Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

থাইরয়েড

নভেম্বর ৯, ২০১৯, ০৪:০০ এএম


থাইরয়েড

থাইরয়েড একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি, অবস্থান গলার নিচের দিকে। এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন থাইরক্সিন এবং ট্রাই আয়োডো থাইরোনিন রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।দেহের প্রায় প্রতিটি সিস্টেমের স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্য এই হরমোনের প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবেই এই হরমোনের মাত্রার হেরফের হলে শরীরের প্রায় সব কটি সিস্টেমের ওপরই প্রভাব পড়ে। থাইরয়েড হরমোনের মূল উপাদান আয়োডিন।

তাই দৈনন্দিন খাবারে আয়োডিনের ঘাটতি থাকলে এ হরমোন ব্যাহত হয়। প্রতিদিনের খাবারে যদি ২০ মাইক্রোগ্রামের কম আয়োডিন থাকে তাহলে থাইরয়েড হরমোনের নানা সমস্যা দেখা দেয়। আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েডের মূলত যেসব সমস্যা দেখা দেয় তার মধ্যে প্রধান গলগণ্ড বা গয়টার। বর্তমানে পৃথিবীতে থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক। আমরা অনেকে এই রোগের নাম শুনলেও বা আশেপাশে আক্রান্ত রোগী দেখলে কিংবা নিজে আক্রান্ত হলেও আমরা এই রোগ সম্পর্কে অনেকেই খুব একটা জানি না।

থাইরয়েড হলো আমাদের একটি গ্রন্থি যা আমাদের গলার সামনের দিকে অবস্থিত। এই গ্রন্থি থেকে কিছু প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন আমাদের বিপাকসহ আরো বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই হরমোন তৈরির জন্য এই গ্রন্থিটির প্রয়োজনীয় পরমাণে আয়োডিনের দরকার হয়। ওই হরমোন আমাদের বিপাক ক্রিয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েড গ্রন্থি সাধারণত দুই ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে।

ট্রাই-আয়োডোথাইরোনিন (টি-৩) : থাইরক্সিন(টি-৪)— বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জন্মের সময় এই গ্রন্থি ঠিকভাবে তৈরি না হলে কিংবা প্রয়োজন মতো হরমোন তৈরি করতে না পারলে বাচ্চাদের শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আমাদের শরীরে যতটুকু হরমোন প্রয়োজন তার চেয়ে কম কিংবা বেশি পরিমাণে এই হরমোন তৈরি হলে তখন নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে এই হরমোন তৈরি হলে হাইপোথাইরয়ডিজম হতে পারে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে এই হরমোন উৎপন্ন হলে হাইপারথাইরয়ডিজম হতে পারে। উভয়ই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

গ্রন্থিতে  বিভিন্ন রকমের রোগ হতে পারে :  হাইপোথাইরয়ডিজম, হাইপারথাইরয়ডিজম, গয়টার, নডিউল, থাইরয়েড ক্যান্সার, গ্রেভস ডিজিজ।

হাইপোথাইরয়ডিজম : থাইরয়েড গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় কম হরমোন উৎপাদন করে তখন হাইপোথাইরয়ডিজম হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদিও অনেক সময় এর চোখে পড়ার মতো লক্ষণ দেখা যায় না, যার ফলে অনেকে বুঝতেই পারেন না তারা হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত। হাইপোথাইরয়ডিজম হলে সাধারণত যে লক্ষণগুলো— ক্লান্তি কিংবা অবসাদ অনুভব করা কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা। শুষ্ক ত্বক, কোষ্ঠকাঠিন্য, অল্পতেই শীত শীত লাগবে। পেশি এবং বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যাথা অনুভূত হবে, বিষন্নতা থাকবে, মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের সময় অতিরিক্ত পরিমাণ রক্তক্ষরণ হতে পারে, পালস রেট কম থাকতে পারে স্বাভাবিকের তুলনায়।

হাইপারথাইরয়ডিজম : এক্ষেত্রে হাইপারথাইরয়ডিজমের উল্টো ঘটনা ঘটে। থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হরমোন উৎপাদন করলে হাইপারথাইরয়ডিজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। থাইরয়েড গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি নামক এক গ্রন্থি। মস্তিষ্কের এই পিটুইটারি গ্রন্থিকে আবার নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক অংশ। এই হাইপোথ্যালামাস থাইরয়েড রিলিজিং হরমোন(টিআরএস ) নামক এক হরমোন নির্গত করে। এই টিআরএস হরমোনের কাজ হলো পিটুইটারি গ্রন্থিকে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন (টিএসএইচ) নামক এক হরমোন নির্গত করার জন্য সংকেত পাঠানো। এই হরমোন ওই গ্রন্থিকে থাইরয়েড হরমোন নির্গত করার জন্য সংকেত পাঠায়। বোঝা গেল, তাহলে এই হরমোন উৎপাদন এর জন্য শুধু থাইরয়েড গ্রন্থি দায়ী নয়। হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি গ্রন্থি এবং থাইরয়েড গ্রন্থির মিলিত প্রচেষ্টায় হরমোন নির্গমণ কাজ সম্পন্ন হয়। এখন ওই তিনটি গ্রন্থির যেকোনো একটি বা একাধিক গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাজ করে ফেলে তখন ফলাফল হিসেবে যতটুকু হরমোন দরকার তার চেয়ে বেশি পরিমাণ হরমোন উৎপন্ন হয়। আর তখনই  বাঁধে সমস্যা। যেটা হাইপারথাইরয়ডিজম নামে পরিচিত।

