Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্ব সম্পর্কে আমরা কতটা জানি?

আমার সংবাদ ডেস্ক

অক্টোবর ৫, ২০২০, ০২:৩২ পিএম


নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্ব সম্পর্কে আমরা কতটা জানি?

কাউকে যদি জিজ্ঞাস করেন আপনি কি একা থাকতে পারবেন? উত্তর আসবে- পারবো না। কারণ, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে পৃথিবীতে একা রাখেননি। পৃথিবীর প্রথম মানবের জন্য তিনি সঙ্গী সৃষ্টি করে পাঠিয়েছেন একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর জন্য। শুধু মানুষ নয়; সৃষ্টি জগতের কোনো সৃষ্টিই একা নয়।

আমরা মানুষেরা একা থাকতে চাই না। খুব কম মানুষই চায় একাকী থেকে জীবন কাটাতে। কেউ পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে একা থাকে, কেউ কেউ আবার স্বেচ্ছায়। যারা একাকী জীবন বা একাকীত্বকে উপভোগ করতে চায় বা পারে বা কিভাবে করতে হয় জানে তারাই একাকী পাড়ি দেয় জীবন নামক অজানা ও রহস্যময় সমুদ্র।

একাকীত্ব কখন আসে? আমরা সাধারণত বুঝতে পারি না। যখন বুঝি তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। জীবনে কখনও কখনও এমন সময় আসে যখন না চাইলেও একা থাকতে হয়। হয়ত সারা জীবনের জন্য নয় তবুও যতটুকু সময়ই একা থাকতে হয়, হয়ত মাস বা বছর বা দীর্ঘসময় ধরে। আবার কখনও কখনও আজীবনই একাকী।

একা থাকাকে যখন আমরা নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করি তখনই একাকীত্ব বোধ আসে। এই বোধ তখন আমাদেরকে ভেতর থেকে ভেঙ্গেচুরে দেয়। কুড়ে কুড়ে খায়। এর যন্ত্রণা কতটা ভয়ংকর সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ সুন্দরভাবে বর্ণনা দিতে পারবে না।

মানসিকভাবে কেউ যখন কোনো একজনকে যার সাথে তার সামাজিক সম্পর্ক বা বন্ধন আছে, যাকে সে আশা করছে, যোগাযোগ করতে চাচ্ছে ও মিশতে চাচ্ছে কিন্তু তার চাওয়ার গভীরতা অনুযায়ী সে তাকে পাচ্ছে না, তখন তার মনে যে কষ্টকর অনুভূতি হচ্ছে সেটিই একাকীত্ব।

আমাদের জীবনে চলার পথে আমরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হই। সমস্যার সমাধান যখন করতে পারি না, তখন নিজেকে একা মনে হয়, তুচ্ছ মনে হয় নিজের কাছে নিজেকে। বাঁচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

আর এভাবেই জমতে জমতে গড়ে ওঠে মনের মধ্যে একাকীত্বের পাহাড়। একাকীত্ব যখন গ্রাস করে তখন আমাদের কর্মক্ষমতা কমে যায়। মনোযোগ কমে যায়। কোনো কাজ সুন্দর করে করা হয় না। আত্মবিশ্বাস কমতে কমতে আমাদের জীবনের আনন্দগুলোও ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। এরপর একসময় এটি মানসিক সমস্যায় পরিণত হয়। ধীরে ধীরে সমস্যাটি অনেক বড় রূপ ধারণ করে। এটি তখনই আশংকার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

তাই আমাদের মনে রাখতে হবে- একাকীত্বকে আমরা যত প্রশ্রয় দেবো, এটি তত বেশি গ্রাস করতে থাকবে আমাদেরকে অর্থাৎ ভুক্তভোগীকে। একাকীত্ব জীবনকে ঝামেলা না ভেবে মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়া এবং এটিকে উপভোগ করা প্রয়োজন অনেক বেশি। আমরা কখনই বুঝে উঠতে পারি না, একা থাকার মুহূর্তগুলোতে আমরা কী করবো বা কী করবো না।

