Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

‘৭৩ হাজার মানুষের মৃত্যুর মিছিলে আমার স্বামী ছিলেন তৃতীয়’

আমার সংবাদ ডেস্ক

জানুয়ারি ১, ২০২১, ০৯:৫০ এএম


‘৭৩ হাজার মানুষের মৃত্যুর মিছিলে আমার স্বামী ছিলেন তৃতীয়’

২০২০ সালের শেষ দিনটি পর্যন্ত ব্রিটেনে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন মোট ৭৩ হাজার ৫১২ জন। এদের মধ্যে ওল্ডহ্যামের বাসিন্দা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মহসিন ইসলাম ছিলেন ব্রিটেনে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া তৃতীয় ব্যক্তি। তার স্ত্রী রাবিয়া ইসলামও একই সঙ্গে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তবে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে রীতিমত লড়াই করে তিনি ফিরে আসেন তার দুই সন্তানের কাছে।

রাবিয়া ইসলাম বর্ণনা করেছেন ২০২০ সালের ভয়ংকর এই মহামারির সঙ্গে তার বছরজুড়ে সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, ‘‘ইতালি থেকে যেদিন আমার স্বামী ফিরলেন, সেদিনটির কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। আমি এবং আমার মেয়ে তাকে আনতে এয়ারপোর্টে যাই। ২৯ ফেব্রুয়ারি, শনিবার ছিল সেদিন। তখনো ব্রিটেনে সবকিছু স্বাভাবিক। কোন লকডাউন শুরু হয়নি।

আমার স্বামী মহসিন ইসলাম ইতালিতে আসেন ১৯৮৯ সালে। কিছুদিন রোমে ছিলেন। কিন্তু এরপর লেকোতেই থেকেছেন ২৮ বছর। আমিও বিয়ের পর থেকে এই শহরে থাকতাম। লেকোতে তিনি একটা কারখানায় কাজ করতেন। কিন্তু ২০১৪ সালে আমরা পাকাপাকি ব্রিটেনে চলে আসি।

লেকোতে তিনি বেড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু মিলানে লকডাউনের খবর শোনার পর আমরা তার টিকেট বদল করে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বললাম। ২৯ ফেব্রুয়ারি তিনি ফিরতি ফ্লাইট ধরলেন। যখন প্রথম এয়ারপোর্টে তাকে দেখি, তার মধ্যে অসুস্থতার কোন লক্ষণ দেখিনি। বিমানবন্দরে তখন একটি নোটিশ লাগানো ছিল। তাতে বলা হচ্ছিল, যারা ইতালি থেকে ফিরবে, তাদের ১৪ দিন কোয়ারেনটিনে থাকতে হবে। আমার মেয়ে সেই নোটিশ দেখে আমাকে বললো, `আগামী ১৪দিন কিন্তু উনি ঘরের বাইরে যেতে পারবেন না'।

রোববার সকালে আমার মনে হলো, আমার স্বামী যেন বেশ ক্লান্ত। আমরা ভাবলাম, জার্নি করে এসেছেন, অসুস্থ মানুষ, তাই হয়তো ক্লান্ত। ওনার শরীর গত কয়েক বছর ধরে ভালো যাচ্ছিল না। তিন বছর আগে একবার স্ট্রোক করে শরীরে এক পাশ কিছুটা অবশ হয়ে গিয়েছিল। এরপর হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসও ছিল।

মার্চের তিন তারিখে উনার আগে থেকেই একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল আমাদের বাড়ির কাছের হেলথ সেন্টারে। উনাকে কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলেছিল, বাইরে যাওয়া নিষেধ। কিন্তু তারপরও সেখানে যেতে চাইলেন।

একটা ট্যাক্সি ডেকে আমরা সেখানে গেলাম। আমার স্বামীর শরীর সেদিন বেশ খারাপ। উনার মধ্যে যেন কোন শক্তি নেই। উনি ভালো করে দাঁড়াতে পারছেন না। নার্স জিজ্ঞেস করলো, `কি ব্যাপার, তোমার স্বামীর কী হয়েছে, ও মাস্ক পরে আছে কেন'?

