Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

বস যখন নিজের বেতন মিলিয়ন ডলার কমিয়ে দিলেন

আমার সংবাদ ডেস্ক

মার্চ ৩, ২০২০, ০৪:১২ এএম


বস যখন নিজের বেতন মিলিয়ন ডলার কমিয়ে দিলেন

২০১৫ সালে সিয়াটলের এক কার্ড পেমেন্ট কোম্পানির বস নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন বেতন কাঠামো চালু করেন। কোম্পানির প্রধানসহ ১২০জন কর্মীর সবার জন্য নূন্যতম বেতন ৭০ হাজার মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে দেন, এবং তার নিজের বেতন এক মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১০ লক্ষ ডলার কমিয়ে দেন।

পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে সেই ঘটনার পর, এখনো তিনি ঐ একই বেতন পাচ্ছেন এবং জানিয়েছেন যে উদ্দেশ্যে তিনি এ নিয়ম চালু করেছিলেন সে উদ্দেশ্য বিফলে যায়নি।

ড্যান প্রাইস একদিন বন্ধু ভ্যালেরির সঙ্গে পাহাড়ে হাইকিং করতে গিয়ে এক অস্বস্তিকর সত্য বুঝতে পারেন।

হাটতে হাটতে ভ্যালেরি বলছিলেন, তার বাড়িওয়ালা হঠাৎই ২০০ ডলার বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে, আর তার ফলে ভ্যালেরির সবকিছুর খরচ বেড়ে গেছে। শুনে প্রাইসের রাগ হলো।

প্রাইসের তৎকালীন বান্ধবী ভ্যালেরি ১১ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন, এর মধ্যে দুই দফা ইরাকে কাজ করেছেন।

এখন দুইটি প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে ৫০ ঘণ্টা করে কাজ করেন, তবু সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন ভ্যালেরি।

প্রাইস বলেন, "ও ছিল এমন একজন যে নিজেকে কাজ, সম্মান আর কঠোর পরিশ্রম এসব দিয়ে একজন মানুষকে বিচার করে।"

যদিও সেসময় ভ্যালেরি বছরে ৪০ হাজার ডলারের মত রোজগার করতো, কিন্তু সিয়াটলে ভদ্রস্থ একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার জন্য সে রোজগার একেবারে যথেষ্ঠ ছিল না।

পৃথিবীর মানুষে মানুষে অসমতার বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রাইসের তখন ভীষণ রাগ লাগছিল। আর তক্ষুনি হঠাৎ তার মনে হয়েছিল সে নিজেও ওই অসমতার অংশ।

৩১ বছর বয়সেই প্রাইস তখন একজন মিলিয়নিয়ার। কৈশোরে বানানো তার কোম্পানি গ্র্যাভিটি পেমেন্টসের তখন প্রায় দুই হাজার গ্রাহক এবং প্রতিষ্ঠানের মূলধনের পরিমাণ কয়েক মিলিয়ন ডলার।

প্রাইস যদিও নিজে বছরে এক মিলিয়ন ডলার রোজগার করত, ভ্যালেরি তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে তার নিজের প্রতিষ্ঠানের অন্য কর্মীদের অনেকেই হয়ত অর্থাভাবে কষ্ট করছেন। সেই মুহূর্তে প্রাইস অবস্থা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন।

আইডাহোর গ্রামাঞ্চলে এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রাইস নম্র, ভদ্র এবং কর্মীদের প্রতি সদয় একজন মানুষ। ক্রমে তিনি মার্কিন সমাজে অর্থনৈতিক অসমতার বিরুদ্ধে হয়ে উঠলেন একজন যোদ্ধা।

"কারো চাকরী চলে যাচ্ছে, কেউ খালি পেটে ঘুমাতে যাচ্ছে কিংবা কেউ অন্যের কাছ থেকে বেআইনি সুবিধা নিচ্ছে, শুধুমাত্র যাতে আরেকজন নিউইয়র্কে বিশাল কোন টাওয়ারে আরেকটা তলা বাড়াতে পারে কিংবা সোনার চেয়ারে বসতে পারে।"

"মানুষের লোভকে নানান নাম দিয়ে আমরা মহিমা-মণ্ডিত করে তুলে ধরি। এর সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ হচ্ছে ফোর্বস ম্যাগাজিনের করা ধনীদের তালিকা। অর্থবিত্তে বিল গেটস জেফ বেজোসকে ছাড়িয়ে গেছে---তাতে কার কী এসে যায়?!"

