শ্রম কেনা বেচার হাটে কাজের জন্য অপেক্ষা

হাসান ভুঁইয়া, আশুলিয়া (ঢাকা) প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩১, ২০২৪, ০৪:১৭ পিএম
শ্রম কেনা বেচার হাটে কাজের জন্য অপেক্ষা
ছবি: আমার সংবাদ

তীব্র শীত আর ভোরের ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে বাঁশের ঝাকা আর কোঁদাল নিয়ে এক জায়গায় জড়ো হয়েছেন অনেকে। অপেক্ষা শুধু নিজের শ্রম বিক্রি করার। মূলত একদিনের জন্য নিজের শ্রম বিক্রি করতেই এখানে এসেছেন তারা। দেশের স্মার্ট যুগেও ভোর বেলার এই শ্রম বিক্রির হাটের ওপর এখনও এরা নির্ভরশীল।

দিনমজুর হিসেবে নিজের শ্রমকে বিক্রি করতে অনেকেই নিয়মিত আসছেন এই শ্রমের হাটে। কাজের সন্ধানে ভোর বেলার শ্রমিকদের এক জায়গায় জড়ো হওয়া এমন হাটগুলো দিনমজুর বা কামলার হাট নামে পরিচিত।

মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সাভারের নবীনগর এলাকার জাতীয় স্মৃতিসৌধের মেইন গেটের বাহিরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের লোকাল লেনে এমনই দৃশ্য দেখা যায়। এ দৃশ্য একদিনের নয়, প্রতিদিনের।

দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সাভারের বাজার বাস্ট্যান্ড, হেমায়েতপুর, আশুলিয়া বাজার বাসস্ট্যান্ড, জিরাবো, নরসিংহপুর, নবীনগর, ইপিজেড সহ ১০ থেকে ১২টি স্থানে এভাবেই চলছে মানুষের শ্রম বেচা-কেনা। প্রতিদিন ভোর ৬টা হতে সকাল ১০টা পর্যন্ত নিয়মিত হাট বসলেও এ হাটে কোনো ধরনের খাজনার ঝামেলা নেই। যুগের পর যুগ এই শ্রম বিক্রির হাট চলছে তার নিজের আপন গতিতেই। খাজনার দিক থেকে কিছুটা শান্তিতে থাকলেও কাজ পাওয়ার বিষয়টি একদম অনিশ্চিত।

মধ্যযুগ কিংবা প্রাচীনকালে মানুষ কেনাবেচার হাট বসলেও সেই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই স্মার্ট যুগেও দারিদ্র্যতা আর অভাবের নির্মম আঘাতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো দু’বেলা রুটি-রুজির জন্য আজও নিজের শ্রম বিক্রি করতে জড়ো হোন শ্রম বিক্রির এই হাটে।  

এ সকল হাটে দিনমুজুর হিসেবে রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি কিংবা মিস্ত্রির জুগালিসহ বিভিন্ন শ্রমজীবিদের সরগম হয়। যাদের শ্রম কিনতে প্রতিদিনই আসেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার ও মালিকরা। শ্রমের হাটে জড়ো হওয়া অনেকে বিক্রি হলেও কিছু থেকে যান অবিক্রিত। দারদাম শেষে যারা নিজের শ্রম বিক্রির জন্য ঠিক হন তারা রওনা হন মালিকের গন্তব্যে। সারাদিন ঘাম ঝরানো কঠোর পরিশ্রমে শেষে সন্ধ্যা বেলায় নিজের শ্রম বিক্রির টাকা নিয়ে বাসায় ফিরে যান এই পরিশ্রমী মানুষগুলো। তবে তাদের মুখেও শুনা যায় বর্তমান সময়ের দ্রব্যমূল্য নিয়ে নাভিশ্বাস আক্ষেপের কথা।

কাজের সন্ধানে ঢাকায় পাড়ি জমানো মো. নওশের আলী জানান, তিনি গত তিন বছর ধরে নিয়মিত এই হাটে আসেন। তিনি রাজমিস্ত্রির জুগালী কিংবা মাটি কাটার কাজ করে থাকেন।

