Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

হাত-পা ছাড়া মানুষটিই জয় করেছেন বিশ্ব 

আমার সংবাদ ডেস্ক

জুলাই ২৭, ২০২১, ০৫:৩৫ এএম


হাত-পা ছাড়া মানুষটিই জয় করেছেন বিশ্ব 

সদ্য জন্মানো বাচ্চাটাকে একটা তোয়ালে মুড়িয়ে মায়ের কাছে নিয়ে এসেছিল নার্স। কোলে নেওয়া তো দূরস্থান, ছেলেকে একঝলক দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন সদ্য প্রসূতি মা। হাত নেই, পা নেই- এমন জড়ভরত শিশুকে দুএক মুহূর্ত দেখেই ছুটে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে গেছিলেন বাবাও, বমি করবেন বলে। নিজের আত্মজীবনীতে ঠিক এই কথাগুলোই লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের বাসিন্দা নিক ভুজিসিক।

৩৮ বছরের নিক ভুজিসিক জন্ম থেকেই এক বিরল রোগে আক্রান্ত। ডাক্তারি পরিভাষায় এই অসুখটার নাম ফোকোমেলিয়া বা ‘টেট্রা অ্যামেলিয়া সিনড্রোম’। এই রোগে আক্রান্ত মানুষদের কোনও হাত–পা থাকে না। বিকলাঙ্গতা নিয়েই শিশু জন্ম নেয়। 

চিকিৎসকরা বলেন এই রোগের পিছনে দায়ি মানুষের শরীরের ডাব্লিউএনটি৩ জিন। ভ্রুণ অবস্থায় যখন একটা শিশুর হাত, পা তৈরি হওয়ার কথা, তখন ডাব্লিউএনটি৩ জিনের প্রভাবে সেই বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। শুধু হাত-পা’ই নয়, শরীরের আরও বিভিন্ন অঙ্গের স্বাভাবিক গঠন বাধা পেতে পারে এই অসুখে। জন্ম নিতে পারে সম্পূর্ণ জড়ভরত শিশু। সৌভাগ্যক্রমে নিক ভুজিসিকের সঙ্গে ব্যাপারটা অতটা খারাপ না হলেও, জন্মের সময় থেকেই হাত পা কিছুই ছিল না তাঁর। প্রায় কোমরের নীচেই তাঁর পায়ের পাতা। শুরুতে সেই পায়ের আঙুলগুলোও জোড়া ছিল। ডাক্তারদের রীতিমতো অপারেশন করে পায়ের সেই আঙ্গুলগুলি আলাদা করতে হয়েছে।

প্রথম দেখায় অস্বীকার করলেও পরে এটাকেই ভগবানের ইচ্ছে ভেবে বাবা-মা বুকে টেনে নেন ছোট্ট নিককে। কিন্তু বাবা-মা মেনে নিলেও এত সহজে সমাজ মেনে নিতে পারেনি নিককে। আর পাঁচজন মানুষের মতো ছিল না নিক। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে যত না কষ্ট দিত, তার চেয়ে ঢের বেশি কষ্ট দিত লোকজনের অবজ্ঞা, হাসিঠাট্টা৷ মানসিক যন্ত্রণা এতটাই তীব্র ছিল যে মাত্র ১০ বছর বয়সে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে সে। সে যাত্রা বেঁচে যাওয়ার পর একটা সিদ্ধান্ত নেয় নিক, সে ঠিক করে এভাবে হারার আগেই হেরে যাবে না। পালিয়ে না গিয়ে একটা ইতিবাচক লড়াই সে ফিরিয়ে দেবে জীবনকে। এর পরেই একটু একটু করে বদলে যায় তার জীবনের গল্প।

নিক যে হাইস্কুলে পড়ত সেই স্কুলের এক দারোয়ান প্রথম তাকে উৎসাহ দিয়েছিল লোকজনের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা একেবারেই সোজা ছিল না। বহুবারের চেষ্টায় সে যখন প্রথমবার মঞ্চে উঠেছিল বক্তৃতা দিতে, তখন তাকে দেখামাত্র দর্শকাসন ফাঁকা হতে শুরু করেছিল। কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি নিক। মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকেই সে ‘প্রেয়ার’ গ্রুপে নানা বিষয়ে নিয়মিত বক্তৃতা দিতে শুরু করেন।

ধীরে ধীরে বক্তা হিসাবে জনপ্রিয় হচ্ছিলেন নিক। তাঁর কথাবার্তার মধ্যে যে পজিটিভিটি ছিল, তা আকৃষ্ট করে অনেক মানুষকে। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিক। মাত্র ২১ বছর বয়সেই গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি থেকে একাউনটেন্সি আর ব্যবসা পরিকল্পনা বিষয়ে কমার্স ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন নিক৷

