মাগুরায় ১,২,৫ টাকার কয়েন কি অচল ঘোষণা করা হয়েছে?

মিরাজ আহমেদ, মাগুরা প্রকাশিত: জুন ২১, ২০২৩, ০৭:০১ পিএম
মাগুরায় ১,২,৫ টাকার কয়েন কি অচল ঘোষণা করা হয়েছে?

মাগুরা জেলায় এক টাকা,দুই টাকার ধাতব মুদ্রা বা কয়েন একেবারেই অচল। এমনকি ভিক্ষুককে দিতে চাইলেও দুই টাকার কয়েন নিতে চান না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই কয়েন অচল না হলেও মাগুরা জেলার সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকও তা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে রীতিমতো দুর্ভোগে পড়েছেন এ জেলার মানুষ।

এদিকে হাটবাজারে দোকানিরাও কেনাবেচায় দুই টাকার কয়েন নিতে অনীহা দেখানোয় বিপাকে সাধারণ মানুষ। রিকশা,ভ্যান বা মুদি দোকানদারেরাও কেনাকাটায় দুই টাকার কয়েন নিতে অনাগ্রহী। হাটবাজারসহ ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুই টাকার কয়েন দেখলেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে লেগে যায় তর্ক। কোনও পক্ষই এসব ধাতব মুদ্রা নিতে রাজি হয় না। মাগুরা  জেলায় এক,দুই টাকার মুদ্রা সম্পর্কে মানুষের সঙ্গে কথা হলে এমনই সব তথ্য জানা যায়।

লেনদেন বা কেনাকাটায় কাগজের নোটের পাশাপাশি বাজারে প্রচলিত যেকোনও মূল্যমানের কয়েন যে-কেউ নিতে বাধ্য। কিন্তু মাগুরা এক দুই টাকার কয়েন লেনদেন না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের কাছে পড়ে আছে হাজার হাজার টাকার কয়েন।

মাগুরা নতুন বাজার,পুরাতন বাজার,ভায়না কাঁচাবাজার সহ একাধিক বাজারের একাধিক মুদি ব্যবসায়ী জানান,এক,দুই টাকার কয়েন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছেন তাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। কয়েন নিতে বাধ্য হওয়া সম্পর্কে এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান,অসংখ্য পণ্য রয়েছে যেগুলো বিক্রি করতে হলে খুচরা টাকার প্রয়োজন; কিন্তু এ জেলা শহরে এক,দুই,পাঁচ,টাকার কয়েন কেউ নিতে চান না। তবে কেন কয়েন নিতে সবার এত অনীহা এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কেউ। তারা মনে করেন এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজর নেই বলেই আজ এই অবস্থা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক,মুদিখানা  চা-দোকানি জানান,এক কাপ র-চা পাঁচ টাকা ও দুধ চা দশ টাকায় বিক্রি হয়। তাই চা পান শেষে সিংহভাগ ক্রেতা মূল্য হিসেবে কয়েন দেন। এ সময় দুই টাকার কয়েন অনেকে দিলেও তা নেওয়া হয় না। কারণ এই কয়েন মাগুরা জেলায় চলে না। এ ছাড়া পাইকারি ব্যবসায়ীরাও,এক বা দুই টাকার কয়েন নিতে চান না। সব ধরনের পণ্যের মহাজনরা কয়েন দেখলে অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। অনেক সময় মহাজনকে কর্মচারীরা দুই টাকার কয়েন দিলে তা ফেলে দেন। কয়েন নিয়ে মালামাল বিক্রি করেন না।

অচিন্ত কুমার অধিকারী মাগুরা নতুন বাজার এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন,‘কয়েক বছর যাবৎ এক,দুই টাকার কয়েন মাগুরা জেলায় অচল হয়ে গেছে। এখন কেউ নিতে চান না। অসংখ্য ব্যবসায়ীর কাছে বিপুল পরিমাণ কয়েন জমে আছে। বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়েছে যে এক,দুই টাকার কয়েনগুলো কোনও ব্যাংকও নিতে চাচ্ছে না’।

এ ব্যাপারে তন্ময় কুমার বিশিষ্ট কাপড় ব্যবসায়ী বলেন,‘স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলায় এক দুই টাকার কয়েন চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কয়েন যে নিতে চাবে না তাকে আইনের মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে। কারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা বাড়িতে প্রচুর পরিমাণ কয়েন পড়ে আছে অলস টাকা হিসেবে। এতে অর্থনীতির গতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে।’

