শিবগঞ্জে বসেছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা

মোহাম্মদ আলী, বগুড়া প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২২, ০৫:১৯ পিএম
শিবগঞ্জে বসেছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা

নবান্ন উৎসবকে ঘিরে বগুড়ার শিবগঞ্জে বসেছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। ভোর থেকেই হাজার হাজার মানুষ দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন মাছ কিনতে। বিভিন্ন জাতের বড় আকারের মাছের জন্য বিখ্যাত এই মেলায় দিনভর মাছের পাশাপাশি বেচাকেনা চলবে ক্ষেত থেকে সদ্য তোলা শীতের বিভিন্ন সবজিও।

 এছাড়াও নাগরদোলা, শিশু-কিশোরদের খেলনার দোকানও বসেছে। সেইসঙ্গে মিষ্টান্ন ও দইয়ের একটি বড় বাজারও বসানো হয় মেলা চত্বরে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পঞ্জিকানুসারে শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) পহেলা অগ্রহায়ণ। এদিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নবান্ন উৎসব পালন করেন। এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর উথলীসহ শিবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বসেছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের এই মেলা।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নবান্ন উৎসব হলেও উথলী, রথবাড়ি, ছোট ও বড় নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, আকনপাড়া, গরীবপুর, দেবীপুর, গুজিয়া, মেদেনীপাড়া, বাকশন, , রহবল, দাড়িদহ,কিচক, আমতলী, আলিয়ারহাট, আটমুল, ভাইয়েরপুকুর,পিরব, জামুরহাট, বুড়িগঞ্জহাট শিবগঞ্জসহ প্রায় ২০ গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে রয়েছে নানা আয়োজন।

প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের আগে থেকেই নিমন্ত্রণ করা হয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা নতুন ধানে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠেন।সরেজমিনে দেখা যায়, ভোর থেকেই মেলায় প্রচুর মাছ নিয়ে হাজির হয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

শতাধিক দোকানে দেড় কেজি থেকে শুরু করে ২০ কেজি ওজনের বোয়াল, রুই, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, ব্রিগেড কার্প, ব্লাড কার্পসহ নানা রকমের মাছ বিক্রি করছেন তারা। তবে দাম গত বছরের তুলনায় এবার কিছুটা কম হওয়ায় মাছ কিনে খুশি হচ্ছেন ক্রেতারা।

মেলায় রুই-কাতলা ও চিতল মাছগুলো ৪৫০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ তিনশ থেকে সাড়ে ছয়শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।এ ছাড়া ৩০০-৪৫০ টাকা দরে ব্রিগেড ও সিলভার কার্প মাছ বিক্রি করতে দেখা গেছে।

অন্যদিকে, নতুন আলু ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। নবান্ন উপলক্ষে শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন তৌফিক ইসলাম।

তিনি বলেন, ‍‍`এই এলাকায় নবান্নের মেলা থেকে মাছ কিনে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়। তাই মেলা থেকে মাছ কিনতে এসেছি।

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‍‍`বাপ দাদার আমল থেকে এই মাছের মেলা দেখে আসছি। নবান্ন উপলক্ষে মেয়ে-মেয়ের জামাই আর নাতি এসেছে।দশ কেজি ওজনের রুই মাছ নিলাম। সবাই মিলে এক সাথে খাব।

গাইবান্ধা থেকে আসা রুহুল আমিন বলেন, ‍‍`নবান্ন উপলক্ষে বড় আপুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। হরেক রকমের বড় বড় মাছ নিয়ে এমন মেলা আগে কখনো দেখিনি।‍‍`

মাছ বিক্রেতা সঞ্জিত কুমার বলেন, ‍‍`মেলা উপলক্ষে ২ লাখ টাকার মাছ কিনেছি দাম বেশ ভালই পাচ্ছি। ভোর থেকেই মাছ  কিনতে আসছেন ক্রেতারা।আশা করছি, এ বছর ভাল লাভ করতে পারবো।‍‍`

