Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

দেশে শুধু ‘ইস্যু’ পচে!

নভেম্বর ২৫, ২০২০, ০৬:০০ পিএম


দেশে শুধু ‘ইস্যু’ পচে!

দেশে শুধু ইস্যু পচে! প্রতি মাস সপ্তাহ ইস্যুতেই গরম পরিস্থিতি। বস্তিতে আগুন, বাসে আগুন, নেট দুনিয়ায় ভ্যাকসিন উত্তেজনায় দেশ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণধর্ষণ, অর্থলুট, রোহিঙ্গা ইস্যু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত একেক ইস্যুর পর শুধু ইস্যু আসছেই।

রাজনৈতিক-সামাজিক ইস্যুসহ দিন শেষে একটিরও অস্তিত্ব থাকছে না। নতুনে ডুবে যাচ্ছে সব। কিছুতেই টনক নড়ে না সংশ্লিষ্টদের। ন্যায়বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু পৌঁছে না আদালতেও। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনাতেই থেকে যাচ্ছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১১ মাসে ৫৭টি বড় রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি হলেও একটিরও কার্যত সমাধানের আলো দেখেনি। নজিরবিহীন ৯৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জানুয়ারিতে যখন ক্ষমতাসীন সরকার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো গঠন করেন, তখন রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো বিস্ময়কর নীরব ছিলো।

একই মাসে শুরু হয় বিশ্ব ইজতেমার পর্ব ও আখেরি মুনাজাতও। ফেব্রুয়ারি মাস পার হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা এবং আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের উৎসব। এরপর শুরু হয় বড় বড় রাজনৈতিকসহ জবাবদিহির ইস্যু।

তখন প্রেস রিলিজ, মানববন্ধনসহ ঘরোয়াভাবে বিরোধিতাতেই বোবাভূমিকায় ছিলো বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো। আন্দোলন, প্রতিবাদের হুমকি, অবস্থান রাজনৈতিক দলের অফিস ও প্রেস ক্লাবে সীমাবদ্ধ ছিলো। গত মার্চ থেকে আট মাসে করোনায় সরকারের ভুলের বিরোধিতা করেও আলোর মুখ দেখেনি কেউ।

দেশের রাজনীতি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চোখ রাখা ব্যক্তিরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারছে না। বিশেষ করে দেশব্যাপী করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় অদক্ষতা, বাসে আগুন, করোনায় ভ্যাকসিন রাজনীতি, রোহিঙ্গা ইস্যু, পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে হত্যা, হাজী সেলিমসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড, দিনাজপুরে ইউএনওকে হত্যাচেষ্টা, আলু-পেঁয়াজসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতিসহ নানা ইস্যুতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় বহু চাপে দিন কাটাচ্ছে সরকার। বিরোধীদের কাজে লাগাতে পারছে না কোনো ইস্যু। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাপের মধ্যে আছে স্বয়ং আওয়ামী লীগও।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে এখন সরকারবিরোধী সংগঠনগুলো গুরুত্বহীন হয়ে উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে— অধিকার ও সেবা না পাওয়ার। তবুও অনৈক্যতে রাজনৈতিক দলগুলো। চৌদ্দ দলীয় মহাজোট, বিশ দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, যুক্তফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, সম্মিলিত জাতীয় জোট, গণঐক্য— সব জোটেই চলছে এখন ভয়ঙ্কর গৃহদাহ।

এছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের কারণে চলছে ক্ষমতার অপব্যবহার, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে নেই আগের মতো আমেজ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে নেতৃত্ব সংকট।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি প্রেস ক্লাবে ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ, বিকল্পধারা বাংলাদেশকে মাঝে মধ্যে বিজ্ঞপ্তিতে দেখা মিলছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির পূর্বের অবস্থান হারিয়ে গেছে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ শুধু গণমাধ্যমেই সজাগ। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডিও বিবৃতি নির্ভর হয়ে গেছে। গণফোরামে চলছে একের পর ভাঙন। সময়ের আলোচনা-সমালোচনায় থাকা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও তাদের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির পর চুপ হয়ে গেছে।

এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের দাবি, বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। চলমান রাজনীতি নিয়ে কেউ আশাবাদী হওয়া দুরূহ! একটা অনিশ্চিত গন্তব্যের সামনে পুরো বাংলাদেশ। কারণ দেশে রাজনীতি বলে কিছু নেই। রাজনৈতিক দলগুলোয় স্বার্থজনিত সমস্যা বেড়েছে, ভাঙনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সবই বাণিজ্যিক, সবই ব্যবসানির্ভর। সে কারণে স্বার্থদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না।

এখন রাজনীতি ফায়দাভিত্তিক চলছে। আবার অনেকে এও মনে করছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একের পর জাদু দেখিয়ে যাচ্ছেন, তাই মানুষ মুগ্ধ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতার ওপর দেশের মানুষ সন্তুষ্ট। সরকারবিরোধীরা মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা পাওয়ার মতো কোনো কাজ দেখাতে পারছে না।

বিশেষ করে দেশের তিন তিনবারের ক্ষমতাধর দল বিএনপি এখন ওহি নির্ভর দল বলেও মনে করা হচ্ছে। ইউকে থেকে ওহি এলে তবেই দল চলছে। এছাড়া অস্তিত্ব হারিয়েছে বাম দলগুলো। ইসলামিক দলগুলোতেও নেই ঐক্য।  

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১০ মাসে বেশ কয়েকটি ইস্যু তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো ৩ মার্চ- খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় স্থানীয় গ্রামবাসী ও বিজিবির সংঘর্ষে চারজন নিহত হওয়া, ৮ মার্চ- প্রথম তিনজনের দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত, এরপর একের পর অদক্ষতার পরিচয় দেয়া।

২৫ জুন- বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে চালুর ঘোষণা দেয়া। ২৯ জুন- রাজধানীর ঢাকার শ্যামবাজারে বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবিতে অন্তত ৩৪ জন নিহত হওয়া। ৩০ জুন- করোনা ভাইরাস মহামারি রোধে ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের পরীক্ষামূলক লকডাউন করেও কার্যত ফল না পাওয়া।

২ জুলাই- করোনা ভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশে শনাক্তের সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর সমাধানের রূপরেখা না আসা, একই দিন বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়।

৭ জুলাই- করোনা ভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষায় প্রতারণার অভিযোগে উত্তরার বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করা ও দলীয় ব্যক্তি দুর্নীতি এবং প্রতারণার সঙ্গে জড়িত থাকা, একই দিন বান্দরবানে গোলাগুলিতে ছয়জন নিহত হওয়া, ৩ সেপ্টেম্বর- দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে ইউএনওর সরকারি বাসভবনে হামলা চালানো হয়।

হামলায় ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা গুরুতর আহত হওয়া, ৪ সেপ্টেম্বর- নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মসজিদের পাশের তিতাস গ্যাসের পাইপলাইন থেকে গ্যাস নিঃসরণের ফলে সংগঠিত বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৩১ জন নিহত হওয়া, ২৫ সেপ্টেম্বর- মুরারিচাঁদ কলেজের (এমসি কলেজ) ছাত্রাবাসে এক গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হওয়া।

২৯ সেপ্টেম্বর- রাজশাহীর তানোরে একটি গির্জায় খ্রিস্টান আদিবাসী মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের অভিযোগে গির্জার প্রধান ফাদার প্যাট্রিক গমেজ, ফাদার কামেল মার্ডি ও প্রদীপ গ্রেগরীকে গ্রেপ্তার।

৪ অক্টোবর- নোয়াখালীর এক গৃহবধূকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের ৩২ দিন আগে ধারণকৃত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া। সর্বশেষ চলতি মাসের শেষের দিকে পুরান ঢাকার এমপি হাজী সেলিমপুত্রের ক্ষমতার অপব্যবহার ও বাবার দুর্নীতির সিরিজ প্রকাশ হওয়া।

