Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

রক্ত-স্বাধীনতা, ঐতিহ্য মিশ্রিত চেতনার আরেক নাম ‘অপরাজেয় বাংলা’

ছিদ্দিক ফারুক, ঢাবি

ডিসেম্বর ৯, ২০২০, ০৭:০০ এএম


রক্ত-স্বাধীনতা, ঐতিহ্য মিশ্রিত চেতনার আরেক নাম ‘অপরাজেয় বাংলা’

বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’র স্মৃতি বিজড়িত ক্যাম্পাসের নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, ডাক দিয়েছেন মুক্তির। আর সেই মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে। অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। মানচিত্রে নতুন দেশ অঙ্কিত হয়েছে। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এক জন্মভূমি যার নাম বাংলাদেশ।

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক ভাস্কর্যের কথা বললেই প্রথমে আমাদের চোখের সামনে যে দৃশ্যটি ভেসে উঠে তা হলো তিনটি নিশ্চল মূর্তি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বললেও আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে সেই একই ছবি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে অবস্থিত এ ভাস্কর্যটির নাম ‘অপরাজেয় বাংলা’। কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে বাংলার নারী-পুরুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বিজয়ের প্রতীক এই ভাস্কর্য। এর নির্মাতা মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। 

ভাস্কর্যটিতে তিনজন তরুণের মূর্তি প্রতীয়মাণ। এদের মধ্যে দুজন পুরুষ এবং একজন নারী। মূর্তির সর্ব ডানে রয়েছে কুচি দিয়ে শাড়ি পরিহিতা প্রত্যয়ী এক যোদ্ধা নারী সেবিকা। 

তারপাশে কাঁধে রাইফেলের বেল্ট ধরা, কাছা দেয়া লুঙ্গি পরনে এক যুবক যার ডানহাতে একটি গ্রেনেড-তিনি বৃহত্তর গ্রাম-বাংলার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। আর তার বামপাশে জিন্সপ্যান্ট পরা অপেক্ষাকৃত খর্বকায় তরুণ যার হাতে থ্রি-নট রাইফেল এবং চোখে-মুখে স্বাধীনতার দীপ্ত চেতনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অবস্থিত একটি ভাস্কর্য। এটি নির্মাণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। অপরাজেয় বাংলা নামকরনটি করেছিলেন মুক্তিযাদ্ধা ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী (১৯৩৮ - ২০১৭)।

ভৌগলিক স্থানাঙ্কে অপরাজেয় বাংলার অবস্থান ২৩.৭৩৩৫৮৩৭ ডিগ্রি উত্তর ৯০.৩৯২৭৫০৮ ডিগ্রি পূর্ব।

ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে, প্রেরণার বাতিঘর হয়ে আলো ছড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন বাংলার গৌরবময়  ইতিহাস। দেশের শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রতীক এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

তাই ইতিহাস-ঐতিহ্যকে শিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য, যা কিনা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারী আন্দোলনসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার প্রতিফলন ঘটায়।

১৯৭৩ সালে ভাস্কর্যটির কাজ শুরু হলেও তা শেষ হতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ। রক্তক্ষয়ী পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রাখা হয়েছিল ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ। পরবর্তীতে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারী মাসে পুনরায় ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করা হয়। ৬ ফুট বেদির উপর নির্মিত এ ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১২ ফুট এবং প্রশস্থতা ৮ ফুট ।

ঐতিহ্যবাহী ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্য নির্মাণের ও রয়েছে ইতিহাস। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য-সাধারণ অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ‘ঢাকা বিশ্ববিয়াদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ (ডাকসু) মনোযোগী হয়। এ জন্য বটতলা থেকে একটু দূরে তৎকালীন শিল্পী আব্দুল লতিফের নকশায় নির্মিত হয় একটি ভাস্কর্য। 

কিন্তু রাতের আঁধারে একদল কুচক্রী মহল ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলে। পরবর্তীতে সেখানেই আবার নতুন ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ভাস্কর্য নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয় সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের উপর। তিনি প্রথমে মাটি দিয়ে ভাস্কর্যের মডেল তৈরী করেন। 