আমি তাকে বললাম, বুঝতে পারছি না, ইতালিতে গিয়েছিল।

নার্স যেন একটু চমকে গেল। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, `ইতালির কোথায়'? আমি বললাম, লেকো।

সাথে সাথে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলো। বললো, `এটা কি মিলানে'?

আমি বললাম, হ্যা, মিলান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে।

এরপর নার্স দ্রুত আমাকে একটা মাস্ক দিল পরতে। তারপর ব্যস্ত হয়ে নানা জায়গায় ফোন করতে লাগলো। আমাদের অপেক্ষা করতে বললো। আমার পানির পিপাসা পেয়েছিল। কিন্তু আমাদের কোথাও যেতে দিচ্ছিল না। বললো, `এখান থেকে বেরুতে পারবে না'।

তারপর বহু অপেক্ষার পর সেখানে একটা অ্যাম্বুলেন্স আসলো আমার স্বামীকে নিয়ে যেতে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ম্যানচেস্টারের এক হাসপাতালে। সেখানে উনাকে ভর্তি করে রেখে দিল। তারপর আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। আমাদের বলা হলো, কেউ যেন বাড়ি থেকে বের না হই। ১৪ দিন সবাইকে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।

প্রথম দুদিন আমার স্বামী হাসপাতাল থেকে নিয়মিত ফোন করতেন। কথা বলতেন। এরপর ব্লাড টেস্টের রেজাল্ট আসলো। জানা গেল উনার করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সেদিন বিকেলের দিকে টেলিফোন করে উনি কেঁদে ফেললেন। উনি সবসময় বলতেন, আমি মারা গেলে তোমরা আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে কবর দেবে। এখানে আমাকে মাটি দিও না। ডাক্তার যখন উনাকে জানিয়েছেন যে উনার করোনাভাইরাস হয়েছে, তখন হয়তো উনি বুঝে গেছেন যে উনি হয়তো আর বাঁচবেন না।

সেদিনই উনার সঙ্গে আমার শেষ কথা হলো। এরপর দিন থেকে উনার শরীর অনেক খারাপ হয়ে গেল। প্রতিদিন বিকেলে বা সন্ধ্যায় ডাক্তার আমাদের ফোন করে আপডেট দিতেন।

হাসপাতাল থেকে উনি যেদিন শেষবার ফোন করেছিলেন, সেদিন বার বার বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি আমাকে বাংলাদেশের একটা টিকেট কেটে দিতে পারতে, আমি বাংলাদেশে চলে যেতে পারতাম’।

শুক্রবার ডাক্তার টেলিফোন করে বললেন, ‘আমরা উনাকে অক্সিজেন মাস্ক দিয়েছি। কিন্তু উনি মাস্কটা রাখছেন না, খুলে ফেলছেন’।

এর মধ্যে আমিও অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার জ্বর জ্বর লাগছিল। মনে হচ্ছিল বুঝি আমারও কিছু হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলা হলো, আমাদের সবাইকে টেস্ট করা হবে। রোববার সকালে অ্যাম্বুলেন্স আসবে। আমি যেন রেডি হয়ে থাকি। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।

৮ মার্চ, রোববার সকালে আমরা রেডি হয়ে বসে আছি। সকাল দশটার দিকে আমি শুনি, আমার ছেলে টেলিফোনে যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। ওর কথা শুনে আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। আমি তাড়াতাড়ি উঠে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এ সময় কার সঙ্গে কথা বলছিস? ও আমার কথার জবাব দেয় না।

আমি বিছানায় উঠে বসলাম। আমার ছেলে আমার বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো।

