Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা

ডিসেম্বর ৬, ২০২১, ০৭:৪০ পিএম


স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা
  • ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে
  • বোর্ডের পাশাপাশি সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে: এপিইউবি সভাপতি
  • ট্রাস্টি বোর্ডগুলো থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে: শিল্প প্রতিমন্ত্রী
  • শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে: শিক্ষা মন্ত্রণাল

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টের উদ্যোগে কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায় দেশের প্রায় ডজনখানেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নানামুখী সংকট তৈরি হয়েছে। এর মধ্য মেডিকেল সেন্টার সংকটে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। ভুগছেন মানসিক রোগেও।

অনেকে আবার আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু এত সমস্যা ঘিরে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেই কার্যকরী পদপক্ষেপ বা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট মহল থেকে দাবি উঠেছে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার।

দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে বলছে, চাকরির বাজারে অগ্রগামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরাই।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের হার যেখানে ৩২ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা ৪৪ শতাংশ। দেশের সরাকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পৃথক মেডিকেল সেন্টারে সেবা দিয়ে থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেহাল দশা। 

ইউজিসির ৪৫তম বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় সাড়ে তিন লাখ। 

সর্বশেষ ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থী রয়েছেন প্রায় ৪১ লাখ। এর মধ্যে ৫১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন লাখ এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। অথচ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের জন্য নেই অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক, ওষুধ। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য  সুরক্ষায় নেই কাউন্সেলিং সেন্টার এমনকি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাও। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় একাধিক ক্যাম্পাস পরিচালনা করলেও মেলেনি স্বাস্থ্যসেবার ছিটেফোঁটাও। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নামমাত্র একজন চিকিৎসক দিয়ে মেডিকেল সেন্টার পরিচালনা করলেও মেলে না সেবা, ওষুধ বা জরুরি পরামর্শ। এমনটাই অভিযোগ করছেন বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। 

শিক্ষার্থীদের দাবি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও মেডিকেল সেন্টার ও চিকিৎসক নিশ্চিত করা হোক। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল শর্ত হলো এটিকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হতে হবে, আইনে এমনটাই বলা আছে। অর্থাৎ কেউ যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চায় তবে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে হবে।

ট্রাস্টি বোর্ডের অর্থায়নেই সব করতে হবে এবং এখান থেকে লাভের এক পয়সাও বোর্ড নিতে পারবে না। যে অর্থ আয় হবে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নেই ব্যয় করতে হবে। কিন্তু নামে-বেনামে শিক্ষার্থীদের ওপর আরোপিত টিউশন ফি, উন্নয়ন ফিসহ নানামুখী ফি গ্রহণ করলেও স্বাধীনতা পরবর্তী এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। করোনা মহামারিকালে দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো জরিপে দেখা গেছে, ৮৪ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তাদের ৪ ভাগের ৩ ভাগ শিক্ষার্থী পড়ালেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এসময় গ্রামে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এই প্রবণতা দেখা গেছে। 

এসব শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ নিয়মমতো ঘুমাতে যান না। তারা মুঠোফোন, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের সামনে বেশি সময় কাটান। পরিসংখ্যান বলছে, যারা পর্দার সামনে বেশি থাকেন, তাদেরই বিষণ্নতায় ভোগার হার বেশি। যারা দিনে সাত ঘণ্টার বেশি সময় পর্দার সামনে কাটিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই বিষণ্নতায় ভুগছেন। 

দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পরে একাধিক পরীক্ষা, ক্লাস ও টিউশন ফি দেয়ার চাপসহ শহরকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় হতাশার এই মাত্রা আরও কয়েকগুণ বেড়েছে বলে মনে করছেন বেশির ভাগ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। শিক্ষার্থীদের আচরণগত এমন পরিবর্তনকে হুমকি বলেও মনে করছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। দ্রুত এসব শিক্ষার্থীকে কাউন্সেলিংয়ের আওতায় না  আনতে পারলে অবস্থার অবনতি হবে বলেও জানাচ্ছেন বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ।

সামাজিক সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের প্রভাব’ শীর্ষক জরিপে জানা যায়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণকারী মোট ৭৩৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৯১ জন বা ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। 

জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া, মাথা ব্যথা, কাজে মনোযোগ কমে যাওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং ঘুমেও ব্যাঘাত ঘটা অন্যতম বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। সমস্যা থাকলেও  বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থীর জন্য নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেবাদান কেন্দ্র, নেয়া হচ্ছে না প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসে ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ফার্মেসি, সিভিলসহ একাধিক বিভাগে প্রায় দুই হাজারের অধিক শিক্ষার্থীর জন্য নেই কোনো মেডিকেল সেন্টার। নেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাও। শহর থেকে ক্যাম্পাস দূরে হওয়ায় আশেপাশে নেই কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্র। এতে প্রতিনিয়তই চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীদের। 

এদিকে ঢাকার স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীদের জন্য মেডিকেল সেন্টার অনুমোদন দিলেও নেই কার্যক্রম। সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির কাম্পাসেও নেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা। প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য উত্তরার ওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতেও নেই মেডিকেল সেন্টার। 

এদিকে আশা ইউনিভার্সিটি, অতিশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটিসহ প্রায় ডজন খানেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা।

শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য জটিলতার নানা বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারেক মাহমুদ হোসেন জানান, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিজস্ব মেডিকেল সেন্টার নিশ্চিত করা জরুরি। মেডিকেল সেন্টারের প্রাথমিক সেবা এবং ইউনিভার্সিটি চলাকালীন সময়ে চিকিৎসক নিশ্চিত করতে না পারলে অনেক সময় অপ্রত্যাশিত ক্ষতি বয়ে আনতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য। তাছাড়া অনেক শিক্ষার্থীর জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন হতে পারে, সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিভার্সিটিতে মেডিকেল সেন্টার নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেডিকেল সেন্টার স্থাপন করা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সেবা কার্যক্রম নিশ্চিত করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি বোর্ডের পাশাপাশি এ বিষয়ে সরকার এগিয়ে এলে ভালো কিছু উপহার দেয়া সহজ হবে।’ 

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেডিকেল সেন্টার স্থাপনে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার আমার সংবাদকে জানান, ‘দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মানসিক বিষণ্নতা আসতে পারে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল সেন্টার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডগুলো থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’

এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অতিরিক্ত সচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামাণিক আমার সংবাদকে জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঘিরেই সমস্ত প্রক্রিয়া পরিচালনা করে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যেহেতু শিক্ষার্থীদের কল্যাণেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় সেহেতু তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। করোনা পরবর্তী অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন। সুতরাং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কাউন্সেলিং ও চিকিৎসাসেবা দেয়া প্রয়োজন।