Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

সমস্যাজর্জরিত বরিশাল বিমানবন্দর

জহির খান, বরিশাল

সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


সমস্যাজর্জরিত বরিশাল বিমানবন্দর

ঢাকা-বরিশাল আকাশপথে প্রতিদিন সাত থেকে আটটি ফ্লাইট চলাচল করলেও বরিশাল বিমানবন্দরের উন্নয়ন-সম্প্রসারণ কিংবা আধুনিকীকরণসহ সবকিছুই রহস্যজনক কারণে থমকে রয়েছে। বিমানে ওঠানামা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই যাত্রীদের নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দীর্ঘ ৩৬ বছরেও পূর্ণতা পায়নি দক্ষিণাঞ্চলবাসীর একমাত্র এই বিমানবন্দর।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট রানওয়ের বিমানবন্দর হলো বরিশাল বিমানবন্দর। এখানে রানওয়ের দৈর্ঘ্য মাত্র ছয় হাজার ফুট। এত ছোট রানওয়েতে অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানের উড্ডয়ন-অবতরণে সমস্যা হয়। এখানে বড় বিমানের ওঠানামা প্রায় অসম্ভব।

২০০৭ সালে সিডরের তাণ্ডবে দক্ষিণ উপকূল বিধ্বস্ত হলে ছোট রানওয়ের জটিলতা বড় হয়ে দেখা দেয়। সে সময় ত্রাণ পরিবহনের কাজে বিমানবন্দরটি ব্যবহূত হলেও রানওয়ে ছোট হওয়ায় বিদেশি অনেক বিমান এখানে নামতে পারেনি। ফলে ঢাকায় ত্রাণ নামিয়ে তা দক্ষিণাঞ্চলে পাঠাতে হয়েছে।

বিমানবন্দরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিমানবন্দরে ১২২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ থাকলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬২ জন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন ভবনগুলোর অবস্থাও করুণ। নতুন ভবন নির্মাণ করা হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়নি। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বেষ্টনীর অনেকটা অংশ ভাঙা। কেবল জীবজন্তুই নয়, মানুষও ঢুকে পড়ে রানওয়েতে।

সম্প্রতি ইউএস-বাংলার একটি বিমান রানওয়েতে নামতে না পেরে বেশ কিছুক্ষণ আকাশে চক্কর কাটতে হয়। সে সময় রানওয়েতে একটি কুকুর ঢুকে পড়েছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানবন্দরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের কারণে যাত্রীদের ভিড় সামলাতে আমাদের প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক সময় যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করা রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়ে। এখানে বিমানে ওঠানামার সব সুবিধা অনুপস্থিত। রানওয়ে এত ছোট যে পাশাপাশি দুটি বিমানের অবস্থান করতেও অসুবিধা হচ্ছে। এখানকার অ্যাপ্রোনের আকার ২০০ ফুট প্রস্থ ও ২৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের।

সূত্র মতে, ১৯৯১ সালে নেয়া প্রকল্পের আওতায় নির্মিত টার্মিনাল ভবনের ব্যবহার ১৯৯৫ সালে শুরু হয়। তখন এ বন্দর দিয়ে সপ্তাহে মাত্র দুইদিন বিমান চলাচল করতো। তখনকার তুলনায় বর্তমানে প্রায় ২০ গুণ বেশি যাত্রী চলাচল করলেও টার্মিনালের আয়তন আর বাড়েনি। এমনকি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাটিও তার ধারণক্ষমতা হারিয়েছে বহু বছর আগে।

এখানে বিমান ওঠানামায় ব্যবহূত ল্যান্ডিং ইকুইপমেন্টও আধুনিক নয় জানিয়ে বিমানের একজন পাইলট বলেন, আইএলএস থাকলে শীত মৌসুমে ঘন কুয়াশা কিংবা পাইলট অসুস্থবোধ করলেও অটো পাইলটে খুব সহজে বিমান অবতরণ করতে পারে। দেশের যেসব বিমানবন্দরে এখনো আইএলএস নেই, সেখানে অন্তত ডিভি ওয়্যার আছে। এ সিস্টেমেও বিমান উড্ডয়ন কিংবা অবতরণে খুব একটা সমস্যা হয় না। বরিশাল বিমানবন্দরে যে সিস্টেম রয়েছে তা পুরোনো হওয়ায় অনেক সময় উড্ডয়ন ও অবতরণে মানসিক চাপে পড়তে হচ্ছে।

বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের প্রায় সব বিমানবন্দরে বর্তমানে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এসব কাজে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। অথচ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বরিশাল বিমানবন্দর মেরামত ও সংস্কারের জন্য কিছু টাকা দেয়া হয়েছিল। এরপর আর কোনো বরাদ্দ আসেনি।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, আইএলএস সিস্টেম বাংলাদেশের কোনো বিমানবন্দরে নেই। এছাড়া বরিশাল বিমানবন্দরে বর্তমানে যে সিস্টেম রয়েছে, একে খুব বেশি পুরোনো বলা যাবে না। আমরা বর্তমানে সেখানে পারফরম্যান্স বেইজড ল্যান্ডিং সিস্টেম চালু করেছি। এটা যথেষ্ট আধুনিক। এ সিস্টেমে উড্ডয়ন ও অবতরণে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

সিভিল এভিয়েশনের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইটিএও) নীতিমালা অনুযায়ী যেকোনো বিমানবন্দরে রানওয়ের কেন্দ্র থেকে দুইদিকে কমপক্ষে ৫০০ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা থাকতে পারবে না। কিন্তু এখানে ২০০ ফুটের মধ্যে নিরাপত্তাবেষ্টনী রয়েছে। এছাড়া ১৬০ একর জমির ওপর নির্মিত বিমানবন্দরটি নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তাদের (আইটিএও) সুপারিশ অনুযায়ী রানওয়ে সম্প্রসারণসহ অবকাঠামোগত ঝুঁকি দূর করতে এর আয়তন ৩২৫ একর বাড়াতে হবে।

বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান আতিক আমার সংবাদকে বলেন, নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় দক্ষিণাঞ্চলের এই বিমানবন্দরটি একেবারেই অরক্ষিত। চারপাশে সীমানা প্রাচীর থাকলেও কয়েকস্থানে ভেঙে গেছে। আবার বেশ কিছুস্থানে প্রাচীরের নিচে মাটি না থাকায় ফাঁকা স্থান দিয়ে হুটহাট লোকজন ঢুকে পড়ছে রানওয়েতে। এ অবস্থায় বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিশেষ করে বন্দরের রহমতপুর থেকে বাবুগঞ্জ যাওয়ার সড়কের অংশে নিরাপত্তা প্রাচীর খুবই অরক্ষিত। সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার এমন অভাব সত্ত্বেও বরিশাল বিমানবন্দরে প্রতিনিয়ত যাত্রী ও ফ্লাইট সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ এলাকা দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় প্রতিবছর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। এরকম ক্ষেত্রে জরুরি সহায়তার বিষয়টি মাথায় রেখে হলেও দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র বিমানবন্দরটির রানওয়ে বড় করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, এখানে যে টার্মিনাল ভবন রয়েছে, সেটিও বেশ পুরোনো। দৈনিক সাত থেকে আটটি ফ্লাইটে আসা-যাওয়া করা যাত্রীদের জন্যও এটি অপ্রতুল। তাই তিনি দক্ষিণাঞ্চলবাসীর একমাত্র বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধির জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিমানবন্দরের উন্নয়ন-সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছেন।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন বলেন, বরিশাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণসহ আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত জরিপ হলেও করোনার কারণে কাজে কিছুটা ধীরগতি তৈরি হয়েছে। এছাড়া সিভিল এভিয়েশনে খুব শিগগিরই দেড় হাজারের বেশি লোক নিয়োগ দেয়া হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৬৩ সালে আকাশ থেকে শস্য ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানোর কাজে ব্যবহারের জন্য বরিশাল নগরী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নে ‘প্ল্যান্ট প্রোটেকশন’ বন্দর হিসেবে দুই হাজার ফুট রানওয়ে নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৮৫ সালে এটিকে বিমানবন্দরে রূপান্তর করা হয়। এরপর ১৯৯৫ সালের ১৭ জুলাই থেকে দিনের বেলা ঢাকা-বরিশাল রুটে বাণিজ্যিক বিমান চলাচল শুরু হয়।