Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

৩০০ মুসলিম শহীদের নাম বাদ দিচ্ছে ভারত!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আগস্ট ২৭, ২০২১, ০২:২৫ পিএম


৩০০ মুসলিম শহীদের নাম বাদ দিচ্ছে ভারত!

বর্তমানের কেরালা রাজ্যের মালাবার অঞ্চলে ১৯২১ সালে 'মোপলা বিদ্রোহ' নামে একটি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেয়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিহত, যাদের শহীদের সম্মান দেয়া হয়েছে, সেই তালিকা থেকে প্রায় ৩০০ জন মুসলিম বিদ্রোহীর নাম বাদ দিতে চলেছে দেশটির ইতিহাস গবেষণা কাউন্সিল। তবে ওই বিদ্রোহ আসলে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম ছিল, নাকি এক ধর্মীয় দাঙ্গা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

'শহীদ' সম্মান পাবেন যে কারণে

বর্তমান কেরালা রাজ্যের মালাবার অঞ্চলে আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে মোপলা বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী, আলি মুসলিয়ারদের নেতৃত্বে।

সশস্ত্র সংগ্রামে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন বলে প্রচলিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, যার মধ্যে ২৩৩৯ জন বিদ্রোহীও ছিলেন। এই বিদ্রোহীদের মধ্যে ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করে একটি বদ্ধ ট্রেনের কামরায় চাপিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ে ৬৪ জনের মৃত্যু হয়। সে বছরের ১০ই নভেম্বরের ওই ঘটনা 'ওয়াগন ট্র্যাজেডি' নামে ইতিহাসে চিহ্নিত। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা একে অপরের মূত্র পান করে জীবনরক্ষা করতে বাধ্য হন। সেই আন্দোলনে নিহত ৩৮৭ জনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের 'শহীদ' বলতে রাজী নয় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ (আইসিএইচআর)।

দু'হাজার উনিশ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত দিয়ে ডিকশনারি অফ মার্টার্স - ইন্ডিয়াস ফ্রিডাম স্ট্রাগল নামের যে গ্রন্থমালা প্রকাশ করেছিল আইসিএইচআর, তার পঞ্চম খন্ডে মোপলা বিদ্রোহীদের শহীদই বলা হয়। কিন্তু এখন কাউন্সিলের তিন সদস্যের এক কমিটি ঠিক করেছে যে ওই গ্রন্থ থেকে ৩৮৭ জন মোপলা বিদ্রোহীর নাম সরিয়ে দেওয়া উচিত।

শহীদ সম্মান ফিরিয়ে নেয়ার এই সিদ্ধান্ত সর্ম্পকে তিন সদস্যের ওই কমিটির প্রধান, অধ্যাপক সি. আই. আইসাক বলছেন, ১৯২১-এর ওই বিদ্রোহ কোনও ভাবেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল না। সেটি ছিল ধর্মীয় সহিংসতা। "ওই বিদ্রোহকে কখনই স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ বলা যায় না। ওটা ছিল একটা ধর্মীয় সহিংসতা। জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরকরণের প্রচেষ্টা ছিল ওটা। "যারা ধর্মান্তরকরণে রাজী হত না, তাদের হয় মেরে ফেলা হত নয়তো ভয়াবহ অত্যাচার করা হত। আর যারা ভয় পেয়ে ধর্মান্তরিত হতেন, তাদের জোর করে আমিষ খাবার খাওয়ানো হত। সেজন্যই ওই বিদ্রোহকে কখনই স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ হিসাবে মানা যায় না।

কী ধরণের নথি যাচাই করা হয়েছে?

তার নেতৃত্বাধীন কমিটি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে - তার কী কী প্রমাণ পেয়েছেন, এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আইসাক বলছিলেন, "নিশ্চয়ই। আমরা বহু নথি যাচাই করেছি। এর মধ্যে ব্রিটিশ প্রশাসনের নথিপত্র যেমন আছে, তেমনই আর্য সমাজের নথি রয়েছে। আবার মালাবার অঞ্চলের ডেপুটি কালেক্টরের নথিও আছে। এছাড়াও সমসাময়িক সংবাদপত্র, নানা আদালতের নথি, ইত্যাদি খতিয়ে দেখেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ব্রিটিশ প্রশাসন ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজীকে একজন দস্যু বা লুঠেরা বলে মনে করত। তাই ব্রিটিশ নথি বা সেই সময়ের আদালতের চার্জশিট - যা অধ্যাপক আইসাকের কমিটি যাচাই করেছে, সেখানে এরকম ভাষ্যই থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়।

কৃষক বিক্ষোভই কি রূপান্তরিত হয় ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহে?

