Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

একজন জাহিদ রহমানের ব্যারিস্টার হয়ে ওঠার গল্প

ওয়াহিদ তাওসিফ (মুছা)

অক্টোবর ২, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


একজন জাহিদ রহমানের ব্যারিস্টার হয়ে ওঠার গল্প

ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান। বর্তমানে কর্মরত আছেন নর্দামব্রিয়া (ইউকে)। ইট-পাথরে ঘেরা শ্বাসরুদ্ধ শহর ঢাকায় কেটেছে তার দুরন্ত শৈশব। প্রবল ইচ্ছা শক্তি, ধৈর্য আর অধ্যবসায় দিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন পেশাগত জীবনে। সম্প্রতি ব্যক্তিজীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা সহ আইন পেশার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক আমার সংবাদের সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওয়াহিদ তাওসিফ (মুছা) ।

আমার সংবাদ  - আপনার ছেলেবেলার গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই।

জাহিদ রহমান - ছেলে বেলায় অজস্র গল্প রয়েছে আমার। তবে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে বন্ধুদের সাথে কাটানো প্রিয় কিছু মুহূর্ত। দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় একদিন ক্লাস টিচার এক এক করে সবাইকে জিজ্ঞেস করছিলেন, তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে? সবাই যার যার বেস্ট ফ্রেন্ডের নাম বলছিল। আমাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে? আমিও আমার এক ফ্রেন্ডের নাম বললাম। আশ্চর্যজনকভাবে আমার সেই বন্ধুকে যখন একই প্রশ্ন করা হলো, সে আরেকজনের নাম বলল। সেই থেকে আজন্ম বুঝতে শেখার এক লড়াই। আসলে আমরা যেভাবে কল্পনা করি, পৃথিবীটা সেই ভাবে চলে না এই বিষয়টা খুব ছোটবেলা থেকেই বুঝতে শুরু করেছিলাম।

আমার সংবাদ  - কত রকমের পেশা আছে। আইন বিভাগ কেন বেছে নিলেন?

জাহিদ রহমান - একটা সময় ছিল যখন মানুষ বলতো আইন যে পড়বে সে হবে বটতলার উকিল। আইন পেশা বলতে অনেকেই মনে করেন, উকিল, বিচারক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক। তবে এই পেশার বিস্তৃতি আরো বেশি। যেমন আইন পড়ে রিসার্চার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। আর এই রিসার্চ যে শুধু আইনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়। সমাজবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, অর্থনীতি সবকিছুর সঙ্গেই আইন নিয়ে গবেষণা সম্ভব। এ কারণে আইনকে আন্তঃগবেষণা ক্ষেত্রও বলা যায়। আর ঠিক এই যায়গাটিই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে এই পেশায় আসতে। আইন পেশা শুধু আমার পেশাই নয় বরং নেশাও বলতে পারেন। সেই উপলব্ধি থেকেই আসলে এই পেশায় আসা।

আমার সংবাদ    - আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা কি ছিল?

জাহিদ রহমান - আমি মনে করি, ব্যক্তিজীবনে আমার সবথেকে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল "মানসিকভাবে আত্মনির্ভরশীল না হওয়া" যা আমাকে জীবনের একটা সময় পর্যন্ত আহত করেছে। মানসিকভাবে কারো উপর ডিপেন্ড করা পৃথিবীর সবথেকে বড় অসহায়ত্ব-দাসত্ব। এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে আপনার নিজেকে অবশ্যই মুক্ত হতে হবে। যা আপনাকে ডি-মোটিভেট করবে জীবনের এগিয়ে যাওয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে। এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়, কেন আপনি জীবনে অনেকদূর যেতে চান সেই কারণ পর্যন্ত খুঁজে পাবেন না। আমাদের ভালোলাগা খারাপ লাগার অনুভূতি এগুলো একান্তই আমাদের কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন আমাদের এই অনুভূতি গুলো অন্য কারো উপর নির্ভর করে৷ পরিচিত মানুষের অপরিচিত হয়ে ওঠা আসলেই যন্ত্রনার৷এ জগতে কারও উপর কখনই ডিপেনডেন্ট হবেন না। কোন‌ও কাজেই না, এমনকি ইমোশনালিও না। হলে, যদি কখনও তিনি ছেড়ে যান, কিংবা আপনাকেই ছেড়ে যেতে হয়, কিংবা সময় দূরত্বের সৃষ্টি করে কোনও-না-কোনও কারণে, কিংবা দু-জন একসঙ্গে থাকলেও ডিপেনডেন্সিটা আর রাখা যায় না, তখন দেখবেন, বাঁচতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বলতে পারেন, এইসব বলা সোজা, করা কঠিন। হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। সঙ্গে এ-ও ঠিক, কাজটা করতে এখন যতটা কষ্ট হবে, তখন করতে এর শত গুণ বেশি কষ্ট হবে। আগের কষ্ট পরের কষ্টের চাইতে সবসময়ই কম কষ্ট দেয়।