২১শে জুন বিকালে এ বিষয় জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের মাগুরা জেলা শাখার মেনেজার মোঃ রশীদুল ইসলাম 
জানান, মাগুরা জেলাসহ ঝিনাইদহে  এক, দুই টাকার কয়েন কেন চলে না, এর কারণ তার জানা নেই। কেউ এই কয়েন নিতে না চাইলে অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক দুই টাকার কয়েন লেনদেনের বিষয়ে কোন প্রকার প্রচার-প্রচারণা করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, জনগণকে সচেতনতা  বৃদ্ধির জন্য কোন প্রচার প্রচারণা এখনো করা হয়নি।

এ বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চেয়ে ২১শে জুন বিকেলে মুঠোফোনে মাগুরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবু নাসের বেগকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেন নি।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনায় এমনটাই মনে হয়েছে।দোকান থেকে ২ টাকা দামের ৩ রকমের তিনটি চকলেট কিনতে চাইলে দোকানী ৫টার কম বিক্রি করতে চাইছে না। প্রতিটি চকলেটের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২ টাকা লেখা থাকলেও দোকানী ১, ২, ৩ বা ৪টি কোনভাবেই বিক্রি করছে না। কারণ হিসেবে বলছেন, ৫টির কম চকলেট নিলে তাদের ফিরতি টাকা দেওয়া নিয়ে ঝামেলা হয়। আবার ২টা নিলে ৫ টাকা দাম দিতে হবে। দোকানদারের এই ধরনের হিসাব দেখে প্রতিবেদন তৈরির সময় একটু অবাকই হতে হলো। মুদি দোকানদারদের ভাষ্য এমন, ১ ও ২ টাকার কয়েন বাজারে চলে না, কেউ নিতে চায় না। আমি দোকানীর কাছে জানতে চাইলাম, ১ ও ২ টাকার কয়েন যে বাজারে চলবে না, এ ধরনের কোনো সরকারি নির্দেশনা আছে কিনা। দোকানী সেসব কথার তোয়াক্কা না করে বলল,ওনার কাছে কয়েক হাজার কয়েন আছে,কেউ নিলে সে সেগুলো দেবে। এরপর আমি দোকানীকে একটা দেশলাইয়ের দাম জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল,১ টাকা এবং ২ টাকার দেশলাই আছে। তবে আমরা ৫টা বা ১০টার কম বিক্রি করি না। আবার অনেক সময় ৫ টাকায় দুই ধরনের দেশলাই মিলিয়ে দিই। দোকানীর এমন উত্তর শুনে বুঝলাম,দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এখন সত্যি সত্যিই বেড়েছে। সেইসাথে মানুষের জীবনমানেরও উন্নয়ন হয়েছে। তাই হয়ত সবাই এখন আর আগের মত ১টা চকলেট বা ১টা দেশলাই কেনে না,বা পন্য সামগ্রিই মজুদ রাখেন না, নানাবিধ বিরম্বনা এড়াতে অল্প দামের পণ্য দোকানে বিক্রি করেন না।

সরেজমিন ওষুধের ডিসপেনসারিতে গিয়ে ১ পাতা ৫০০ মি.গ্রা. এর প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ১৫ টাকা। পূর্বে দাম জানা থাকায় ডিসপেনসারির ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলাম,দাম ১২ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা রাখার কারণ। সে বলল, ‘১ ও ২ টাকার লেনদেন নাই, সেজন্য ১৫ টাকাই রাখছি’।

