আমারসংবাদ ডেস্ক
জুলাই ১০, ২০২০, ১১:৩৯ এএম
বিশ্বে প্রাণঘাতী করোনার তাণ্ডব কবে শেষ হবে, তা কেউই এখনও জানে না। এমনকি এই ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা কবে বাজারে আসবে, তাও একেবারে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
তবে গত কয়েক মাসের যে অগ্রগতি হয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে চলতি বছরেই অন্তত চারটি টিকা বাজারে মিলতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা।
এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে অক্সফোর্ডের টিকা। এরপর আছে ক্যান সিনো বায়োলজিকস ও মডার্নার তৈরি করা টিকা। আগস্টের মধ্যে টিকা বাজারে ছাড়ার ব্যাপারে আশাবাদী ভারতের গবেষকরাও। টিকা তৈরির দৌড়ে আছে বাংলাদেশও।
সব ধাপ অতিক্রম করতে পারলে আগামী চার-পাঁচ মাসের মধ্যে এই টিকাগুলো বাজারে ছাড়ার ব্যাপারে আশাবাদী বিভিন্ন দেশের গবেষকরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হালনাগাদ (গত শুক্রবার পর্যন্ত) তথ্য অনুযায়ী, করোনার টিকা উদ্ভাবনে ১৪০টির বেশি প্রকল্প চালু রয়েছে। এর মধ্যে ‘প্রি-ক্লিনিক্যাল’ পর্যায়ে আছে ১২৯টি। ‘প্রি-ক্লিনিক্যাল স্টেজ’ সম্পন্নের পর শুরু হয় ‘ক্লিনিক্যাল স্টেজ’। এই পর্যায়ে ধাপ রয়েছে তিনটি।
বর্তমানে করোনার ১৫টি টিকা প্রথম ধাপে রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে ৯টি। আর তিনটি টিকা রয়েছে তৃতীয় ধাপে। সাধারণত তৃতীয় ধাপ সম্পন্নের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন মিললে একটি টিকা বাজারে ছাড়া হয়।
‘প্রি-ক্লিনিক্যাল’ পর্যায়ে একটি টিকা মানুষের পরিবর্তে অন্য কোনো প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়। এই পর্যায়ে দেখা হয়, টিকাটি সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে কি না। এরপর ‘ক্লিনিক্যাল স্টেজের’ প্রথম ধাপে এটি পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয় অল্পসংখ্যক মানুষের শরীরে। তখন গবেষকরা জানার চেষ্টা করেন, এটি মানবদেহের জন্য নিরাপদ কি না এবং সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কিনা।
দ্বিতীয় ধাপে এটি প্রয়োগ করা হয় কয়েক শ মানুষের শরীরে। এই ধাপে গবেষকরা জানার চেষ্টা করেন, এই টিকা কী মাত্রায় মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হবে। এরপর তৃতীয় ধাপে টিকা প্রয়োগ করা হয় কয়েক হাজার মানুষের শরীরে। এই ধাপে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কার্যকারিতাসহ অন্যান্য বিষয় যাচাই করা হয়। এইভাবে স্টেপ বাই স্টেপ টিকাগুলো পরীক্ষা করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের তিনটি টিকা বর্তমানে তৃতীয় ধাপে রয়েছে। এগুলো হলো—যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের ‘এজেডডি-১২২২২’; চীনের ক্যান সিনো বায়োলজিকসের ‘এডি৫-এনকভ’ এবং মার্কিন প্রতিষ্ঠান মডার্নার ‘এমআরএনএ-১২৭৩’।
এর মধ্যে ‘এডি৫-এনকভ’ ভ্যাকসিনটি চীনের সেনাবাহিনীতে প্রয়োগের জন্য বিশেষ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অক্সফোর্ডের গবেষকদের তৈরি করা ভ্যাকসিনটি উৎপাদন ও বাজারজাত করবে অ্যাস্ট্রাজেনেকা।
প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে জানিয়েছে, চলতি বছরের শেষ দিকে ‘এজেডডি-১২২২২’ বাজারে ছাড়া হবে। তবে মডার্না কোনো সময়সীমা দেয়নি। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তারা আগামী বছরের মধ্যে ‘এমআরএনএ-১২৭৩’ বাজারে ছাড়তে চায়।