খুব তাড়াতাড়িই টিভি শো এবং নিজের ইতিবাচক লেখালিখির মাধ্যমে জনসাধারণের মনের কাছে পৌঁছে গেছিলেন নিক। মানুষের পরিচয় যতটা না শরীরী গঠনে, তার চেয়ে ঢের বেশি মননে, চিন্তনে- এ কথা নিজের জীবন দিয়ে প্রতিমুহূর্তে প্রমাণ করেছেন এই অস্ট্রেলিয় তরুণ। ২০০৫ নাগাদ ‘লাইফ উইদাউট লিম্বস’ নামে একটা সংস্থাও খোলেন তিনি। তার বছর দুয়েক পরই মোটিভেশনাল বক্তা হিসাবে আরও একটি কম্প্যানির জন্ম দেন নিক।

‘তিন সেকেন্ড, হ্যাঁ, মাত্র তিন সেকেন্ডেই একজন মানুষকে হতাশার দিকে ঠেলে দেওয়া যায়। তাও শুধুমাত্র কথা দিয়ে। আবার সেই কথার মাধ্যমেই মোটিভেট করে একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষকে ফিরিয়ে আনা যায় স্বাভাবিক জীবনে। তাই শব্দ ব্যবহার করার আগে ভেবেচিন্তে করুন’ – মানুষকে তাঁর পাশের মানুষটার প্রতি আরও একটু সংবেদনশীল হয়ে ওঠার ঠিক এই পরামর্শই দিয়ে থাকেন নিক।

শুধু বক্তা হিসাবেই নয়, একজন লেখক হিসাবেও সারা পৃথিবী চেনে নিক ভুজিসিক’কে। তাঁর প্রথম বই ‘লাইফ উইদাউট লিমিটস’ প্রকাশ পায় ২০১০ সাল নাগাদ। এর মধ্যেই প্রায় ৩০ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই বই। লক্ষ লক্ষ পাঠকের লাইন দিয়ে সংগ্রহ করা এই বই, আন্তর্জাতিকভাবে বেস্ট সেলার খেতাবও পেয়েছে। এ ছাড়াও এখন পর্যন্ত আরও পাঁচটি বই লিখেছেন তিনি। সেগুলোও পাঠকদের মধ্যে একইরকম জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, নিক একজন দক্ষ অভিনেতাও৷ ‘দ্য বাটারফ্লাই সার্কাস’ নামের একটি সিনেমাতে অভিনয়ও করেছেন তিনি। ২০১০এ শর্টফিল্মে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার শিরোপাও উঠেছে তাঁর মাথায়।ব্যক্তিজীবনেও কিন্তু ব্যর্থ নন নিন। যতই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাক, নিজের নিয়মেই প্রেম এসেছে নিকের জীবনেও। ২০০৮এ টেক্সাসে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় কানায়ে মিয়াহারার। ২০১২তে বিয়ে করেন তাঁরা৷ চার-চারটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তাঁরা। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে একেবারে ভরভর্তি সুখের পরিবার।

জন্মের সময় যাঁরা তাঁকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন, পরে সেই বাবা-মা’ই আদর-ভালোবাসায় বড় করে তুলেছিলেন নিককে। প্রতিমুহূর্তে তাঁকে বুঝিয়েছেন সন্তান হিসাবে তিনি কত স্পেশাল। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক স্কুলে পড়াশোনা করেছেন নিক। সেই সবকিছুই করেছেন, যা একজন স্বাভাবিক মানুষ করে থাকে। স্বামী হিসাবে, বাবা হিসাবেও তিনি আর পাঁচজনের মতোই স্বাভাবিক।

পরবর্তীকালে একটি সাক্ষাৎকারে নিক বলেছিলেন – ‘আমার হাত নেই, পা নেই, তবু আমি সুন্দর। এ কথা বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন আমার বাবা-মা। তাঁরা যদি সেদিন আমাকে না বলতেন আমি কত স্পেশাল, যদি না ভালোবাসতেন, তাহলে আজ এখানে থাকতাম না আমি।’

ভবিষ্যতের ভয়, প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার ভয়, লোকের অবজ্ঞা সহ্য করতে না পারার ভয়- কতরকম ভয় যে আমাদের বর্তমানকে কুরে কুরে খায়! যে কোনও নতুন কাজে হাত দেবার আগে বুকের ভিতরে চেপে বসে ভয়। আর সেখানেই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বছর ৩৮য়ের এই অস্ট্রেলিয় তরুণ।জীবনে যাই হয়ে যাক, কখনও ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না নিক৷ সমস্ত চ্যালেঞ্জকে তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করেছেন, পার করেছেন যাবতীয় হার্ডেল। নিকের জীবন এই সমাজের কাছে একটা দৃষ্টান্ত, ইচ্ছে থাকলে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকেই জয় করা যায়, শুধু বক্তৃতা দিয়ে নয়, তিনি সমস্ত জীবন দিয়ে সে কথাই বুঝিয়ে চলেছেন ফাইটার নিক ভুজিসিক।

সুত্র-দ্য ওয়াল ব্যুরো

আমারসংবাদ/এডি