নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে মানিকগঞ্জে পালিত হয়েছে তেরশ্রী গণহত্যা দিবস। মঙ্গলবার সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, নীরবতা পালন, আলোচনা সভা ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করা হয়।
প্রতি বছর ২২ নভেম্বর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, মুক্তিযোদ্ধা, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী জমিদার বাড়ির এই বর্বরতাকে তেরশ্রী ট্রাজেডি দিবস ও তেরশ্রী গণহত্যা দিবস হিসেবে ৫১ বছর যাবৎ পালন করা হচ্ছে। ২০১২ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর শহীদদের সম্মানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। তবে ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ির বেঁচে যাওয়া কোন সদস্যদের খোঁজ খবর রাখেনি কোন সরকার এমন মন্তব্য জমিদার বাড়ির বেঁচে যাওয়া সদস্যদের।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালের এই দিনে ৭ঘণ্টা ব্যাপী বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তেরশ্রী গ্রামের তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী ও অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ ৪৩ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে এবং বেয়নেটের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক বাহিনী।
বাম রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল তেরশ্রী গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা ছিল জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর দোসররা টার্গেট করে এই গ্রামটিকে। গোপনে শিক্ষানুরাগী, মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা সৈনিক, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবীদের তালিকা প্রস্তুত করে দালালরা। নীল নকশা করে এই গ্রামটিকে ধ্বংস করার। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর ভোর কেটে সূর্য ওঠার মুহূর্তেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও দেশীয় রাজাকার ঘিরে ফেলে তেরশ্রী গ্রামের সেনপাড়ার কালি মন্দিরটি।
২১ নভেম্বর রাতে এ দেশীয় দালালদের নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোপনে একটি মিটিং করে তেরশ্রী গ্রামে সেনপাড়া কালিবাড়ী মাঠ প্রাঙ্গণে। তারা পরিকল্পনা করে ২২ নভেম্বর হত্যাযজ্ঞের। ঘিওর থেকে সিধুঁনগর গ্রামের মধ্য দিয়ে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা এ দেশীয় ঘাতকদের সহযোগিতায় ভারী অস্ত্রসহ তেরশ্রী গ্রামে প্রবেশ করে। কনকনে শীতের সকাল তখন অনেকেই ঘুম থেকে উঠেনি। ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানি সেনারা অতর্কিত হামলা চালায় গ্রামটিতে। ঘরে ঘরে জ্বালিয়ে দেয় আগুন। ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেয়নি গ্রামবাসীকে। বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর। তাদের চিৎকারে পুরো এলাকা কম্পিত হয়ে ওঠে। অপারেশনের সময় দালালরা মুখোশ পরে নেয়। মাত্র ৭ ঘণ্টার অপারেশনে ঘাতকরা একের পর এক বেয়নেট চার্জ ও গুলি করে ৪৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। বেলা ১২টার মধ্যে হত্যাযজ্ঞ শেষ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘিওর সদরে চলে যায়। এই সময় পুরো এলাকা রক্তে ভেসে যায়। লাশগুলো কোনোরকমে দাফন করা হয়।
হত্যাযজ্ঞের পরে বহু হিন্দু পরিবার অন্যত্র চলে যায়। দেশ স্বাধীন হবার পরে কিছু মানুষ আবার ফিরে আসে তাদের বাপ-দাদার ভিটায়। তবে সেদিনের সেই নৃশংসতা কিছুতেই তারা ভুলতে পারেনি। স্বাধীনতার ৫১ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও সেনপাড়া গ্রামের মানুষগুলো হত্যাকাণ্ডের বিচার পায়নি। নিহত ৪৩ জনের মধ্যে ৩০ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তারা হচ্ছেন-তেরশ্রী জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী, তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান, স্থানীয় স্কুলের দপ্তরি মাখন চন্দ্র সরকার, যাদব চন্দ্রদত্ত, তার পুত্র মাধব চন্দ্র দত্ত, সাধা চরন দত্ত, শামা লাল সূত্রধর, নিতাই চন্দ্র দাস, জগদিশ চন্দ্র দাস, সুধনা চন্দ্র দাশ, সুরেন্দ্র চন্দ্র দাশ, প্রাণ নাথ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, সাধন কুমার সরকার, যোগেশ দাশ, রামচরন সূত্রধর, রাধাবলস্নভ, ভোলা নাথ, জ্ঞানেন্দ্র ঘোষ, যোগেশ সূত্রধর, মো. কফিল উদ্দিন, মো. গেদা মিয়া, মো. একলাছ মিয়া, শ্যামা প্রসাদ নাগ, নারায়ণ চন্দ্র সূত্রধর, যোগেন্দ্র নাথ গোস্বামী যোগেশ চন্দ্র, গৌর চন্দ্র দাস, মো. তফিল উদ্দিন, তাজ উদ্দিন, মনিন্দ্র চন্দ্র দাশ।
এসএম