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার তার বই 'মডার্ন ইন্ডিয়া: ১৮৮৫-১৯৪৭'-এ লিখেছেন, মোপলাদের অসন্তোষটা শুরু হয় আদতে কৃষিকে কেন্দ্র করেই। অধ্যাপক সরকার লিখছেন, দক্ষিণ মালাবার তালুকে ১৮৬২ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে জমি থেকে উচ্ছেদের ডিক্রি জারির সংখ্যা ৪৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সেই সময়ে জমির মালিকানা ছিল মূলত নাম্বুদিরি সম্প্রদায়ের কব্জায়। এই সম্প্রদায়টিকে কেরালার ব্রাহ্মণদের মধ্যে উচ্চতম বলে মনে করা হয়। কিছু জমির মালিকানা ছিল নায়ার সম্প্রদায়ের মানুষরা আর সামান্য কিছু ছিল মুসলমানদের হাতে।

কৃষকদের মধ্যে মুসলমান এবং পিছিয়ে থাকা শ্রেণীর মানুষই ছিলেন বেশি।

উচ্চবর্ণের জমিদার সম্প্রদায়ের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের খাতির থাকাই স্বাভাবিক। তাই কৃষকরা যখন বিদ্রোহ শুরু করেন ব্রিটিশদের সঙ্গেই তাদের রাগ গিয়ে পড়ে স্থানীয় হিন্দু উচ্চবর্ণের জমিদারদের ওপরেও।

মোপলা বা মালাবার বিদ্রোহের ওপরে পণ্ডিত বলে যাকে মানা হয়, সেই অধ্যাপক কে. এন. পানিক্কর বর্তমানে কেরালা কাউন্সিল ফল হিস্টোরিকাল রিসার্চের চেয়ারম্যান।

ওই বিদ্রোহ নিয়ে লেখা তার বই 'এগেইনস্ট লর্ড এন্ড স্টেট, রিলিজিয়ান এন্ড পেজ্যান্ট আপরাইসিংস ইন মালাবার' একটি আকর গ্রন্থ।

অধ্যাপক পানিক্ক বলছিলেন, "এটা মূলত একটা কৃষক বিদ্রোহ, যেটাকে ধর্মীয় রঙ দেওয়া হচ্ছে।‍"

কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আশরাফ কাডাক্কাল বলছিলেন যে মাস ছয়েক ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী মালাবার অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ প্রশাসনকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন, সেই সময়ে তিনি সেখানে মালয়লা নাদ প্রতিষ্ঠা করেন।

"মালয়লা নাদ কথাটার স্থানীয় অর্থ হল যারা মালায়লাম ভাষায় কথা বলেন, তাদের জায়গা। হাজি তো খিলাফত নাম দেন নি তার প্রশাসনের। তিনি নিজস্ব অর্থ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। শরিয়ত আইন বলবত করা কথা ভেবেছিলেন, সেটাও ওখানকার হিন্দু বাসিন্দাদের ওপরে বলবত হত না," বলছিলেন অধ্যাপক কাডাক্কাল।

স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ না নিলেই জুটত শাস্তি
ইতিহাস থেকে এটাও জানা যায়, কুঞ্জাহামেদ হাজী হিন্দু - মুসলমান ব্যতিরেকে যারাই স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিত না, তাদেরই শাস্তি দিতেন।

কিন্তু মোপলা বিদ্রোহ আদতে কৃষক বিদ্রোহ হলেও মূল লক্ষ্য কেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ছিল, সেটাই ব্যাখ্যা করছিলেন কালিকট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কে. এন. গণেশ।

অধ্যাপক গণেশ বলছিলেন, "প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সারা দেশেই বড় ধরণের অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, যা সরাসরি কৃষকদের প্রভাবিত করেছিল। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল সেই সময়ে।

'জালিয়ানওয়ালাবাগের জমায়েতটাও তো ছিল আদতে সেখানকার কৃষক-গ্রামীণ মানুষের অভাব অভিযোগের কারণেই' অধ্যাপক কে. এন .গণেশ

"অভাবের তাড়নায় পড়া গ্রামীণ মানুষরা সারা দেশেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন। সেই সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই এ ধরণের বিদ্রোহ গড়ে উঠেছিল - যেগুলোর অভিমুখ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই।

"জালিয়ানওয়ালাবাগের জমায়েতটাও তো ছিল আদতে সেখানকার কৃষক-গ্রামীণ মানুষের অভাব অভিযোগের কারণেই। একই ভাবে অযোধ্যা, অন্ধ্রতেও বিদ্রোহ হয়েছে। এই মোপলা বিদ্রোহও সেই একই সময়ের ঘটনা। এটাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে চলবে না। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন না বলা একেবারেই ঠিক নয়," বলছিলেন অধ্যাপক গণেশ।

মোপলা বিদ্রোহ নিয়ে কেন দ্বিমত
আরএসএস-পন্থী ঐতিহাসিকরা ওই বিদ্রোহকে ধর্মীয় দাঙ্গা হিসাবে দেখাতে চান আর অন্য এক অংশ ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম বলে মনে করেন।

বিজেপির এক নেতা রাম মাধব সম্প্রতি টুইট করেছেন যে মোপলা বিদ্রোহের মাধ্যমেই ভারতের মাটিতে প্রথমবারের মতো 'তালেবানি' চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আবার দ্বিতীয় অংশটি বলছে, আরএসএস যাকে দার্শনিক গুরু হিসাবে মানে, সেই বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে যদি স্বাধীনতা সংগ্রামী বলা যায়, তাহলে মোপলা বিদ্রোহীদের সেই সম্মান দেওয়া হবে না কেন।

কিন্তু তৃতীয় একটি অংশ আছেন ইতিহাসবিদদের মধ্যেই, যারা মনে করেন বিদ্রোহীদের মধ্যে, তাদের ভাষায় কিছুটা ধর্মীয় বাড়াবাড়ি হলেও মোপলা বিদ্রোহ ছিল আদতে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম।

খবরঃ বিবিসি

আমার সংবাদ/রা.হা