কেউই বলতে পারবে না যে, তার কখনও একা লাগেনি। কোনো না কোনো সময় একা লাগেই মানুষের। যাদেরকে আমরা জনপ্রিয় বলে মনে করি, তারাও এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ একজন ব্যক্তির অনেকজন বন্ধুবান্ধব থাকা মানেই সে একাকী বোধ করে না, এমন নয় ব্যাপারটি। তাদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা না থাকলে সে একা বোধ করতে পারে এবং অনেকজন লোক থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত বন্ধু না থাকায় সে একাকী বোধ করতে পারে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, যখন আমি বা আপনি একা থাকি তখন নিজেকে নতুন করে জানতে পারা যায়। একা থাকলে নিজের প্রতি খেয়াল রাখার সময় বেশি পাওয়া যায়। তখন আমাদের নিজেদের কাজ নিজেকেই করতে হয় বিধায় আমরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারি। জগতে সম্পর্ক ভাঙ্গার কষ্ট সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক। যখন একটা ভালোবাসার সম্পর্ক ভাঙ্গে তখন সেটা আমাদের মানসিক শক্তি এবং শান্তি দুটোই নষ্ট করে দেয়।

একা থাকার ক্ষেত্রে নিজের জন্য সময় পাওয়ার ব্যাপারটা খুব কাজে দেয়। নিজের জন্য নিজের কিছু একা সময় পাওয়া যায়। নিজের অতীতের কষ্ট, অতীতের ভুলগুলো নিয়ে নিজের সাথে নিজে বোঝাপড়া করা ও নিজেকে শুধরাতে পারা যায়। প্রথমে কিছুটা কষ্ট হলেও পরে একসময় একাকীত্ব ও নির্জনতার সাথে যুদ্ধ করে করে শিখে ফেলি কিভাবে নিজের সাথে নিজে চমৎকার সময় কাটানো যায়।

সবচেয়ে সুন্দর দিকটি হচ্ছে, পরবর্তী সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে আর ভুল হয় না। আমরা একদমই ভুলে যাই যেটি, একা থাকা মানেই কিন্তু জীবন প্রেমবিহীন নয়। সেই সময়টা জীবনকে সমৃদ্ধ করতে ভালভাবে ভালো কাজে লাগানো যায়। একাকীত্বের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, এটি আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে না, কখনই না।

যদি দেখা যায় কেউ কারো সাথে ব্যস্ততার অজুহাতে অবহেলা করছে, বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা করছে কিংবা ভালোবাসার ছলনা করছে সেক্ষেত্রে তাকে এড়িয়ে চলতে পারাটাই উত্তম। কারণ তার মিথ্যে ভালোবাসা সুন্দর জীবনটা আস্তে আস্তে শেষ করে দিতে পারে। তার চেয়ে একা থাকা অনেক ভালো। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজন ব্যক্তির শক্তিশালী ও দৃঢ় মনোবল। তবে অনেকেরই এই রকম মনোবল থাকে না বিধায় একাকীত্ব তাকে শেষ করতে থাকে ধীরে ধীরে।

আমরা আমাদের একাকীত্ব দূর করতে পারি যদি স্বদিচ্ছা থাকে এবং নিজের জীবনটাকে খানিকটা হলেও ভালোবেসে থাকি। যখন আমরা ভালোকাজে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখতে সক্ষম হবো, একাকীত্ব বোধ তখন আমাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না। এজন্য আমরা নিজের কিছু কিছু শখ পূরণ করার চেষ্টা করতে পারি। প্রকৃতির সাথে সময় কাটাতে পারি বাগান করার মাধ্যমে।

