Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

ওরা তিন বোন পেলো মাথা গোঁজার ঠাঁই

নির্ঝর কান্তি বিশ্বাস ননী , বামনা (বরগুনা)

নির্ঝর কান্তি বিশ্বাস ননী , বামনা (বরগুনা)

মে ২৪, ২০২২, ০২:৩৯ এএম


ওরা তিন বোন পেলো মাথা গোঁজার ঠাঁই

রুবি, জেসমিন আর রোজিনা— ওরা তিন বোন। বাবা-মায়ের আর একমাত্র উপার্জনক্ষম ভাইকে হারিয়ে হয়ে যান স্বজনহারা। বোনদের লেখাপড়া আর ভরণ পোশন করতে বড় বোন রুবি আক্তার (৩০) হয়ে যান দিশাহারা। ছোট বোনদের এক নিকটাত্মীয়র বাসায় রেখে তিনি পাড়ি দেন চট্টগ্রামে। কাজ নেন একটি পোশাক কারখানায়। 

এই ফাঁকে তার কয়েকজন নিকটাত্মীয়রা দখল করে নেন তাদের পৈতৃক সব সম্পত্তি। সম্পত্তি উদ্ধারে বিভিন্ন জনের কাছে ধর্ণা দিলেও কোনো সুরাহা পায়নি রুবি ও তার বোনেরা। বছরের পর বছর নিজেদের জমি দখলে নিতে না পারায় তাদের থাকতে হয় অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে। এ ঘটনাটি বরগুনার বামনা উপজেলার রামনা ইউনিয়নের গোলাঘাটা গ্রামের।  

অসহায় ওই তিন বোন নিজেদের সম্পত্তি ফিরে পেতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বরগুনা জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে অবস্থান নেন মানববন্ধন কর্মসূচিতে। পরে বরগুনা পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর মল্লিকের আশ্বাসে ফিরে আসেন নিজ ভূমিতে। পুলিশের সহায়তায় ফিরে পান পৈতৃক ভিটা। পুলিশের অর্থায়নে সেই ভিটায় ওই তিন বোনের মাথা গোঁজার জন্য নির্মাণ করে দেয়া হয় একটি সেমিপাকা বাড়ি। জমি ফিরে পাওয়া ও নতুন বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হওয়ায় খুশি ওই তিন বোন। 

জানা গেছে, গোলাঘাটা গ্রামের দিনমজুর আ. রশিদ হাওলাদার ২০০৩ সালে বাধর্ক্যজনিত রোগে মারা যান। এর পরে একমাত্র উপর্জনক্ষম ভাই  আলআমিন ২০১৪ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। ভাই মারা যাওয়ার তিন বছরের মাথায় মারা যান মা। স্বজনদের হারিয়ে অসহায় হয়ে যান তিন বোন রুবি আক্তার (৩০), জেসমিন আক্তার (২১) ও রোজিনা আক্তার (১৮)। 

ছোট দুই বোনদের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ মেটাতে রুবি পাড়ি জমান চট্টগ্রামে। সেখানে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে বোনদের বাড়িতে এক নিকটাত্মীয়র বাসায় রেখে পড়াশোনা চালান। এর ফাঁকে তার কিছু স্বজন তাদের পৈতৃক সম্পত্তি দখল করে নেয়। রুবি বাড়িতে এলে নিজের জমিতে যেতে পারতেন না। খুন-জখম ও হত্যার ভয়ভীতি প্রদর্শন করত তারা। 

জমি উদ্ধারে স্থানীয় চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ওসিসহ বিভিন্ন স্থানে ধর্ণা দিলেও তাদের আর্তনাদ কারো কানে পৌঁছায়নি তখন। পরে উপায় না পেয়ে গত বছর ১৪ জানুয়ারি বামনা উপজেলা পরিষদ ভবনের সামনে জমি  ফিরে পেতে অনশনে বসেন তিন বোন। তাদের অনশনের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে পুলিশ তখন তাদের জমিজমার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। সেটিও ছিল একদম ধীর গতি। 

পরে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ওই তিন বোন অবস্থান নেন বরগুনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে। কাফনের কাপড় বেঁধে শুরু করেন অনশন। তাদের অনশনের খবর পেয়ে সেখানে আসেন বরগুনা জেলা পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর মল্লিক। তিনি জমি ফিরিয়ে দেয়ার আস্বাসে দিলে তারা অনশন ভাঙেন। ওইদিন পুলিশ সুপার তাদের সাথে নিয়ে আসেন গোলাঘাটা গ্রামের বাড়িতে। 

দখলদার ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে তাদের জমিতে তুলে দেন। এছাড়াও পুলিশ সুপার তাদের একটি ঘর করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের জমিতে একটি টিনশেড পাকা ঘর নির্মাণ করে দেয় পুলিশ। গতকাল সোমবার  বেলা ৩টার দিকে বরিশাল বিভাগীয় উপমহা পুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম আখতারুজ্জামান গোলাঘাটা গ্রামে এসে ওই তিন বোনের জন্য নির্মিত বাড়িটি হস্তান্তর করেন। 

এছাড়া পুলিশের পক্ষে ওই তিন অসহায় বোনের অর্থিক সমস্যা দূর করতে একটি দোকানঘরের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর মল্লিক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. তোফায়েল হোসেন সরকার, বামনা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. বশিরুল আলমসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। 

ঘর পাওয়ার পর বড় বোন রুবি আক্তার আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমরা নানান স্থানে ঘুরেও আমাদের জমিজমা ফিরে পাইনি। বরিশাল বিভাগীয় পুলিশ কমিশনার, পুলিশ সুপার এবং বামনা থানার অফিসার ইনচার্জের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমি আমার জমি ও একটি ঘর পেয়েছি। পুলিশরা এমন মানবিক আমি কখনো ভাবিনি। এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না।’ 

বরিশাল বিভাগীয় উপমহা পুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম আখতারুজ্জামান বলেন, আমরা যখন শুনেছি তিন বোনের অসাহায়ত্বের কথা তখন আমরা তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আমরা ভাই হিসাবে তাদের পাশে রয়েছি। পুলিশ সবসময় এই অসহায় বোনদের পাশে থাকবে। আমরা একটি ঘর তৈরি করে বোনদের দিয়েছি। আপনারা সবাই ওদের পাশে থাকবেন ওদের দেখে রাখবেন।’

Link copied!