Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

‘তার পক্ষ নিলে মোল্লারা কোপাবে’

আমার সংবাদ ডেস্ক

অক্টোবর ১১, ২০১৯, ১১:১৮ এএম


‘তার পক্ষ নিলে মোল্লারা কোপাবে’

বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার পর কয়েকটি ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছেন প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তার ভক্তরা বলছেন, তসলিমার স্ট্যাটাসগুলোতে এক দিক দিয়ে হত্যাকারীদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে।

তবে তসলিমা বলছেন, তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতা চেয়েছেন এবং খুনীদের বিচার চান। তবে তিনি মৃতুদণ্ড বিরোধী। উদাহরণ হিসেবে তসলিমা টেনে এনেছেন দুনিয়া কাঁপানো শাহবাগ আন্দোলনকে।

শুক্রবার (১১অক্টোবর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাসে তসলিমা লিখেছেন, হিপোক্রেসি আমি ছাড়া এত বেশি বোধহয় কেউ দেখেনি জীবনে। ৪০ বছর আগে যখন আমি নারীর সমানাধিকারের কথা বলতে শুরু করেছি, যখন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলছি, মৌলবাদিরা তো বটেই, তথাকথিত প্রগতিশীলরাও আমার নিন্দে করতো। আমি যখন মানবতার কথা, ক্ষমাশীলতা আর উদারতার কথা বলতাম, তারা হিংসে আর প্রতিশোধের কথা বলতো। আমি যখন বাকস্বাধীনতার কথা বলতাম, তারা বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলতো। যখন মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার কথা বলি, তারা এক দড়িতে ফাঁসি চাই স্লোগান মুখে নিয়ে রাস্তায় নামে।

শাহবাগ আন্দোলনের বিপ্লবীরা যখন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো, তখনও ওদের ধর্মনিরপেক্ষতার আন্দোলনকে সমর্থন করেও আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অনড় থেকেছি। হ্যাঁ তাদের ফাঁসিই আমি চাইনি যারা আমার চিরশত্রু, যে নারীবিদ্বেষী ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজরা আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল। আজ ফাঁসির পক্ষের লোকেরা আমাকে মানবতা শেখাতে আসে!

এদের চিলে কান নিয়ে গেছের ষড়যন্ত্র-মিছিলে জড়ো হয় হাজারো মূর্খের দল। তসলিমা পুরুষবিরোধী, তসলিমা পুরুষের সংগে শোয়, তসলিমা দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করে, তসলিমা ধর্ম মানে না, তসলিমাকে ঘৃণা করার জন্য যা যা প্রয়োজন সব করেছে নারীবিরোধী মৌলবাদী এবং মুখোশধারী প্রগতিশীলের দল। এদের ফতোয়া, লাখো মোল্লার লংমার্চ, একই সঙ্গে সুশীলদের নিন্দে এবং ঘৃণা, সরকারের বিরোধিতা আমাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে, আজও আমার নিজের দেশে আমার প্রবেশের অধিকার নেই। দেশে আমার বই প্রকাশ অনেককাল বন্ধ। দুনিয়ার সবার মত প্রকাশের অধিকার মানলেও আমার মত প্রকাশের অধিকার না মানার লোক বাংলায় গিজগিজ করছে।'

দুই বাংলার চরিত্র একই। বাংলা বাংলা করে প্রাণের টানে এক বাংলায় ঠাঁই নেই বলে আরেক বাংলায় গিয়েছি, সেখানেও দেখেছি একই হিপোক্রেসি। আমাকে ব্ল্যাক আউট করে দিয়েছে পশ্চিমবংগ। আমার লেখাই শুধু নয়, আমি মানুষটাও নিষিদ্ধ সেখানে। আমার দোষ কী? দোষের কথা , দোষের প্রমাণ কেউ কিন্তু দিতে পারে না। শুধু ভিত্তিহীন গুজবের বাক্য আওড়ায়। আমি একাই দাঁড়িয়ে আছি সকল বিরোধিতা, বিদ্বেষ, ঘৃণা আর নিন্দের সামনে!