মডেলটি সবার পছন্দ হলে ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে এর আনুষ্ঠানিক নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখন থেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করে দেন খালিদ। তার আর দিন-রাত বলে কিছু থাকে নয়া। মানুষটার মগজে তখন একটাই চিন্তা ভাস্কর্য তৈরি। 

তবে কিছুদিন পরেই ঘটে যায় দেশের ইতিহাসের জঘন্যতম-অন্যতম কালো অধ্যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা। তার কালো ছায়া থেকেও রেহাই পায়না ভাস্কর্য। বিধ্বংসী একটা ট্যাংকের নল সবসময় অর্ধনিমিত তাক করে রাখা হত ভাস্কর্যের দিকে। 

তাছাড়া পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে পাকপন্থী এবং স্বাধীনতা বিরোধী চক্র গুলো ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলতে জনমত সৃষ্টির জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাক্ষর গ্রহণ করে। কিন্ত তৎকালীন সব ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মী থেকে শুরু করে সাধারন শিক্ষার্থীরা তাদের এই পরিকল্পনাকে সমূলে নৎসাত করে দিয়েছিল এবং তারা প্রবল বাধার স্মমুখীন হয়। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কয়েকজন কর্মীকে চুন-কালি মেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

পরদিন নির্মাণাধীন অপরাজেয় বাংলার সামনেই বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ ছাত্রশিবিরের পক্ষ নেয় এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। হামলায় কতিপয় ছাত্র ও আহত হয়। তবে শেষপর্যন্ত স্বাধীনতা বিরোধী স্বৈরাশাসকদের যতই পৃষ্ঠপোষকতা থাকুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবিনাশী।

ভাস্কর্যটির নাম ‘অপরাজেয় বাংলা’ হওয়ার কৃতিত্ব সে সময়ের ‘দৈনিক বাংলার’ সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর। তিনি ভাস্কর্য নিয়ে সেসময় দৈনিক বাংলাতে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল ‘অপরাজেয় বাংলা’। পরবর্তীতে এ নামটিই সর্বসম্মতি ক্রমে গ্রহণ করা হয়।

‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক, প্রেরণার উৎস এবং সকল আন্দোলনের প্লাটফর্ম হিসাবে কতটা যে গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে মিশুক মনিরের খুব অসাধারণ একটি বক্তব্য অসামান্য- ‘অপরাজেয় বাংলা’ দেশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে কোন লিফ্লেটের দরকার পড়েনি। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, বিএনপি হোয়াটেভার ইট ইজ, যাদেরই রাজনৈতিক কোন বক্তব্য রাখার প্রয়োজন হতো, কোথায় হবে? অপরাজেয় বাংলা। 

এই যে একটা ইউনিভার্সাল এক্সেপ্টেন্স এটা ৭৮,৮৫,৮৮ কনস্ট্যান্টলি হয়েছে। এরকম উদাহরণ হয়তো কমই আছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এক্রস দা প্লটফর্ম একই ভেন্যু, একই ইমেজ, একই ফিলিংস থেকে রিলেট করছে, গ্রেট এচিভমেন্ট। মিশুক মনিরের এ বক্তব্যের সত্যতা আমরা আজও দেখতে পাই।

‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যটিতে যে তিনজন মানুষকে দেখা যায় তাদের একজন হলেন ফার্স্টএইড বক্স হাতে একজন সেবিকা। যার মডেল হয়েছিলেন হাসিনা আহমেদ। তারই পাশে দাঁড়ানো সময়ের প্রয়োজনে রাইফেল কাঁধে তুলে নেওয়া গ্রীবা উঁচু করে ঋজু ভঙ্গিমায় গ্রামের টগবগে তরুণ। যার মডেল হয়েছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ। তিনি ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। 

এবং সবশেষে দাঁড়ানো দুহাতে রাইফেল ধরা আরেক শহুরে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা যার মডেল ছিলেন বদরুল আলম বেনু। তিনি শুধু অপরাজেয় বাংলার মডেলই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আবদুল্লাহ খালিদের একান্ত সহযোদ্ধাও।

