল সিনেমা হল।

এর মধ্যে শহরের ঐতিহ্যবাহী মমতাজ সিনেমা হলের একাংশ বর্তমানে করা হয়েছে ছাত্রাবাস, এবং বাকিটুকু গুদাম ভাড়া দেবার প্রস্তুতি চলছে। গোধুলি সিনেমা হল এখন প্রাইভেট ক্লিনিক, মৌসুমি সিনেমা হলকে নিয়ে এখনো পরিকল্লপনা করেননি কতৃপক্ষ। এছাড়াও জেলার প্রায় সকল সিনেমা হলগুলোকেই এখন কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে নয়তো করা হয়েছে নিজস্ব গোডাউন বা ভাড়া দেওয়া হয়েছে গুদাম ঘর হিসাবে।

জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী মমতাজ সিনেমা হলটিও সর্বশেষ করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার অযুহাতে বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। দর্শক নেই তাই আয় ও নেই, কিন্তু চলে সকল খরচ। তাই কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য দেনার পরিমান বৃদ্ধি পাওয়ার অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া সিনেমা হলগুলো এখন গুদামঘর, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সিনেমা হলগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় একদিকে যেমন বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ অপরদিকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে এর সাথে সংশ্লিষ্টরা।

একসময় নতুন সিনেমা মুক্তি পেলেই সিরাজগঞ্জের সিনেমা হলগুলোতে দর্শকদের ভিড় সামলাতে হল মালিকদের দ্বারস্থ হতে হতো পুলিশ প্রশাসনের। কিন্তু মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ না হওয়ায় দিন দিন দর্শকেরা সিনেমা হল বিমুখ হয়ে পড়েছে। বিনোদনের বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে ইউটিউব, মোবাইল বা টেলিভিশনে বিদেশী চ্যানেলগুলোকে। আর জনসাধারণের এই বিদেশী সংস্কৃতিমুখি হয়ে ওঠায় বিনাশ ঘটছে দেশীয় সংস্কৃতির। বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন রুখতে ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বিনোদন চাহিদা পুরণে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলো পুনরুজ্জীবিত করার বিকল্প নেই বলে অভিমত সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাদের। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুনভাবে সিনেমা হলগুলো সাজাতে স্বল্পসুদে ব্যাংক ঝণ, প্রনোদনা প্রদান, বিদ্যুৎ বিল কমানো ও সুষ্ঠুধারার মানসম্মত সিনেমা নির্মাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার দাবি সিনেমা হল মালিকদের।

শহরের প্রাচীনতম সিনেমা হল লক্ষ্মী সিনেমার ঠিক সামনেই ক্ষুদ্র ব্যবাবসায়ী মোকাদ্দেস আলী। প্রায় ৩৭ বছর হলো এই স্থানে পান-সিগারেট, চিপস-পানীয় ধরনের পন্য নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসলেও সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ভালো নেই। 

তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ৮-১০ বছর হলো সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে গেছে। এর পর থেকে বেচা-কেনা কমে গেছে প্রায় ৯০ভাগ। আগে প্রতিদিন যা বিক্রি করতাম এখন এক মাসেও সেটা বিক্রি করতে পারি না। যে জায়গাগুলিতে মানুষের পদচারনায় পূর্ণ থাকতো সেই জায়গা আজ ময়লার স্তুপে পরিণত হয়েছে। সিনেমা হল গুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সকল হলের পাশের সব দাকানিরই তার মতোই অবস্থা বলেও জানান তিনি।

সর্বশেষ বন্ধ হয়ে যাওয়া মমতাজ সিনেমা হলের ব্যাবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিনিয়ত লোকসানের কারনে কর্মচারিদের বেতন বকেয়া, বিদুৎ বিল বকেয়া হয়ে যাওয়ায় মালিক হল বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে আমরা যেমন কর্মহীন হয়ে পড়েছি, তেমনি জেলার হল বিনোদনের শেষ অবলম্বন টাও হারিয়ে গেছে। এখন মালিক বাধ্য হয়েই হলের একাংশে ছাত্রাবাস করেছেন ও বাকি অংশটুকু গুদাম ভাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন।

তিনি বলেন, সরকার স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি ভালোমানের সিনেমা নির্মান হলে আবারো হলটি চালু করা সম্ভব হবে। তা নাহলে এভাবে কোনো হল মালিকই সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে পারবেন না।

সিরাজগঞ্জ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি আসাদ উদ্দিন পবলু বলেন, দর্শকপ্রিয় গল্পের সিনেমা নির্মাণ ও লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হল মালিকদের প্রয়োজনীয় ঝণ সুবিধা প্রদানের বিকল্প নেই। আমরা আশা করি আবারো সিনেমা হলগুলোকে দর্শকমুখর করে তুলতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার।

সিরাজগঞ্জ জেলা কালচারাল অফিসার মাহমুদুল হাসান লালন বলেন, সিনেম হলগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জেলার বিনোদনের প্রধান দিকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। ভাল গল্প না থাকায় ভাল মানের সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে না। একমাত্র ভালো গল্পের সিনেমাই পারবে দর্শকদের হলমুখি করতে, হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে। এর জন্য সিনেমা সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

আমারসংবাদ/কেএস 

Link copied!