১৯৯৫ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্ধেক মানুষ মিলে দেশটির এক শতাংশ ধনী মানুষের চেয়ে বেশি রোজগার করতেন।

কিন্তু ওই বছর প্রথমবারের মত দেখা যায়, এক শতাংশ ধনীরা দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের চেয়ে বেশি আয় করেন। কিন্তু এর পর থেকে সেই বিভাজন বেড়েই চলেছে।

১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সিইও অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা একজন সাধারণ শ্রমিকের চেয়ে ২০ গুণ বেশি বেতন পেতেন।

কিন্তু ২০১৫ সালের মধ্যে পরিস্থিতি এতটাই পাল্টে গেছে যে এখন সাধারণ শ্রমিকের তুলনায় অন্তত ৩০০গুণ বেশি বেতন পান একজন শ্রমিক।

ব্রিটেনের প্রধান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শীর্ষ ১০০ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা এখন গড়ে শ্রমিকদের তুলনায় ১১৭ গুণ বেশি বেতন পান।

পাহাড়ে বসে মাথায় নতুন 'আইডিয়া'
ভ্যালেরির সাথে পাহাড় চূড়ায় বসে প্রাইসের মাথায় এক দারুণ আইডিয়া এলো।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেমান এবং অ্যাঙ্গাস ডিটনের করা এক গবেষণার শিরোনাম ছিলো 'একজন অ্যামেরিকান নাগরিকের সুখী হবার জন্য কত টাকা প্রয়োজন'—সেটা পড়া ছিলো প্রাইসের।

তৎক্ষণাৎ তিনি ভ্যালেরিকে প্রতিশ্রুতি দেন, নিজের প্রতিষ্ঠানে তিনি বেতন বৈষম্য কমাবেন, এবং গ্র্যাভিটির কর্মীদের নূন্যতম বেতন বাড়াবেন।

হিসেব-নিকেশ করে প্রাইস যে অঙ্কে পৌঁছুলেন, সেটা ছিল ৭০ হাজার ডলার।

দেখা গেল সেজন্য কেবল নিজের বেতন কমালেই হচ্ছে না, সঙ্গে নিজের দুইটি বাড়ি বন্ধক রাখতে হচ্ছে, পুঁজিবাজারে তার সব শেয়ার এবং নিজের সঞ্চিত সব অর্থ কোম্পানিতে ঢালতে হচ্ছে।

একদিন সব কর্মীকে ডেকে তিনি নিজের পরিকল্পনা জানালেন। প্রাইস আশা করেছিলেন, সবাই খুশী হবে।

কিন্তু প্রথম ঘোষণার পর দেখা গেল, ঘটনা উল্টো ঘটছে। ঘটনা পুরোপুরি সবাইকে বোঝানোর জন্য কয়েকবার বিষয়টি খোলাসা করতে হয়েছিল তাকে।

পাঁচ বছর পর ড্যান বলছেন, তিনি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদের গবেষণার একটি মূল ব্যাপার ভুলে গিয়েছিলেন। গবেষণার ফলে দেখানো হয়েছিল, সুখী হবার জন্য ৭৫ হাজার ডলার দরকার ছিলো সবার।

কিন্তু তারপরেও নতুন নিয়মে প্রতিষ্ঠানের এক তৃতীয়াংশ লোকের বেতন এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল।

গ্র্যাভিটি বদলে যায় এরপর
নতুন নিয়ম চালুর পর গ্র্যাভিটি আমূল বদলে যায়। লোকবল দ্বিগুণ হয়েছে গত পাঁচবছরে, এবং প্রতিষ্ঠানের আয়ের পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে এক হাজার কোটি ডলারের ওপরে উঠেছে। কিন্তু এসব আর্থিক হিসাবের বাইরেও পরিবর্তন হয়েছে।

প্রাইস বলেন, "নতুন নিয়ম চালুর আগে বছরে কর্মীদের গড়ে বাচ্চা নেয়ার হার ছিল শূন্য থেকে দুইজন। কিন্তু গত সাড়ে বছরে আমাদের কোম্পানির কর্মীদের ৪০ টির বেশি শিশু জন্ম নিয়েছে।"

প্রতিষ্ঠানের ১০ শতাংশের বেশি কর্মী যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ব্যয়বহুল শহরে নিজেরা বাড়ি কিনেছেন। পুরনো নিয়মে এ হার ছিল এক শতাংশের কম।

নিজেদের পেনশন ফান্ডে কর্মীদের রাখা সঞ্চয়ের হার দ্বিগুণের বেশি হয়েছে, এবং ৭০ শতাংশের বেশি কর্মী নিজেদের ব্যক্তিগত ঋণ শোধ করেছেন এই সময়ের মধ্যে।

সমালোচনা
কিন্তু এসব অগ্রগতির পরেও প্রাইসকে বহু সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।

তার সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়ে শত শত লোকের লেখা চিঠি পেয়েছেন প্রাইস, 'অ্যামেরিকার সেরা বস' আখ্যা দিয়ে বহু ম্যাগাজিন তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছে।

তবে, গ্র্যাভিটির অনেক গ্রাহক হাতে লেখা চিঠি পাঠিয়ে প্রাইসের উদ্যোগকে 'রাজনৈতিক পদক্ষেপ' বলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

ঐ সময়ে সিয়াটলে নূন্যতম মজুরী ১৫ ডলার করা নিয়ে বিতর্ক চলছিল, বলা হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রে সেটাই হবে সবোর্চ্চ নূন্যতম মজুরী। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীরা তাতে রাজি হচ্ছিল না, তাদের দাবি এর ফলে তারা ব্যবসা হারাবেন।