তবে দুঃখের বিষয় হলো ‘অপারেজয় বাংলার’ যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষ। এছাড়া ভাস্কর্য সংরক্ষণের বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী।

তারা জানান, ঐতিহ্যবাহী এই ভাস্কর্য যেন এখন আড্ডা দেওয়ার জায়গা হিসাবে পরিণত হয়েছে। আর বাকিটা সময় কুকুরের আবাসস্থল। ভাস্কর্যকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে সেটা ঘিরে দেওয়া উচিত।

তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সদা জাগ্রত রাখতে ঐতিহ্যবাহী ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলকেই নিতে হবে।

অপারেজয় বাংলার ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের সাথে একসময় এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শিমুল সালাহউদ্দিন।

সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে ‘অপারেজয় বাংলা’ প্রসঙ্গে উঠে আসলে পারস্পরিক যে আলাপ হয় তার কিয়দাংশ এখানে উল্লেখ করা হলো-

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: স্যার, আপনি তো ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, বামপন্থী ছিলেন! এখনো বামপন্থী?

সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ: তুমি জানলা কিভাবে? এখন তো আর এইটা কেউ বলে না। তখন সাম্যবাদে উদ্বুদ্ধ ছিলাম। পরে আর রাজনীতি করি নাই। এসএসসি পরীক্ষার পর এলাকার বড়ভাইরা বললো, ছাত্র ইউনিয়নের সবার সাথে বন্ধুত্ব হলো। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টও ছিলাম কিন্তু! নইলে তো তোমরা চিটাগাং ইউনিভার্সিটি শুনলেই শিবির বলতা!

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হা হা হা, না স্যার, অপরাজেয় বাংলা যে বানায় সে শিবির হয় কেমনে! এসএসসি পাশ করলেন কত সালে?
সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ: নাইনটিন সিক্সটি ফাইভে মনে হয়।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: অপরাজেয় বাংলার প্রথম নকশাটা করলেন বা ডিজাইন করলেন, এইটা কত সালে? প্রস্তাবটা কাদের ছিলো?
সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ: ১৯৭৩ সালে মনে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছিল, ডাকসুও ছিল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার কাছে প্রস্তাবটা স্যার কারা নিয়ে আসে?
সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ: সেলিম ছিল, ঐ যে মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম। আরও কে কে ছিল।

জনৈক এক কবি 'অপারেজয় বাংলা' নিয়ে লিখেছেন এক অসাধারণ কবিতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,কলা ভবন চত্বর,
প্রবেশের পথে থমকে দাড়াই।
পেছন থেকে মৃদুস্বরে কে যেন ডাকে আমায়।
আমাকে ডেকে বলে "পথিক-
শুনবে আমার কথা,একটু সময় হবে তোমার?"
একজন নারী। সাথে আরও দুজন পুরুষ যোদ্ধা।
আমি এগিয়ে গেলে আমায় বলে-মোরা ক্লান্ত,
পঁচাত্তরে খালেদের কীর্তি আমরা তিনজন।
সেই থেকে এখানে আমরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি,
এই বন্ধু বটগাছের পাশে,যার সাথে নিত্য কথা হয়।
মিছিল-স্লোগানে মুখরিত হয় আমাদের চারপাশ,
মাঝে মাঝে আমাদের চোখ বেঁধে দেওয়া হয় কাল কাপড়ে।
ঐ বটগাছ,ও আমায় একাত্তরের গল্প শোনায়,
শোনায়, লাল-সবুজের পতাকা প্রথম মেলে ধরার গল্প।
তবুও আমি,আমরা ক্লান্ত।
আমি বলি ক্লান্ত কেন তুমি?ক্লান্ত কেন তোমরা?
সে আমায় বলে-
আমাকে সৃষ্টির লক্ষ্য এখন শুধু পাথরের কারুকার্য।
আমায় দেখে একাত্তরের কথা হয়না স্মরণ,
তাইতো ক্লান্ত,শ্রান্ত।

আমারসংবাদ/এআই