এদিকে দ্বিতীয় ধাপে থাকলেও চলতি বছরেই করোনাভাইরাসের টিকা বাজারজাত করতে চায় জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বায়োএনটেক’। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, অক্টোবরের মধ্যেই তাদের টিকার চূড়ান্ত অনুমোদন চাওয়া হবে। তাদের টিকার নাম ‘বিএনটি-১৬২বি১’।
তবে ভারতের গবেষকরা দাবি করেছেন, তাদের আবিষ্কৃত টিকা ‘কোভ্যাকসিন’ আগামী মাসেই বাজারে আসতে পারে। চলতি জুলাই মাসে এই ভ্যাকসিনের ‘হিউম্যান ট্রায়াল’ শুরু হবে। এ জন্য ১২টি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচনও করা হয়েছে। এই ধাপটি উত্তীর্ণ হলে আগামী ১৫ আগস্টের মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য এই টিকা বাজারে ছাড়া হতে পারে।
ভারত বায়োটেক, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি (এনআইভি) যৌথভাবে এই টিকা বানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেকোনো টিকা বাজারজাত করা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। কয়েক দশকও লেগে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, কয়েক দশকের চেষ্টার পর এইচআইভির ভ্যাকসিন এখন তৃতীয় ধাপে রয়েছে।
ইতিহাসে সবচয়ে কম সময়ে অনুমোদন পেয়েছে মাম্পসের (পনসিকা) টিকা; চার বছরের মাথায়। তবে উন্নত প্রযুক্তি, বিপুল অর্থ বিনিয়োগ এবং ব্যাপক গুরুত্ব পাওয়ায় ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যেই করোনার টিকা বাজারে ছাড়া সম্ভব বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
চার নম্বরে আছে বাংলাদেশের টিকা: বৃহস্পতিবার (২ জুলাই) এক সংবাদ সম্মেলনে করোনার টিকা উদ্ভাবনের দাবি জানায় গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোব বায়োটেক’। তারা বলছে, তিনটি খরগোশের ওপর এই ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে সাফল্য পাওয়া গেছে।
তবে অনুমোদন মিললে এই টিকা এখন মানবদেহে প্রয়োগ করা হবে। সব ধাপ পার হতে পারলে চার থেকে পাঁচ মাস তথা ডিসেম্বরের মধ্যে এই টিকা বাজারে আনা সম্ভব বলেও সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়।
এদিকে শিগগিরই দেশে শুরু হচ্ছে চীনের তৈরি করা একটি টিকার ‘হিউম্যান ট্রায়াল’। একাধিক ভ্যাকসিনের পরীক্ষার জন্য এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে আন্তর্জাতিক উদারাময় রোগ গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশ-আইসিডিডিআরবি।
এই প্রসঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও আইসিডিডিআরবি গবেষকদলের প্রধান ড. ফেরদৌসী কাদরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত আছি। চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু হবে শিগগিরই। তবে এখনো দিনক্ষণ ঠিক হয়নি।’
এসময় তিনি আরো একাধিক ভ্যাকসিনের পরীক্ষা বাংলাদেশে হতে পারে বলেও ইঙ্গিত করেন। ফেরদৌস কাদরী বলেন, একাধিক ভ্যাকসিনের পরীক্ষার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে আমরা সবাইকেই স্বাগত জানাবো।
গ্লোব বায়োটেকের তৈরি করা টিকা সম্পর্কে এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। সফল হলে অনেক বড় একটি ব্যাপার হবে।’
আমারসংবাদ/জেডআই