শহিদুল ইসলাম নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‍‍`প্রতি বছর এই মেলায় মাছ বিক্রি করতে আসি। গতবারের তুলনায় এবার বিক্রি বেশি হচ্ছে। দাম নাগালের মধ্যে থাকায় মানুষ বিগহেড এবং কাতল মাছ বেশি কিনছেন।‍‍`

উথলী বাজারের ইজারাদার আজিজুল জানান, প্রতি বছর নবান্নে এখানে মাছের মেলা হয়। মেলায় সূর্যোদয়ের পর থেকে রাত পর্যন্ত মাছ কেনাবেচা হবে। এবার মাছের আমদানি ভালো এবং দামও তুলনামূলক কম। আশা করছি, এ বছর এখানে কোটি টাকার ওপরে মাছ কেনাবেচা হবে বলে জানিয়েছেন। এছাড়াও নবান্ন উৎসবে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা উপলক্ষে বগুড়ার শিবগঞ্জের ঐতিহাসিক মহাস্থান বাজারে বসেছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। মেলায় ছোট-বড় সব ধরনের মাছ পাওয়া যাচ্ছে।

শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপজেলার মহাস্থান বাজারে দুর-দুরান্তের মানুষ এসেছেন মাছ কিনতে। মেলা উপলেক্ষে এ এলাকার প্রতিটি বাড়িতে বড় বড় মাছ ও নতুন সবজি কিনে স্বজনদের আপ্যায়নের আয়োজন চলছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এ মেলায় এক হাজার মণেরও বেশি মাছ কেনাবেচা হয়েছে। এক কেজি থেকে শুরু করে ২০ কেজি ওজনের বাঘার মাছ, ১৬ কেজি ওজনের ব্ল্যাক কার্প, ১৫ কেজি ওজনের কাতল, রুই, ব্রিগেড, বাগার, সিলভার কার্পসহ হরেক রকমের মাছ বিক্রি হয় এ মেলায়।

তবে গত বছরের তুলনায় এবার মাছের দাম অনেকটায় কম বলে জানিয়েছেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা। মেলায় বিশালাকৃতির রুই-কাতলা ও মাছগুলো ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ ২০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ২৪০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা দরে ব্ল্যাক কার্প, ব্রিগেড ও সিলভার কার্প মাছ বেচাকেনা হয়।

মেলায় মাছের পাশাপাশি নতুন শাক-সবজির পসরাও সাজানো হয়। মেলায় নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ২০০থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া মিষ্টি আলু ও কেশর (ফল) প্রতিকেজি ১৫০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।

মেলায় আসা মাছ ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান, রশিদ মিয়া ,জহুরুল ইসলাম, জানায়, মেলায় ছোট-বড় মিলে শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রত্যেক বিক্রেতা ৫ থেকে ১০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলায় মাছ সরবরাহের জন্য সেখানে বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) রাত থেকে ২০টি আড়ৎ খোলা হয়। সেসব আড়ৎ থেকে স্থানীয় বিক্রেতারা পাইকারি দরে মাছ কিনে মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।

তারা বলেন, মহাস্থান  নবান্ন মেলায় বিক্রির জন্য আশপাশের এলাকার পুকুরগুলোতে সৌখিন চাষিরা মাছ মজুদ করে রাখেন। এলাকার কে কত বড় মাছ মেলায় তুলতে পারে যেন তারই প্রতিযোগিতা চলে চাষিদের মধ্যে। এছাড়া আড়ৎদাররা তো আছেই।

তারা আরও বলেন, এলাকার লোকজনও প্রায় প্রতিযোগিতা করে তুলনামূলক বড় মাছ কিনে বাড়িতে নিয়ে যায়। মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নবান্ন উৎসব করলেও আশপাশের গ্রামের সব সম্প্রদায়ের মানুষই কেনাকাটা করে।

মহাস্থান বাজারের ইজারাদার ইব্রাহিম হোসেন বলেন ,মেলাটি আগে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও সম্প্রতি তা ব্যাপকতা লাভ করেছে। শুধু আশপাশেরই নয় পুরো শিবগঞ্জ উপজেলার মানুষ এখানে নবান্নের বাজার করতে আসেন।

এআই