আমি আবার জানতে চাইলাম।

তখন আমার ছেলে বললো, ‌‘আম্মু, আব্বা মারা গেছে। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল। বলেছে, আধা ঘন্টা আগে মারা গেছে।’

বাড়িতে কান্নাকাটি করছি আমরা সবাই। এর ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই দেখি অ্যাম্বুলেন্স এসেছে আমাকে নিতে। অ্যাম্বুলেন্সের কর্মীরা ঘরে এসে দেখে, আমরা সবাই কাঁদছি। ওরা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে’।

আমি বললাম, আমার স্বামী অসুস্থ ছিলেন, ম্যানচেস্টার হাসপাতালে। উনি মারা গেছেন। ঘন্টাখানেক আগে।

এরপর অ্যাম্বুলেন্স কর্মীরা আধঘন্টা ধরে নানা জায়গায় ফোন করলো। তারপর আমাকে ম্যানচেস্টারে সেই একই হাসপাতালে নিয়ে গেল।

যখন ডাক্তার এসে আমাকে পরীক্ষা করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে, তখন আমি ডাক্তারকে বললাম, আমার স্বামী আজকেই এই হাসপাতালে মারা গেছে। আমি আমার স্বামীকে দেখতে চাই। আমাকে অন্তত শেষ বারের মতো আমার স্বামীকে দেখতে দিন।

ডাক্তার বললো, ‘আমি কথা বলে দেখি, যদি অনুমতি মেলে, আপনি আপনার স্বামীকে দেখতে পাবেন।’

ঘন্টাখানেক পর একজন ডাক্তার আসলেন। উনি একজন ভারতীয় বাঙালি। উনি সাথে অ্যাপ্রন, মাস্ক সব নিয়ে আসলেন। সেগুলো পরে আমি আমার স্বামীর লাশ দেখতে গেলাম।

আমি ভাবলাম, আমি অন্তত আমার স্বামীর লাশ দেখার সুযোগ পাচ্ছি। কিন্তু আমার ছেলে-মেয়েরা, ওরা তো সেই সুযোগও পাবে না। আমি সবাইকে অনুরোধ করলাম, অন্তত আমার স্বামীর একটা ছবি তুলতে দিন আমাকে।

এরপর আমার করোনাভাইরাস পরীক্ষা করলো। আমাকে তারপর আবার বাড়ি পাঠিয়ে দিল।

আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হলো, লাশ নিয়ে আমরা কী করবে। আমরা বললাম, আমরা তাকে ইসলাম ধর্ম মতে দাফন করতে চাই। তখন আমাদের বলা হলো, এখনই সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না।

আমি যখন হাসপাতালে, তখনই আমার স্বামীকে কবর দেয়া হয়েছিল। আমার ছেলে পর্যন্ত জানাজায় যেতে পারেনি। কারণ তখন কোয়ারেন্টিনে ছিল সবাই। শুধু কয়েকজন প্রতিবেশি জানাজায় যেতে পেরেছিল।

উনার ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশে নিজ শহর কুষ্টিয়ায় যেন উনাকে কবর দেয়া হয়। কিন্তু এমন এক সময়ে উনি মারা গেলেন, সেই ইচ্ছে আমরা পূরণ করতে পারিনি। বাংলাদেশ হাইকমিশনে আমরা কথা বলেছিলাম। সেখান থেকে বলেছিল, লকডাউনের মধ্যে এটা কোনভাবেই করা যাবে না। হয়তো আপনাদের লাশই দেবে না।

আমার দ্বিতীয় করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফলও পজিটিভ আসে। আমার শরীর ততদিনে খুব খারাপ হয়ে যায়। আমাকে বলা হয়, আমার ফুসফুসে ইনফেকশন হয়ে গেছে। হাসপাতালে থাকতে হবে। প্রায় দশ-এগারোদিন আমাকে হাসপাতালে রেখেছিল। এটা ছিল আমাদের পরিবারের জন্য এক ভয়ংকর দুঃসময়। আমার দুই ছেলে মেয়ে ভয় পাচ্ছিল, এবার না আমিও চলে যাই তাদের ছেড়ে।