মনে রাখতে হবে, জীবনের অধিকাংশ সময় মানুষ অভিনয় করে বাঁচে৷ কেউ ভালবাসার, কেউ ভালো থাকার কেউ অন্তত বেঁচে থাকার৷ তাই নিজের জন্য বাঁচতে শিখুন৷

আমার সংবাদ    - কিভাবে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন?

জাহিদ রহমান - দেখুন সমস্যা পাশ কাটিয়ে গেলে কখনো সমস্যার সমাধান হয়না। সাময়িক স্বস্তি মিললেও দেখবেন সময়ের ব্যবধানে সেই সমস্যাটা আরও প্রকট আকার ধারণ করে আপনার সামনে আসবে। সাধারণত একটি সম্পর্ক থেকে বের হয়ে একাকীত্ব দূর করতে আমাদের অভ্যাস নতুন কারো সাথে মনের কষ্ট শেয়ার করা অথবা সম্পর্কে জড়ানোর। আর এই জিনিসটা স্থায়ীভাবে আমাদের মানসিকভাবে অন্যের উপর নির্ভর করার অভ্যাসে রূপান্তর করে। আর এটা যেকোন সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সম্পর্কটা হোক প্রেম, হোক বন্ধুত্ব বা হোক আত্মীয়তার। আমি মনে করি, অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হওয়াটাই যথেষ্ট নয়। আপনি নিজেকে তখনই আত্মনির্ভরশীল হিসেবে দাবি করতে পারবেন, যখন আপনি মানসিকভাবে নিজের উপর নির্ভরশীল। আপনার ভালোলাগা, খারাপ লাগা, ইচ্ছে, কৌতুহল শেয়ার করার জন্য বাধ্যতামূলক কাউকে লাগবে না। জীবনে চলার পথে যে-কোন‌ও পরিস্থিতি মেনে নেওয়া এবং নিজেকে সেই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা যার যত বেশি, সে তত বেশি সুখী এবং ঐশ্বর্যশালী। সবসময় আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু না-ও হতে পারে, কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য কখন‌ও বিফল হয় না।

আমার সংবাদ    - আপনার সফলতার আড়ালে নিশ্চয় হতাশার অনেক গল্প রয়েছে, সেগুলো জানতে চাই?

জাহিদ রহমান -  আমি বিশ্বাস করি, আমি এখনও সফল নই। সফলতার পথ আরো অনেক দূর। শিক্ষাজীবনের ডিগ্রী, পেশাগত জীবনের অবস্থান কখনোই একটি মানুষের সফলতার উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। আমার কাছে সফল তিনি, যিনি একটি সুন্দর পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। যখন তাঁর সামাজিক সম্মানে সম্মানিত হয় তার পুরো পরিবার, যখন তাঁর অর্জনে গর্বিত হয় তার পরিবারের প্রতিটি সদস্য। সফলতা সেখানেই অনুভূত হয়। আমার ব্যক্তি মতাদর্শ অনুযায়ী, যে অর্জন আপনার পারিবারিক দায়িত্ববোধ ভুলিয়ে দেয়, আপনাকে সমাজ সংসার থেকে বিচ্যুত করে আত্মকেন্দ্রিক হিসেবে গড়ে তোলে, তা কোন সফল অর্জন নয়। আমি মনে করি, পরিবার হচ্ছে সবথেকে বড় সফলতার পরিচায়ক। যেখানে শত ক্লান্তির ফাঁকে আপনি পেতে পারেন এক ফোঁটা স্বস্তি। যেখানে থাকতে পারে শুধুই আপনার নিজস্বতা। এই জায়গাটিতে আপনার কোন ফরমালিটি মেইনটেইন করতে হবে না। মোটা কোর্টের নিচে শরীর বা মনের ক্ষত ঢেকে রাখতে হবে না। চশমার পেছনের ঝাপসা দৃষ্টিও আপনাকে রঙিন আলো থেকে বঞ্চিত করবে না।

আমার সংবাদ  - পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে? কাকে বেশি মনে পড়ে?

