Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

দিয়াজের আত্মহত্যা: টেন্ডার নাকি প্রিয়াংকা?

মিজানুর রহমান, চবি 

নভেম্বর ২৫, ২০২০, ০৩:১০ পিএম


দিয়াজের আত্মহত্যা: টেন্ডার নাকি প্রিয়াংকা?

চট্টগ্রামের আলোচিত দিয়াজ হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি চার বছরেও। এমনকি এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা- সে বিষয়টিরও হয়নি সুস্পষ্ট সুরাহা। কারণ প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা উঠে এলেও দিয়াজের মৃত্যুর ২১ দিন পর প্রায় গলিত লাশের দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দিয়াজের শরীরে হত্যার আলামত রয়েছে।

দিয়াজের মৃত্যুকে হত্যাজনিত ধরে নিয়েই তদন্ত করছে সিআইডি। কিন্তু ফরেনসিক প্রতিবেদন দুইটিতে দুইরকম তথ্য আসায় বিপাকে পড়েছে সংস্থাটি৷ 

আবার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার বাদি ও বিবাদীরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় সিআইডির তদন্ত গতিতেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এছাড়া এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদলেছে তিন বার।

এর আগে ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দুই নম্বর এলাকায় নিজ বাসা থেকে দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। দিয়াজ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিয়াজের মৃত্যু নিয়ে এখন চলছে রাজনীতি। শুধুমাত্র মৃত্যুর তারিখ এলেই কয়েকদিন দিয়াজের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা নিয়ে চলে আলোচনা। দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত প্রশাসনের আমলে সন্তানের মৃত্যুর বিচার নিয়ে ছিলেন সোচ্চার। প্রশাসনিক ভবন, শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি সন্তানের 'হত্যা'র বিচার চেয়ে করেছেন অনশনও। কিন্তু বর্তমান প্রশাসনের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে তাকে প্রকাশ্যে এসে বিচার চাইতে দেখা যায়নি। অবশ্য দিয়াজের পরিবারের দাবি আগের প্রশাসন আসামিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল।

এদিকে দিয়াজের মৃত্যুর নেপথ্যে তার প্রেমিকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেত্রী সায়মা জেরিন প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে তার টানাপোড়েনকেও সন্দেহের চোখে দেখছে অনেকে। দিয়াজের মৃত্যুর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রিয়াঙ্কাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতেও দেখা যায়নি। 

এছাড়া দিয়াজের সঙ্গে তার নিজের প্রতিষ্ঠিত 'বাংলার মুখ' গ্রুপের সিনিয়র দুই সদস্যের টানাপোড়েন ছিল বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ৭৫ কোটি টাকার কাজের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ওই দুই সদস্যের সম্পর্কে ফাটল ধরে। এসব নিয়ে দিয়াজ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল বলেও জানা গেছে। তাই ৭৫ কোটি টাকার টেন্ডারের ভাগ না দিতে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী তাকে হত্যা করে থাকতে পারে বলেও গুঞ্জন রয়েছে ক্যাম্পাসে। 

দিয়াজের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দিয়াজ হত্যা মামলার বেশিরভাগ আমি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাদের গ্রেপ্তার করছে না সিআইডি। এজাহারে ১০ আসামির মধ্যে জামিনে আছেন মাত্র দু'জন। মামলার প্রধান আসামি চবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ বর্তমানে খুলশী এলাকার বাসায় থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী মদনহাটের রেলগেইট এলাকায় নিজ বাড়িতেও তাকে এলাকার সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে দেখা যায়। অন্যতম আসামি ততকালীন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আলমগীর টিপুও প্রকাশ্যে অক্সিজেন এলাকায়সহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে অভিযোগ দিয়াজের অনুসারীদের। 

এছাড়া মামলার অন্যতম আসামি মনসুর আলম নিজ এলাকা চকরিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনের প্রার্থী হতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন। অভিযুক্ত জিসান, আব্দুল মালেক, আবু তোরাব পরশকেও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আপ্যায়ন সম্পাদক মিজানুর রহমান মহেশখালীর মাতারবাড়ি এলাকায় অবস্থান করছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দিয়াজ হত্যা মামলার এক আসামি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, তৎকালীন সভাপতি, সিনিয়র সহ সভাপতি, সহ সভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক সবাই মিলে দিয়াজ ভাইয়ের মায়ের কাছ থেকে ২ লাখ চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ কতটা গ্রহণযোগ্য তা বুঝাই যাচ্ছে। ওনার মায়ের মামলার এজাহারে তাই উল্লেখ আছে। সে হিসেবে ১১ আসামির একজনের ভাগে ২০ হাজার টাকাও পড়বে না। ওনার মা এই টাকা আমাদের না দেওয়ায় আমরা নাকি সবাই মিলে দিয়াজ ভাইকে মেরে ফেলেছি। এই মামলা যে আসলেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা এর মাধ্যমেই প্রমাণিত।

এ বিষয়ে দিয়াজের বোন এডভোকেট জুবাঈদা ছরওয়ার চৌধুরী নিপা বলেন, সিআইডি তদন্তভার নেওয়ার পর এ পর্যন্ত মামলার তিনজন আইও বদল হয়েছেন। প্রথম আইও এটাকে একটি হত্যাকাণ্ড হিসেবে সাব্যস্ত করেন। হত্যাকাণ্ডে এজাহারনামীয় আসামিদের সম্পৃক্ততা প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া যায় এবং এ বিষয়ে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন বলে আদালতে একটা রিপোর্ট দাখিল করেন। এ রিপোর্ট দাখিল করার সাথে সাথে উনাকে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। তাছাড়া উনাকে হত্যার বিভিন্ন আলামত ও আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু পরের তদন্ত কর্মকর্তারা এসে আগের আলামত এবং রিপোর্ট কিছুই গ্রহণ করছেন না। সবচেয়ে বড় বিষয় এজাহারের ১০ জন আসামির মধ্যে ২জন আসামি ছাড়া প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও কেউ গ্রেপ্তার হচ্ছে না। তাদেরসহ সন্দেহভাজন লোকদের গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হত। যেখানে আসামিদের গ্রেপ্তারই করছেন না সেখানে সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে আমরা শঙ্কিত।

মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস সালাম মিয়া বলেন, এটি একটি স্পর্শকাতর হত্যা হামলা। এই মামলা অধিকতর তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষে আমরা শীঘ্রই বিজ্ঞ আদালতে চার্জশিট দাখিল করব। আসামিদের দু'জন গ্রেপ্তারের পর জামিনে আছেন। বাকিদের আটক করতে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি।

আমারসংবাদ/কেএস