Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

চামড়ার বাজারে অস্থিরতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগস্ট ৪, ২০২০, ০৫:১৫ পিএম


চামড়ার বাজারে অস্থিরতা

গেলো বছরের মতো এবারো কুরবানির পশুর চামড়ার বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মোটেও দাম মেলেনি পশুর চামড়ার। সরকারের পক্ষ থেকে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও সে দামকেও কেউ পাত্তা দেয়নি।

অনেক জায়গায়ই দুই থেকে তিনশ টাকায় বিক্রি হয়েছে গরুর চামড়া, খাশির চামড়া ২০ থেকে ২৫ টাকা, আবার কোথাও কোথাও দিয়েছে বিনামূল্যে। কোনো কোনো স্থানে এর চেয়ে কমেও চামড়া বিক্রি হয়েছে বলে তথ্য এসেছে।

গত বছরের মতো রাস্তায় চামড়া ফেলে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে এ বছরও। অনেক কুরবানিদাতা বলছেন, এরকম চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তারা মাটিতে চামড়া পুঁতে ফেলতে বাধ্য হবেন।

এদিকে, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যূনতম কমপ্লায়েন্স না মানার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারাও বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করছে না।

এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কুরবানিদাতাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের বিকল্প পদ্ধতি চালু করার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে চামড়া সংগ্রহের জন্য এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। গরুর হাটের মতো চামড়া সংগ্রহকারীর কাছেও একেকটি এলাকার ইজারা দেয়া যেতে পারে।

আর চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ যেকোনোভাবে নিশ্চিত করতে হবে। সব মিলিয়ে দেশের চামড়া খাতে সরকারকে আরও কঠোর হতে বলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

গেল বছর কুরবানি ঈদে চামড়ার বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। বলা হয়েছিল, চামড়ার দাম সর্বনিম্ন রেকর্ড ছুঁয়েছে। তবে সে রেকর্ড স্থায়িত্ব পায় ওই একবছরই। কারণ এ বছর সরকার চামড়ার দাম আরও কমিয়ে দেয়।

তাতেও চামড়ার বাজারের অস্থিরতা কমানো যায়নি। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকার মধ্যেই গরুর চামড়া হাতবদল হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা এক থেকে দুইশ টাকাতেও নেমেছে। আর খাশির চামড়ার দাম নেমে এসেছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়!

বারবার চামড়ার দামে এমন ধস কেন : বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘চামড়া তো কাঁচামাল, জরুরি এই কাঁচামালটি নিয়ে সমস্যার পেছনে রয়েছে এর চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা।

এ বছর আমাদের নিজেদের দেশ থেকেই চামড়া রপ্তানিতে ২৮ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। এছাড়া চামড়ার ৫০ শতাংশ রপ্তানি হয় চীনে। চীনের বাজারেও এখন চাহিদা নেই।

শুধু চীন কেন, বিশ্ব বাজারেই এখন চামড়ার চাহিদা নেই। আগামী বছর যে চামড়ার চাহিদা বাড়বে, সে রকমও মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, চামড়াজাত পণ্যের বাজারে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ রাখা হলেও বিষয়টি জানানো হয়েছে ঈদের মাত্র দু-তিন দিন আগে।

আবার যে ভারতে রপ্তানি হবে, সেখানেও এ নিয়ে প্রচারণা চালানো হয়নি। ফলে প্রচারণার অভাবেও ঈদের সময় চামড়া রপ্তানির সুযোগটি কাজে লাগানো কঠিন।

 তবে এই সুযোগ অনির্দিষ্টকালের জন্য, তাই ভারতে বাংলাদেশি হাইকমিশনের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে প্রচারণা চালানো উচিত। দেশে যারা কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে থাকে, তাদের কাছেও বিষয়টি ভালোভাবে পৌঁছানো উচিত।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দেশে আসলে গরু বা খাশির চামড়া সংগ্রহের উপায় কী? সরকার দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে, সেটা তো কাজে দিচ্ছে না। আমি-আপনি তো চামড়া বিক্রি করার জন্য কুরবানি দিচ্ছি না। মাদ্রাসার পক্ষ থেকে এতিমরা চামড়া সংগ্রহ করে।

তারা কিন্তু এখন লাভবান হচ্ছে না। সরকার দাম ঘোষণা করেও লাভ হচ্ছে না। এলাকা বা উপজেলাভিত্তিক দুদিনের ব্যবসায়ীর জন্ম হয়, তাদের জন্য অনেক সময় ট্যানারির মালিকরাও লাভবান হয় না। বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে যে পশু কুরবানি দেয়া হয়, সেখান থেকেই চামড়া বিক্রি করা হতে পারে।

তিনি বলেন, কম দামে চামড়া বিক্রি হলে চামড়ার কোয়ালিটি নষ্ট হবে। কারণ যারা গরু বা ছাগল কুরবানিতে যুক্ত থাকে, তারাই অনেক ক্ষেত্রে চামড়া সংগ্রহে যুক্ত। ভালোভাবে চামড়া সংগ্রহ করতে পারলে তাদেরও লাভ হয়।

গত দুই বছর ধরে যেভাবে চামড়ার দাম কমছে, এতে অনেকেই চামড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে আগের মতো সচেতন থাকবে না। এতে চামড়ার গুণগত মান সংগ্রহ পর্যায়েই নষ্ট হয়ে ?যাবে।

এছাড়া চামড়ার দাম কম থাকলে একসময় মাদ্রাসাগুলোও হয়তো চামড়া নিতে আগ্রহী হবে না।

এছাড়া দুদিনের ব্যবসায়ী জন্ম নেয়ার কারণে ট্যানারির মালিকরাও লাভবান হচ্ছে না। যেখানে ট্যানারির মালিক নেই বা তাদের প্রতিনিধি নেই, সেখানে অন্য একটি শ্রেণি চামড়ার মূল লাভ নিয়ে যাচ্ছে। তাই চামড়া সংগ্রহের প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য করণীয় উল্লেখ করে ড. নাজনীন বলেন, কুরবানির জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নির্ধারণ করে দিতে হবে, যেখান থেকে কুরবানির পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে কুরবানির চামড়াগুলো বিক্রি করা যেতে পারে।

অথবা যেভাবে কুরবানির হাট লিজ দেয়া হয়, সেভাবে নির্দিষ্ট এলাকার জন্য একজন নির্দিষ্ট চামড়া সংগ্রহকারীও নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে কুরবানিদাতাদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহেও নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে দেয়া উচিত।

সেই দাম না মানলে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, দাম না পেলে ভবিষ্যতে যদি কুরবানিদাতারা চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতে উদ্বুদ্ধ হন, তাহলে একটি বিপুল পরিমাণের কাঁচামাল আমরা হারাবো, যা দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ঘোষণা দিয়ে চামড়ার দাম কমিয়েও যেহেতু কোনো লাভ হচ্ছে না, তাই পশুর চামড়া নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।

আমারসংবাদ/এসটিএম