গত ২৪ ডিসেম্বর সোমবার রাত পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুন লাগে। সেখানে পুড়ে গেছে ২০০ ঘর ও ৩৫টির বেশি দোকান। একদিনের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় আরও দুটি স্থানে আগুন লাগে।

আর তা হলো রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাবর রোডের বিহারিপট্টি ও মিরপুরের কালশী বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে আগুনের ঘটনা। বারবার এমন আগুন লাগা নিয়ে রহস্য ও উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। নয়া ইস্যু গোল্ডেন মনির।

গত ২১ নভেম্বর শনিবার মেরুল বাড্ডায় মনির হোসেনের বাড়িতে অভিযান চালায় র‍্যাব। ছয় তলা বিলাসবহুল ওই বাড়ি থেকে নগদ এক কোটি ৯ লাখ টাকা, এছাড়া ৯ লাখ টাকা মূল্যমানের ১০টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা, চার লিটার মদ, আট কেজি স্বর্ণ, একটি বিদেশি পিস্তল এবং কয়েক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।

গত ১২ নভেম্বর রাজধানীতে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১০টি বাসে রহস্যময় সিরিজ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচন চলাকালে পৃথক ১০ স্থানে এমন ঘটনা ঘটে।

এ নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। চলমান রাজনীতি নিয়ে আশাবাদী হওয়া দুরূহ, একটা অনিশ্চিত গন্তব্য আমাদের সামনে।

তিনি বলেন, দেশে রাজনীতি বলে কিছু নেই। রাজনৈতিক দলগুলোয় স্বার্থজনিত সমস্যা বেড়েছে, ভাঙনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সবই বাণিজ্যিক, সবই ব্যবসানির্ভর। সে কারণে স্বার্থদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। এখন রাজনীতি ফায়দাভিত্তিক চলছে। সব দলের নেতাকর্মীদের ধারণা— ক্ষমতায় থাকলেই লাভবান হওয়া যায়।’

তিনি বলেন, এই যে জি কে শামীম, সম্রাটরা তৈরি হলেন, কীভাবে? তারা তো রাজনীতি করেননি। কিন্তু ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অর্থ লুটপাট করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে সুযোগবঞ্চিত হওয়ার কারণে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটার পর একটা জাদু দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু জাদুর সমস্যা হলো, জাদু যতক্ষণ আছে, মানুষ ততক্ষণ মোহমুগ্ধ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও একের পর জাদু দেখিয়ে যাচ্ছেন তাই মানুষ মুগ্ধ। তবে এই মুগ্ধতা শেষ হলে কিন্তু মোহ কেটে যায়।’

বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির সমালোচনা করে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘বিএনপি ওহি নির্ভর। ইউকে থেকে ওহি আসলেই হবে। আজকে মনে করেন খালেদা জিয়ার পপুলারিটিকে তো না বলতে পারবো না আমরা। সরকার ভীষণ বুদ্ধিমত্তার কাজ করেছে, তাকে জনগণের কাছ থেকে ভুলিয়ে দিতে। তাকে বেল দেয় না কিন্তু গুলশানের বাড়িতে রাখে। এটা সরকারের জন্য ভুল, বিএনপির উচিত মাঠে নামা। মাঠে নামছেন না তারা। দু-একটা বক্তৃতা দিয়েই তারা খালাস হয়ে যাচ্ছে।

জনগণের পক্ষে কথাটা বলবে কে?’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই ইস্যু নিয়ে সমপ্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে বিএনপি ইস্যু খুঁজতেছে। বিএনপি সুপ্রিম কোর্টের ইস্যুতে মার খেয়েছে। এখন তারা রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে কাজে লাগাতে চাইছে।

সেটাও আকাশে উড়ানো ফানুসের মতো এরই মধ্যে উড়ে চলে গেছে। সেটাও তারা কাজে লাগাতে পারেনি। এখন প্রেস ব্রিফিং আর সরকারের বিরুদ্ধে পুরনো মিথ্যা রেকর্ড বাজানো ছাড়া বিএনপির আর কোনো রাজনীতি এ মুহূর্তে নেই। বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন দল বলেই সরকার আলোচনা করছে না।’

আমারসংবাদ/এআই