এ জন্য তিনি প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০টাকা পান। তবে মাঝে মধ্যেই নিজের জন্য কোনো মালিক খুঁজে পান না বলেও জানান তিনি।

ফরিদ আহমেদ নামের এক দিনমুজুর জানায়, তিনি দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকার এই শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় এসে ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। প্রথম দিকে একা থাকলেও ১৬ বছর ধরে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুত এলাকায়। অন্য কোনো কাজ না পেয়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে এখানে এসেছেন তিনি। তাও মাঝে মাঝে কাজ পেলেও বেশির ভাগ সময় তিনি নিজের শ্রম বিক্রি করতে পারেন না বলে জানান।

পঞ্চাশোর্ধ জাকির হোসেন জানান, তার নিজের বাড়ি ছাড়া অন্যকোনো জায়গা বা সম্পত্তি নেই। ছেলে নেই, একটি মাত্র মেয়ে, যাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তাই নিজের বাসা ভাড়া আর দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জন্য নিজের উপার্জন নিজেকেই করতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে এই বয়ষেও শ্রম বিক্রির হাটে এসেছেন এই দিন মুজুর।

অন্যদিকে শ্রম বিক্রির হাটে পুরুষের উপস্থিতি বেশি থাকলেও নারী শ্রমিকের উপস্থিতিও ছিলো চোখে পড়ার মত। যারা সারাদিন রাজমিস্ত্রীর যোগানদাতাসহ বাসাবাড়ির বিভিন্ন ধরণের কাজ করে থাকেন। যারা প্রতিদিন নিজের শ্রম বিক্রির বিনিময়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন।

শ্রমের হাটে আসা এমনি এক নারী আসমা বেগম জানান, তার স্বামী নেই প্রায় ১৬ বছর। স্বামীর বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকায় এসেছেন। একটি মাত্র ছেলে চাকরি করে। তাইতো ছেলেকে কিছুটা আর্থিক সহযোগিতার জন্য তিনি এই জায়গায়  এসেছেন।

২১ বছর ধরে নিয়মিত এ হাটে আসা প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সী নারী আম্বিয়া জানান, দীর্ঘদিন তিনি আর তার স্বামী এক সাথে এই হাটে আসতেন। স্বামী নেই প্রায় ৭ বছর। তাই তিনি একাই এখন এই হাটে আসেন। কাজ পেলে ভালো লাগে না পেলে খালি হাতেই বাড়ি ফিরে যান। আবার পরের দিন। এভাবেই কেটে গেছে তার ২১টি বছর।

শ্রমের হাটে শ্রমিক নিতে আসা ধামরাইয়ের সূতিপাড়া এলাকার বাসিন্দা গোপাল সূত্রধর জানান, এলাকায় যে শ্রমিক পাওয়া যায় তারা বেশি টাকা দাবি করেন। তাছাড়া এলাকায় যারা শ্রমিক রয়েছেন তারা সকাল ৮ থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কাজ করেন। কিন্তু এখান থেকে শ্রমিক নিলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করানো যায়। তাই তিনি নিজের বাসার কাজের জন্য একজন শ্রমিক নিতে এখানে এসেছেন।

এ হাট থেকে ৬০০ টাকা করে দুইজন শ্রমিক নেওয়া কন্ট্রাক্টর মো. সেলিম বলেন, এখান থেকে রাজমিস্ত্রির জুগালীর জন্য দুইজনকে নিলাম। মূলত তারা রাজমিস্ত্রি সহকারি হিসেবে কাজ করবে।

দুপুরের খাবারের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৬০০ টাকাই তাদের ফিক্সড মজুরি। তারা নিজের খাবার নিজেরা কিনে খাবে অথবা তাদের বাসা থেকে খাবার আনা থাকলে তাই খাবে। বাড়ির মালিকের সাথে ৬০০টাকা করে কন্ট্রাক করা আছে। এর বেশি দেওয়া সম্ভব নয়।

শ্রম বিক্রির হাটে আসা এই পরিশ্রমীদের কাজ পেলে মুখে হাসি ফুটে, না পেলে মলিন মুখ নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় পরের দিনের জন্য। এভাবেই চলছে তাদের জীবন।

এআরএস