এছাড়া সেলাই করতে পারি, ঘর গোছাতে পারি, ছবি আঁকার চেষ্টা করতে পারি, মিউজিক শুনতে পারি ইত্যাদি আরও অনেক কাজ। নিজের শরীরের যত্ন নিতে পারি। ব্যায়াম হিসেবে হাঁটতে পারি। হাঁটতে হাঁটতে অনেক সৃষ্টিশীল ভাবনা আসে মাথায়। চাইলে লিখতে শুরু করা যায়। ভাবুন আর লিখুন। কাগজ কলম তো হাতের কাছেই! নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে ছোট গল্প বা বড় গল্প লেখা যায়, আর্টিকেল লেখা যায়, কিছু সুন্দর মুহূর্ত নিজের সঙ্গেই কাটানো যায় এভাবেই।

একঘেয়েমি কাটানোর জন্য আমরা ভ্রমণ করতে পারি নতুন নতুন জায়গায়। ভ্রমণ করার ফলে আমাদের মানসিক প্রশান্তি মেলে এবং আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার প্রশস্ত হয়। নিজেকে চেনা যায়। এ জন্যই হয়ত ডাক্তার রোগীকে ঘুরে আসতে বলে। ভ্রমণ তাই একাকীত্ব দূর করার উপায়গুলোর মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমার কাছে এবং আমার নিজের পছন্দের শীর্ষে।

আরেকটি ব্যাপার যেটা সবাই ধরতে পারে না, সেটি হচ্ছে- আমাদের চেয়ে বয়সে বড় এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় যারা তাদের বিচারবুদ্ধি অনেক পরিপক্ব আর তারা হলেন নির্ভরযোগ্য। নতুন মানুষের সাথে মিশে বন্ধুত্ব তৈরি করতে পারলে একা বোধ হয় না। আসলে একাকীত্বকে দুঃখ হিসেবে না দেখে বরং এটাকে উপলব্ধি করা উচিত। একা থাকা মানেই একাকিনী নয়।

একা থাকলে ক্ষমা করতে পারার মতো মহৎ গুনটি চলে আসে। যখন একাকী নিজের ভুল-ত্রুটি নিয়ে ভাবা হয়, দেখা যায় তখন অন্যের জন্য আমাদের মনে একটা সফট কর্নার তৈরি হয়। ক্ষমা করে দিতে পারি আমরা তখন। আমাদের কষ্টগুলো সহজ হয়ে যায় তখন। একা থাকার সবচেয়ে বড় অর্জন এটিই মনে করি আমি।

এর সাথে সাথে আর একটা বড় ব্যাপার হয় যে, আমরা সৃষ্টিকর্তাকে ফিল করতে পারি খানিকটা হলেও নিজেদের শুদ্ধ চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে। নিজেদেরকে মেলে ধরতে পারি সৃষ্টিকর্তার কাছে। একটা ঐশ্বরিক সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে আমরা যে বিশেষ জ্ঞানটি অর্জন করতে পারি তা হচ্ছে, আমরা সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারি। পুরোপুরি হয়ত নয়; হোক সামান্য তবুও তা একজন মানুষের জন্য বিশাল যা একাকীত্বই দিতে পারে। আর সৃষ্টিকর্তাকে অনুভব করতে পারা যায় বলেই অন্তরে মানুষের জন্য ক্ষমা অটোমেটিক চলে আসে।

একাকী হয়ে যাবার ভালো দিকের আরও একটি ভালো দিক- আমরা প্রকৃত বন্ধু চিনে নিতে পারি। একা হয়ে গেলে আমরা যেটা করি- নিজেকে একদম আলাদা করে ফেলি। কোনো সমস্যা হলে আমরা নিজেকে টেনে তুলতে একা একা অনবরত চেষ্টা করে যাই যা একদমই ভুল। এটি না করে সমস্যা কেন সৃষ্টি হয়েছে তা বের করার চেষ্টা করা আর সমাধানের জন্য সাহায্য চাওয়া। এই অন্যের কাছ থেকে পাওয়া সহযোগিতায় নিজেদেরকে আর একা মনে হয় না।

