Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার হাতে ওরা ১১ জন

ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৬, ১২:২৭ পিএম


বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার হাতে ওরা ১১ জন

১৯৬০ সালের পর থেকে গত অর্ধশতক ধরে চলা বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ জন্য এবারে মনোনীত অমর একুশে গ্রন্থ মেলার প্রথম দিন দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা ১১ জন বিশিষ্ট কবি, লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদের হাতে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ তুলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই পুরস্কার তুলে দেয়া হয়।

কবিতায় আলতাফ হোসেন, কথাসাহিত্যে শাহীন আখতার, প্রবন্ধে যৌথভাবে আবুল মোমেন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড. আতিউর রহমান, গবেষণায় মনিরুজ্জামান, অনুবাদে আব্দুস সেলিম, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে তাজুল মোহম্মদ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। আর আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনী ক্যাটাগরিতে ফারুক চৌধুরী, নাটকে মাসুম রেজা, বিজ্ঞান/প্রযুক্তি/পরিবেশ ক্যাটাগরিতে শরীফ খান এবং শিশুসাহিত্যে সুজন বড়ুয়া এ পুরস্কার পেয়েছেন।

১০টি ক্যাটাগরিতে মোট ১১ জনকে এবার এ পুরস্কার দেয়া হয়েছে। পুরস্কারের অর্থমূল্য এক লক্ষ টাকা এবং সঙ্গে সম্মাননাপত্র ও সম্মাননা প্রতীক প্রদান করা হয়েছে। বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬ প্রাপ্তদের মধ্যে আলতাফ হোসেন: পয়ত্রিশ বছর আগে প্রথম কবিতার বই ‘সজল ভৈরবীর’ প্রকাশের পরপরই দেশে কবিতাপ্রেমিদের আলোচনায় এসেছিলেন। এরপর গত তিন দশকে তাঁর লেখা ‘পাখি বলে’ ও 'কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে’সহ বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ।

আলতাফ হোসেন:
১৯৪৯ সালের ২৭ অক্টোবরে জন্ম নেয়া আলতাফ হোসেন লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন গল্প ও প্রবন্ধ। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে- ‘লাজুক অক্টোপাস, ‘ভূমধ্যসাগরে অন্ধ ঘূর্ণি যা বলুক, ‘সঙ্গে নিয়ে চলে যাই পাহাড় চূড়োয়, ‘বলি যে তারানা হচ্ছে, ‘তারপর হঠাৎ একদিন মৌমাছি’।

শাহীন আখতার : নব্বইয়ের দশক থেকে নিয়মিত লিখে আসা শাহীন আখতার অর্থনীতি বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬২ সালে কুমিল্লার চান্দিনায় জন্মগ্রহণ করা শাহীনের বিভিন্ন লেখা সাম্প্রতিক সময়ে প্রশংসীত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তার লেখা উপন্যাস ‘তালাশ’ ২০১১ সালে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ‘পালাবার পথ নেই, ‘ময়ূর সিংহাসন’ও সমালোচকদের কাছে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। এছাড়া ‘বোনের সঙ্গে অমর লোকে, ‘শ্রীমতির জীবনদর্শন’সহ ইতিমধ্যে কয়েকটি গল্পের সঙ্কলন বেরিয়েছে তাঁর। শাহীন আখতারের সম্পদনায় তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ‘সতী ও স্বতন্ত্ররা- বাংলাসাহিত্যে নারী'।

আবুল মোমেন:
প্রবন্ধের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কারে মনোনীত আবুল মোমেন দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখেন। প্রবন্ধের বাইরে কবিতা, গল্প, কিশোরসাহিত্য তিনি লিখে চলেছেন। সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবুল ফজলের ছেলে আবুল মোমেন ১৯৪৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কর্মজীবন শিক্ষকতা দিয়ে শুরু হলেও পরে যোগ দেন সাংবাদিকতায়। তাঁর শিক্ষা ও শিল্পকলা বিষয়েও একাধিক বই রয়েছে। রবীন্দ্র ভ্রমণ সাহিত্য সমগ্র (দুই খ-), বাংলা ও বাঙালির কথা, কাগজের কুশীলব এবং বিজ্ঞানী মামা ও অপারেশন ফিউচার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

আতিউর রহমান : অর্থনীতি নিয়ে কাজের জন্য গত কয়েক বছরে দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন পুরস্কার পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভণর ড. আতিউর রহমান প্রথম কোনো সাহিত্য পুরস্কার পেলেন। অর্থনীতিবিদ ও গবেষক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি নিয়ে তিনি দীর্ঘদিনধরে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্রঋণ বিপ্লব নিয়ে গবেষণামূলক অনেক লেখা রয়েছে তাঁর। অর্থনীতির সঙ্গে তিনি সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেনও বলা হয়। ‘রবীন্দ্র চিন্তায় দারিদ্র ও প্রগতি’ প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও তার কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। জামালপুরে ১৯৫১ সালে জন্ম নেয়া ড. আতিউর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির পাঠ শেষ করে করে ইউনির্ভাসিটি অব লন্ডন থেকে পিএইচডি করেন। বি আইডিএসের গবেষক হিসেবে কাজের পর তিনি পালন করেছেন জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। ২০০৯ সালের ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের দশম গর্র্ভণর হিসাবে দায়িত্ব নেন তিনি।