আজ তারাই আমার যুগ যুগ ধরে বলে যাওয়া কথাগুলোই আওড়ে পণ্ডিত, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, নারীবাদী সাজে, যারা আমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে। আজও চাইছে। এত হিপোক্রেসি আমি ছাড়া আর কে দেখেছে এত এক জীবনে!

আবরার নামের এক ছাত্রকে এক দংগল সরকার পক্ষের ছাত্র পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, এর প্রতিবাদ করে গত ৮ অক্টোবর সকালে ফেসবুকে লিখেছি, প্রধানমন্ত্রী নিজের জন্য একটি নতুন নাম বেছেছেন, সেটি হলো 'দেশরত্ন'। তাকে 'দেশরত্ন' বলে না ডাকলে কারও গর্দান যায় কিনা জানিনা। গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। দেশরত্ন, এর মানে তিনি দেশের রত্ন। রত্নগর্ভাও তিনি। এত এত রত্নকে গর্ভে ধারণ করেছেন, এত এত রত্নকে জন্ম দিয়েছেন, যে রত্নগুলো নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে মাঠে ঘাটে, ঘরে বাইরে, ঝাড়ে জংগলে বেঁহুশের মতো কুপিয়ে মারছে, পিটিয়ে মারছে! দেশরত্ন এখন ভালোয় ভালোয় তাঁর প্রসব করা রত্নগুলোকে আবার গর্ভে ঢুকিয়ে নিন -- তা না হলে সমূহ বিপদ।

এই লেখাটি পড়ার পরও আমাকে যারা আবরার হত্যা সমর্থন করছি বলে, বা হাসিনাকে তেল দিচ্ছি বলে গুজব ছড়ায় তারা কত বড় হিপোক্রেট ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ তসলিমার নিন্দে করা। মানুষ লুফে নেয় সমস্ত অভিযোগ, কেউ প্রমাণ দেখতে চায় না। কেউ তলিয়ে ভাবতে চায় না। কেউ প্রশ্ন করে না। তসলিমা নামটা শুনলে অনেকের একটা ভীতি কাজ করে, তার পক্ষ নিলে মোল্লারা কোপাবে, সরকারের কুনজরে পড়বে, সুতরাং শুভাকাংখীরাও মুখ বুজে থাকে।

এই হিপোক্রেটদের দেখেছি অভিজিৎ , অনন্ত, ওয়াশিকুর, জুলহাস, নিলয়, তনয় হত্যায় চুপ হয়ে থাকতে। আর আবরার হত্যাকাণ্ডে একেকজন মানবতাবাদী হয়ে উঠেছে। বিচার চাইছে। আবরার শিবিরের লোক যদি হয়েও থাকে, তাকে মারার অধিকার কারও নেই এ কথা আমি বলার পরও আমার বিরুদ্ধে কুৎসার বোমা ফাটিয়ে দিয়েছে জামাত-শিবির, সংগে বীর প্রগতিশীল! আর কতবার বলবো, তুমি যদি সব মানুষের, এমনকী তোমার শত্রুদের বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করো, তুমি মানুষটা বাক স্বাধীনতা জিনিসটাতেই বিশ্বাস করো না।

জীবনভর প্রচণ্ড প্রচণ্ড বাধা আর প্রতিবন্ধকতার সামনে একা দাঁড়িয়েছি। এখনও একাই দাঁড়িয়ে আছি। আহা দেশ, যাদের বাপ দাদারা আমার বিরুদ্ধে তলোয়ার উঁচু করে ছিল, তারাও এখন তলোয়ার উঁচু করছে। দিন যাচ্ছে, বছর পেরোচ্ছে, কূপমণ্ডুকতার শেষ হচ্ছে না। আমাকে এসব দেখেই যেতে হবে যতদিন বাঁচি। যতদিন আমার কলম আছে, সত্যের পক্ষে লিখেই যাবো। ভয় পাইনি কখনও, পাবও না। হিপোক্রেটরা দুধে ভাতে থাকে জানি। আমার ভাত না জুটুক, পায়ের তলায় মাটি না থাকুক, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অসুন্দরের সংগে, অসত্যের সংগে, অযুক্তির সংগে, অলৌকিকের সংগে আপোস করিনি, করবো না।

এম‌এআই