আমাদের আশেপাশে আমাদেরকে পছন্দ করে এমন মানুষ আছে। অন্যের কাছ থেকে পাওয়া সহযোগিতা আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সুন্দর কাজ করে। আর একাকীত্বের এই দুঃসময়ে যে ব্যক্তি বা বন্ধুটি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে, বুঝতে হবে সেই প্রকৃত বন্ধু। যখন কেউ পাশে থাকে না, তখন কে আমাদের বন্ধু বা শত্রু তা চিনে নিতে ভুল করা উচিত নয় একদমই।

একাকীত্ব বোধ করার খারাপ দিকও আছে যা জানা আমাদের জরুরি। একাকীত্বের প্রথম সমস্যা হচ্ছে, শারীরিক ক্ষতি। গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ১৫টি সিগারেট খেলে যে ক্ষতি হয় শরীরের, একাকীত্ব ঠিক ততটাই ক্ষতি করে। দীর্ঘদিন ধরে এই একাকীত্বে ভুগতে থাকলে সেটা মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকারক।

এরপর যেটা হয়, আমাদের কায়িক পরিশ্রম বেড়ে যায়। সব কাজ নিজেকেই করতে হয়। রান্না করা, বাজার করা, কাপর কাচা থেকে শুরু করে থালা বাসন ধোয়া, নিজের রুম সবকিছু নিজেকেই পরিষ্কার করা ইত্যাদি আরও অনেক কাজ একাই করতে হয়। এরমধ্যে ভালো দিকটি আমি আগেই বলেছি। শারীরিক খাটুনি বেশি হয় এই যা।

বাংলায় একটা কথা আছে, "চিন্তার চেয়ে চিতার আগুন ভালো"। আমরা যখন একা হয়ে যাই, সাধারণত তখন আমাদের মনে নানা রকম নেতিবাচক চিন্তা এসে ভিড় করে। আর এই নেতিবাচক চিন্তা যেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি শরীরের জন্যও। অনবরত নেতিবাচক চিন্তা করার ফলে শরীরে নানা অসুখ বাসা বাঁধে। তাই ইতিবাচক চিন্তা করা প্রয়োজন সব সময়।

আমরা যে ভুলটা করি একা হয়ে গেলে সেটি হচ্ছে নিজেকে ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলি। একাকীত্ব আমাদেরকে ভুল পথে নিয়ে যায় অনেক সময়ই। একাকীত্ব কাটিয়ে ওঠার কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে আমরা হয়তো বাছবিচারহীনভাবে যে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলি। যে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। হয়তো অনেকেই এইরকম মনে করি যে, কোনো ভালো বন্ধু না থাকার চেয়ে যে কোনো বন্ধু থাকা ভালো। আর এটাই বিপদ ডেকে আনতে পারে জীবনে।

আর যেটা করি, আমরা ডিভাইস আসক্ত হয়ে পড়ি। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট সবসময় একাকীত্ব দূর করতে পারে না। একা থাকলে আর যেটি হয়, আমরা কথা বলা কমিয়ে দেই মানে কথা বলার সুযোগ থাকে না, ফলে আমরা কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ি। আমরা নীরব প্রকৃতির মানুষ হয়ে যাই।

যতদিন এই পৃথিবী থাকবে, সৃষ্টিসমূহ থাকবে, মনুষ্য সমাজ থাকবে, ততদিনই এই একাকীত্ব বোধও থাকবে। মানুষ একা বাস করতে পারে না বলেই সমাজের সৃষ্টি। ক্ষুধা লাগলে খাবার খাই, তৃষ্ণা পেলে পানি পান করি তেমনি একাকীত্ব বোধ হলেও তা মেটানোর প্রতি মনোযোগী হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। একা না হলে নিজেকে আবিষ্কার করা যায় না, এটি জীবনের উন্নতির জন্যও অন্তরায় নয়, বরং সহায়ক। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যেদিন একা থাকার মুহূর্তগুলোকে ভালোবাসতে পারা যাবে, সেদিন আর একাকীত্ব আমাদেরকে স্পর্শ করতে পারবে না।

লেখক: রেহানা রহমান রেনু, শিক্ষক ও কলামিস্ট