এদেশে আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন নেই। ইতালিতেও ছিল না। সেজন্যে আমাকে নিয়ে ওরা আরও বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। ওরা প্রতিদিন ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করতো আমার খবর জানার জন্য।

হাসপাতাল থেকে যখন আমি বাড়ি ফিরলাম তখন আমার শরীর খুব দুর্বল। এক্সরে করে ডাক্তাররা বললো, আমার ফুসফুসের যে ক্ষতি হয়েছিল, তা পুরোপুরি সারেনি। আমার বয়স যেহেতু ৬০ এর বেশি, তাই একশো ভাগ ভালো হবে না। সমস্যা একটু থাকবেই।

এখন আমি একটু হাঁটতে গেলেই ক্লান্ত হয়ে যাই। আমার সমস্যা এখনো আছে।

আমার স্বামীকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছে, সেটা আমাদের বাড়ি থেকে দু মাইলের মতো। ওল্ডহ্যামের চ্যাডারটন কবরস্থান। সেখানে আমি প্রথম যেতে পেরেছিলাম মে মাসে, যখন লকডাউন একটু শিথিল করা হলো। মসজিদের যে লোকজন কবর দিয়েছিল, তারা আমাদের কবরটা চিনিয়ে দিয়েছিল। এটা একটা খ্রীষ্টান কবরস্থান। তার একপাশে মুসলিমদের কবর দেয়ার জন্য আলাদা একটু জায়গা। আমরা কবরটি ঘিরে দিয়েছি। আমি দুই তিন সপ্তাহ পর পর সেখানে যাই।

[media type="image" fid="103658" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

কবরের ওপর কিছু ফুলের গাছ লাগিয়েছি। কিছু টিউলিপ আর ড্যাফোডিলের বাল্ব পুঁতেছি। সামনের বসন্তে এগুলো ফুটবে বলে আশা করছি।

মার্চে যখন আমার স্বামী মারা গেলেন, আমারও করোনাভাইরাস হলো, তখন এটা নিয়ে আমরা খুব বেশি কিছু জানতাম না। কিন্তু করোনাভাইরাস শুনলেই সবাই ভীষণ আতংকিত হয়ে যেত। শুরুর কয়েক মাস পর্যন্ত আমাদের দেখলেই মানুষ ভয় পেত। বিশেষ করে আমাকে দেখলে।

কয়েক মাস পর দেখলাম মানুষের মধ্যে তেমন ভয় আর নেই। অথচ আমরা যখন খারাপ সময়টা পার করেছি, সেসময় বাজার করে দেয়ার জন্য একটা মানুষ পর্যন্ত পাওয়া যেত না। তবে আশে পাশের প্রতিবেশিরা অনেক সাহায্য করেছে।

কিন্তু লোকে যেন আর কেয়ার করছে না। মনে হচ্ছে যেন লোকে এটাকে মেনে নিয়েছে। তবে এখন দেখছি আবার অবস্থা খুব খারাপ। প্রতিদিন আবার শত শতা মানুষ মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা এখন ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অথচ আমার স্বামী ছিলেন এই ভাইরাসে মারা যাওয়া তৃতীয় ব্যক্তি। তারপর আরও এত মানুষ মারা গেছে!

২০২০ সাল ছিল এক ভয়ংকর বছর। আমরা এখনো এক ভয়ংকর সময় পার করছি। করোনাভাইরাসের টিকা চলে এসেছে। আমার স্বামী হয়তো আর আমার সঙ্গে নেই। কিন্তু আমার আশা, আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি, বসন্তকাল আসতে আসতে এই মহামারি থেকে আমরা মুক্তি পেয়ে যাবো। সূত্র: বিবিসি বাংলা

আমারসংবাদ/জেআই