মনিরুজ্জামান : ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন। ভাষা, সাহিত্য ও ফোকলোর বিষয়ে ২৭টি বই ও শতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। কর্মজীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি এবং কলা অনুষদের ডিনের দায়িত্ব ছাড়াও নজরুল ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪০ সালের ১৫ ফ্রেরুয়ারি জন্মগ্রহণ করা মনিরুজ্জামান গত শতকের ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে পড়ার পর ভারতের মাইশুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। ‘লিঙ্গুইস্টিক সোসাইটি অভ ইন্ডিয়া, ‘দ্রাাবিড়িয়ান লিঙ্গুইস্টিক অ্যাসোসিয়েশান’, ‘ফিলোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশান অভ গ্রেট ব্রিটেনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংঘের তিনি আজীবন সদস্য।

ড. আবদুস সেলিম: অনুবাদে এ বছরের বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত ড. আবদুস সেলিম ১৯৪৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইংরেজি ভাষা ও ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক। কাজ করছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বের্টোল্ড ব্রেখটের নাটক ‘গ্যালিলিও, ‘হিম্মতী মা’, ‘গোলমাথা চোখামাথা’ এবং তিন খণ্ডে সমাপ্ত ‘অনুবাদ নাটক সমগ্র’ আব্দুস সেলিমের উল্লেখযাগ্য অনুবাদগ্রন্থ। বাংলা একাডেমি থেকে ড. সেলিমের দুটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ভায়োলেটড ইন সেভেনটি ওয়ান’ গবেষণামূলক বইটি। তাঁর আরেকটি বই ‘ইংলিশ টু বেঙ্গলি ডিকশনারি’।

তাজুল মোহাম্মদ : কৃষি বিভাগে চাকরির পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের তৃণমূলের ইতিহাস সংগ্রহ ছিল তাজুল মোহাম্মদের প্রধান নেশা। এক সময় তিনি সেসব ইতিহাস লিখে রাখার তাগিদ অনুভব করেন এবং সিলেটের বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা গ্রামে ১৯৮০ সালে ৮১ জনকে গণহত্যার তথ্য সংগ্রহ করে পাঠান স্থানীয় একটি পত্রিকায়। পরের দুই যুগে হাজার হাজার শহীদের নাম-ঠিকানা, তাদের বীরত্বের কাহিনী এবং পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের বর্বরতার নানা ঘটনার কথা তিনি তুলে এনেছেন গ্রাম বাংলার শিকড় থেকে। বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত গণহত্যার ঘটনাগুলো নিয়ে ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয় তাজুল মোহাম্মদের প্রথম বই ‘সিলেটে গণহত্যা’। এরপর বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘সিলেটের যুদ্ধকথা', ‘একাত্তরে সিলেট: স্মৃতিকথা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের খোঁজে', মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সন্ধানে’ এবং ‘কুরুক্ষেত্রী সেনা ১৯৭১’। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার সন্তান তাজুল মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে বই লিখেছেন।

ফারুক চৌধুরী : সাবেক কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরীর লেখায় বার বার উঠে এসেছে দীর্ঘ কর্মজীবনের নানা অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন দেশ আর সময়ের নানা ঘটনার বিশ্লেষণ। স্মৃতিকথা ও ভ্রমণবিষয়ক বই ছাড়াও তার হাত দিয়ে বেরিয়েছে এ দেশের ইতিহাস ও অর্থনীতি নিয়ে বেশ কিছু লেখা। ১৯৩৪ সালে আসামের করিমগঞ্জে জ্ন্মগ্রহণ করা ফারুক চৌধুরীর পৈত্রিক বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তরে পড়ার সময়ই তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। কুষ্টিয়া শহরে নাটকের দল বোধনের মাধ্যমে কৈশোরেই নাটকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় মাসুম রেজার এরপর পরিচয় ঘটে নাট্যকার সেলিম আল দীনের লেখার সঙ্গে। সেলিম আল দীনকে অনুসরণীয় মেনেই নাট্যকার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মাসুম। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য মঞ্চ নাটকের মধ্যে ‘বিরসা কাব্য’, ‘নিত্যপূরাণ’, ‘আরজ চরিতামৃত’, ‘জল বালিকা’, ‘শামুকবাস’।

শরীফ খান : পাখি ও বন্যপ্রাণী বিশেষঞ্জ শরীফ খানের দীর্ঘ গবেষণার ফল 'হালতি পাখির বাসা' ও 'বড় হালতির ছানা' শীর্ষক দু‘টি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকাশিত আট খণ্ডের শিশু বিশ্বকোষের অন্যতম প্রদায়ক। পরিবেশ ও বণ্যপ্রাণী বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইইউসিএন প্রকাশিত পাখি ও বন্য প্রাণী বিষয়ক 'রেড ডাটা বুক' এর প্রকাশনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে শরীফ খানের। সুজন বড়ুয়ার জন্ম চট্টগ্রামের ফটকছড়িতে, ১৯৫৯ সালে। ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন 'আকাশ আমার আয়না', 'আকাশ আমার সাগর আমার', 'কিশোর প্রবন্ধ সমগ্র’ ‘দেবতার রাজ্যে ছেলেটি'সহ প্রায় অর্ধশত বই। শিশু একাডেমি থেকে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত ‘শিশু-বিশ্বকোষ’ ও ‘ছোটদের বিজ্ঞানকোষ’-এর ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় সহযোগীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু-গ্রন্থমালা’ কর্মসূচির তিনি সমন্বয়ক ছিলেন।