হাইপারথাইরয়ডিজম হলে সাধারণত লক্ষণগুলো : অতিরিক্ত ঘাম, গরম সহ্য না করতে পারা, হজমে সমস্যা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বেড়ে যাওয়া, অস্থিরতা অনুভব করা, ওজন কমে যাওয়া, পালস রেট বেড়ে যাওয়া, ঠিকমতো ঘুম না হওয়া, চুল পাতলা এবং ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া ত্বক পাতলা হয়ে যাওয়া, মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব অনিয়মত কিংবা খুব অল্প পরিমাণে হওয়া, বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে হূদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে। খুব খারাপ অবস্থা হলে এবং হাইপারথাইরয়ডিজম এর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না নেয়া হলে থাইরয়েড স্টর্ম হতে পারে। এতে রোগীর রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে, জ্বর আসতে পারে এবং হূদস্পন্দন বন্ধ ও হয়ে যেতে পারে।

গয়টার : থাইরয়েড গ্রন্থিটিই বড় হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একে গয়েটার বা গলগণ্ড বলা হয়ে থাকে। যেহেতু গ্রন্থিটি হরমোন তৈরির জন্য আয়োডিনের প্রয়োজন পড়ে। সেহেতু আয়োডিনের অভাব হলে গ্রন্থিটি হরমোন তৈরি করতে পারে না ঠিকভাবে। তবুও এটি চেষ্টা করে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরি করতে। ফলে এটি নিজে বড় হয়ে যায় শরীরের হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে এবং একটা সময় এটি আর পারে না সেই স্বাভাবিক মাত্রায় হরমোন তৈরি করতে। ফলে হরমোনের পরিমাণ কমে যায় প্রয়োজনের তুলনায় এবং ফলাফল হিসেবে ওই ব্যক্তি হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত হয়। এ জন্য যেসব শিশু বা মানুষ আয়োডিনের স্বল্পতায় ভুগে তাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে বর্তমানে লবণের সাথে আয়োডিন গ্রহণের ফলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকাংশেই কমে এসেছে। গলগণ্ড বা গয়েটার নডিউল এ ছাড়া এই গ্রন্থিতে টিউমার ও হতে পারে। যাকে নডিউল বলে। এক্ষেত্রে এই টিউমার সংখ্যায় এক বা একাধিক হতে পারে। এবং বিভিন্ন আকারের হতে পারে। তবে টিউমার হলেই সবক্ষেত্রে ক্যান্সার হয়না। অবস্থা বেশি খারাপ হলে এবং কোনো চিকিৎসা না নেয়া হলে এটি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। যাকে বলা হয় থাইরয়েড ক্যান্সার।

হোমিও সমাধান : রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়, এজন্য  চিকিৎসকে সঠিক সময় রোগ নির্ণয় এবং রোগের যথোপযুক্ত চিকিৎসা দিতে পারলে থাইরয়েডের সমস্যা থেকে নিরাময় হওয়া হোমিওতে সম্ভব, আর শরীরে আয়োডিনের অভাবজনিত কারণে যে গলগণ্ড হয় তা অনেকটাই প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে খাদ্যে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারের ফলে। উন্নত দেশে শিশুর জন্মেও সঙ্গে সঙ্গে থাইরয়েডের রক্ত পরীক্ষা প্রচলন আছে। একে ইউনিভার্সাল নিওনেটাল স্ক্রিনিং বলে। দুর্ভাগ্যবশত ভারতে এই রক্ত পরীক্ষাটি এখনো বাধ্যতামূলক নয়। থাইরয়েডের অসুখ এমন একটা সমস্যা যার রোগ নির্ণয় অত্যন্ত সহজ এবং চিকিৎসা অত্যন্ত সুলভ, সহজ ও ফলপ্রসূ। থাইরয়েডের ক্যান্সারও এমন ধরনের ক্যান্সার যা ঠিক সময়ে ধরা পড়লে এবং সঠিক চিকিৎসা হলে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।

হামিও মেডিসিন : হোমিওপ্যাথিতে থাইরয়েডের চিকিৎসায় থাইরয়েডিনাম ছাড়াও আয়োডিন, নেট্রাম মিউর, লাইকোপিডিয়াম, সাইলেসিয়া, ফিডোরিনাম, থুজা, মেডোরিনামসহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের ওপর আসতে পারে তবে কখনোই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না। কারণ চিকিৎসক তার অভিজ্ঞতার আলোকে ওষুধ নির্বাচন করে থাকেন যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতির সম্ভবনা প্রবল থাকে।
 
লেখক : ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ (কো-চেয়ারম্যান, হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র)