জাহিদ রহমান - অনুপ্রেরণাগুলো সত্যিই পর্দার আড়াল থেকে আসে। কিছু অনুপ্রেরণা আঘাতের মধ্য দিয়ে আসে, আর কিছু অনুপ্রেরণা আসে কারও ভালোবাসা আর উচ্ছ্বাসিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ থেকে। আঘাতের দ্বারা প্রাপ্ত অনুপ্রেরণাগুলো পেশাজীবনে হয়তো অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় মানুষকে, কিন্তু ভালোবাসায় অনুপ্রেরণা যুগিয়ে কিছু মানুষ সেই আঘাতের ক্ষত গুলোও শুকিয়ে দেয়। নাম প্রকাশের অনুমতি  না থাকলেও আমি জানি, এই সাক্ষাৎকার সবার আগে সেই ভালোবাসায় অনুপ্রেরণা যোগানো মানুষগুলোই পড়বে। তাই ক্ষত যেহেতু শুকিয়েই গেছে, আমার মন থেকেও মুছে গেছে আঘাত দেয়া মানুষগুলোর নাম, সব ঘোলাটে স্মৃতি।

আমাদের চারপাশে ত কত কিছুই ঘটে, কেউ ঘুরে দাড়ায়, কেউ শক্ত করে সকল বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেও পাশে থাকে। আমরা কি তার সব কিছু জানি? থাকুক না এমন অজানা কিছু। কি লাভ বিষাদ বাড়িয়ে!

আমার সংবাদ -যারা আইন বিভাগে পড়তে চায় তাদের জন্য আপনার কি পরামর্শ থাকবে?

জাহিদ রহমান -  আইনপাঠ সবার জন্য জরুরি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়বেন ক্যারিয়ার গড়ার উদ্দেশ্যে।  এ ক্ষেত্রে গবেষণার প্রবৃত্তি যাদের আছে তারা অন্যতম। তবে একজন ছাত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার যা আইন পড়তে সাহায্য করবে। গভীরভাবে চিন্তা করতে পারা তার মধ্যে অন্যতম। আইন কখনোই মুখস্থের বিষয় নয়। অনেকের ভুল ধারণা যে আইনের ধারা জানা মানেই আইন জানা। যা মোটেও সত্য নয়। আইন পড়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে একটা বিষয়কে বিশ্লেষণ করতে পারা। গভীর চিন্তাশক্তি এ ক্ষেত্রে খুব জরুরি। আর গুছিয়ে উপস্থাপন করার দক্ষতাও পেশাগত ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে অনেকদূর। আইন আজীবন চর্চার একটি পেশা। অনেক ধৈর্য নিয়ে লেগে থাকতে হয়। যারা এটা করতে পারবে তারাই এ প্রফেশনে সফল হবে। অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে হতাশ হয়ে পড়েন। কারণ, এ পেশায় নিজেকে দাঁড় করাতে একটু সময়ের প্রয়োজন হয়। আর আমাদের দেশে ব্রিটিশ স্কুল অফ ল, লন্ডন কলেজ অফ লিগ্যাল স্টাডিজ, ভূঁইয়া একাডেমি, নিউ ক্যাসেল ল একাডেমি এই চারটি ইন্সটিটিউট বার-অ্যাট-ল পড়ালেখার বিষয়ে সহযোগিতা করে থাকে।

আমার সংবাদ  

আমাদের সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ।

জাহিদ রহমান- আপনাদের জন্য অফুরান ভালোবাসা।  আমার সংবাদের জন্য নিরন্তর শুভকামনা।

আমারসংবাদ/এডি