আবার অনেকে দুই বয়্যামে দুই ধরনের ১ ও ২ টাকা দামের চকলেট রেখে দিয়েছে। কোনো ক্রেতাকে ভাংতি ১ ও ২ টাকা ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন পড়লে তার পরিবর্তে চকলেট দিয়েই প্রয়োজন মিটাচ্ছে। ভুক্তভোগী মানুষ সবদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চকলেটের এই ব্যবস্থা অনেক জায়গাতে চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে চা,দবিস্কুট,পান, বিড়ি বিক্রির দোকানে বেশি দেখা যায়। তবে এই বিষয়টি মন্দের ভালো বলা যায়। কেননা, এতে একজন ক্রেতা একেবারে কিছু না পাওয়ার চেয়ে চকলেটের মতো সামান্য কিছু হলেও পাচ্ছে। দেশে বর্তমানে পয়সা আকারে ধাতব মুদ্রা চালু আছে ১, ৫, ১০, ২৫ ও ৫০ পয়সার। এ ছাড়া ১ টাকা, ২ টাকা ও ৫ টাকার ধাতব মুদ্রাও আছে। কিন্তু দৈনন্দিন কেনাকাটা বা লেনদেনে ১, ৫, ১০ ও ২৫ পয়সার ধাতব মুদ্রার ব্যবহার হয় না এখন। ৫০ পয়সার ব্যবহার মাঝে মাঝে দেখা গেলেও অন্য চার ধরনের পয়সাই কার্যত অচল। বাস্তব জীবনে কাজে না লাগা এসব পয়সা আইনগতভাবে সচল। অর্থাৎ সচল মুদ্রা বাস্তবে অচল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য সূত্রে জানা যায়, দেশের আইন অনুযায়ী কোনো পয়সাই অচল নয়। বাজারে কেনাকাটার ক্ষেত্রে পয়সা না চললেও ব্যাংকের কোনো গ্রাহক যদি পয়সাটা চান,ব্যাংক তাঁকে তা দিতে বাধ্য। কয়েনেজ অ্যাক্টের সংশোধন ছাড়া পয়সাকে অচল ঘোষণার সুযোগ নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এক টাকা ছাড় দেওয়ার কারণে পণ্য বা সেবার দাম এক টাকা বেড়ে যাচ্ছে। এটা মূল্যস্ফীতি তৈরি করছে। পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি হতেই থাকে। এতে লেনদেনের চলতি একক বা ইউনিট একটা সময়ে গিয়ে মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

তবে মাগুরার সচেতন সমাজের মতে, লেনদেনে এক টাকা ছাড় দেওয়ার যে চর্চা গড়ে উঠেছে,তা পাল্টানো দরকার। একদিকে অনেক কয়েন মানুষের ঘরে পড়ে থাকছে। অন্যদিকে, সবাই এক টাকা করে ছাড় দিতে দিতে অনেক বড় অঙ্ক লেনদেনের হিসাব থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

যেহেতু ধাতব মুদ্রা জনগণ এবং অন্যান্য ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে যায়। তাই চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যথেষ্ট পরিমাণ মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মজুত রয়েছে। যেকোনো ব্যক্তি চাহিদা অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের ধাতব মুদ্রা এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে বিভিন্ন কারণে জনগণ ধাতব মুদ্রা বা পয়সার ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়েছে।

আইন অনুযায়ী বিনিময়ের সময় কাগজি নোটের পাশাপাশি বাজারে প্রচলিত সব মূল্যমানের কয়েন নিতে সবাই বাধ্য। কিন্তু বাস্তবে লেনদেনের সময় ১ ও ২ টাকার কয়েন নিতে ব্যবসায়ী মহলে অনীহা। ফলে এসব খুচরা পয়সা নিয়ে ভোক্তা পর্যায়ের পাশাপাশি ব্যবসায়ীমহলসহ সকল পর্যায়ের মানুষই বিপাকে পড়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, তাদের কাছে হাজার হাজার টাকার কয়েন পড়ে আছে। সেগুলো কোনভাবেই বাজারে ছাড়তে পারছে না। অন্যদিকে রিকশা বা বাস ভাড়া, মুদি দোকানের কেনাকাটায় কয়েন নিতে অনীহা। এমনকি ভিক্ষুকরাও ১-২ টাকার কয়েন নিতে নারাজ।

দেশে মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক আগেই হারিয়েছে ১, ৫, ১০, ২৫ ও ৫০ পয়সার কয়েন। যদি ১ ও ২ টাকার কয়েনের ব্যবহার ও বন্ধ করা হয় তাহলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু যথোপযুক্ত প্রক্রিয়া অবলম্বন করে তারপর এসকল মুদ্রার বিনিময় মূল্য উঠিয়ে নেওয়া সমীচীন বলে মনে হয়। তাহলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না পক্ষান্তরে ব্যবসায়ীমহলও দ্বিমত পোষণ করবে না।

আরএস