প্রাইসের প্রিয় রেডিও প্রেজেন্টার ও ডানপন্থী রাজনীতি বিশ্লেষক রাশ লিমবাগ, ছোটবেলায় রোজ যার অনুষ্ঠান মন দিয়ে শুনতেন, তিনি তাকে 'কম্যুনিস্ট' আখ্যা দেন, এবং ভবিষ্যৎ বাণী করেন যে প্রাইসের প্রকল্প ব্যর্থ হবে।

গ্র্যাভিটির দুইজন সিনিয়র কর্মীও পদত্যাগ করেন। জুনিয়র কর্মীদের বেতন রাতারাতি বেড়ে যাওয়া তারা মেনে নিতে পারেননি, তাদের বক্তব্য ছিল এর ফলে কর্মীরা অলস হয়ে পড়বে এবং কোম্পানি ক্রমে অলাভজনক হয়ে যাবে।

কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি
রোজিটা বার্লো গ্র্যাভিটির বিপণন বিভাগের পরিচালক, তিনি বলছেন, বেতন বাড়ার পর থেকে জুনিয়র কর্মীদের মধ্যে উদ্যম বহুগুণ বেড়েছে।

সিনিয়র কর্মীদের কাজের ভার কমেছে, কাজের চাপ অনেক কমেছে, এবং তারা এখন বছরের সব ছুটি কাটিয়ে ফেলার সাহস করতে পারেন।

প্রাইস একজন কর্মীর গল্প বলছিলেন, যিনি রোজ দেড় ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে অফিসে আসতেন, কিন্তু তার গাড়ির টায়ার ফেটে যেতে পারে এই আশংকায় মানসিক চাপে ভুগতেন, আবার দুর্বল টায়ার বদলে ফেলার মত যথেষ্ট টাকাকড়িও ছিল না তার।

"কিন্তু নতুন নিয়মে যখন তার বেতন বাড়লো, এরপর সে অফিসের কাছে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। এখন সে নিজের স্বাস্থ্যের যত্নে অনেক বেশি খরচ করে, রোজ ব্যয়াম করে এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খায়।"

প্রাইস বলছেন, এমন আরো অনেক উদাহরণ আছে।

"বেতন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন কর্মীদের স্বাধীনতা অনেক বেড়ে গেল, আর এ কারণেই গ্র্যাভিটি এত ভালো করেছে। কারণ টাকাকড়ি নিয়ে অনিশ্চয়তা না থাকলে লোকের কঠোর পরিশ্রম করার সামর্থ্য বাড়ে।"

এত উদার ছিলেন না প্রাইস
বার্লো বলছেন প্রাইস এত উদার ছিলো না আগে। ২০০৮ সালে যখন বৈশ্বিক মন্দা শুরু হল, তখন প্রাইস টাকাকড়ি সঞ্চয় করতে চাইত।

সে সময় গ্র্যাভিটির রোজগার ২০ শতাংশের বেশি কমে গিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানের ৩৫জন কর্মীর মধ্যে ১২জনকেই ছাটাই করা হয়েছিল।

যদিও কয়েক মাস পরেই আবার লাভের মুখ দেখতে শুরু করে গ্র্যাভিটি, কিন্তু প্রাইস তখনো খরচ বাঁচাতে কম বেতন দিতেন।

বার্লো নিজে বাড়তি রোজগারের জন্য নিয়মিত অফিসের পর ম্যাকডোনাল্ডসে কাজ করতেন।

কিন্তু পরে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাবার পর প্রাইস তার বেতন বাড়িয়ে ৪০ হাজার ডলার করে দেন। কিন্তু মূল পরিবর্তন আনার জন্য প্রাইসের আরো কয়েক বছর লেগেছিল।

"অনেকেই সমস্যা সমাধানের জন্য আমার কাছে আসতো না, বলতো না কম বেতনের জন্য কত সমস্যায় রয়েছে তারা।"

তবে ২০১৫ সালের আগেই গ্র্যাভিটি কর্মীদের ২০ শতাংশ বেতন বাড়িয়েছিল, কিন্তু ভ্যালেরির সাথে পাহাড় চূড়ায় সেই কথোপকথনের আগ পর্যন্ত তিনি সাধারণ ভাবনা চিন্তাই করছিলেন।

প্রাইসের উদ্যোগে উৎসাহী হয়েছেন অনেকেই। আর প্রাইসের উদ্যোগে চমকিত কর্মীরা তাকেও চমকে দিয়েছে অনেকবার।

যেহেতু কর্মীদের বেতন বাড়ানোর জন্য প্রাইসকে তার বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে দিতে হয়েছে, কর্মীরা একবার তাকে একটি গাড়ি কিনে উপহার দিয়েছিলেন।

প্রাইস বলছেন, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের মত বিত্তবান হতে ইচ্ছে করে তারও।

"ফোর্বস এবং টাইম ম্যাগাজিনের কাভারে নিজের চেহারা দেখতে ইচ্ছা করে আমারো। সব কিছু হঠাৎ ছেড়ে দেয়া সহজ কাজ নয়, কিন্তু আমার জীবন আগের চেয়ে অনেক ভালো এখন।"

সূত্র-বিবিসি

আমারসংবাদ/এমএআই