মুহুরী নদীতে বালু লুটের মহোৎসব: বন্ধের নির্দেশ ইউএনওর

এস এম ইউসুফ আলী, ফেনী প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪, ০৪:৫১ পিএম
মুহুরী নদীতে বালু লুটের মহোৎসব: বন্ধের নির্দেশ ইউএনওর

ফেনীর পরশুরাম পৌর শহরের খন্দকিয়া ও দুবলার চাঁদ এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া মুহুরী নদী দেখলে বোঝার উপায় নেই যে ওই স্থানে বালু তোলা হচ্ছে। অথচ তার বিপরীত পাশেই চলছে বালু লুটের মহোৎসব। সেখানে মাটি কেটে বসানো হয়েছে তিনটি ড্রেজার।

এ অবস্থা শুধু পৌর শহরেই নয়, তৎসংলগ্ন মির্জানগর ইউনিয়নের কাউতলী এলাকার চিত্র আরও ভয়াবহ।

স্থানীয়রা জানান, বছরের পর বছর এটি চললেও প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের নজরে পড়েনি এ সর্বনাশা চিত্র।

সরেজমিনে কাউতলীতে গিয়ে দেখা যায়, বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে দিবারাত্রি বালুর ট্রাক চলাচল করছে। ফলে বেড়িবাঁধ খানাখন্দকে ভরে গেছে। ওই সড়কের পাশে আলী হোসেন মজুমদার বাড়ি সম্মুখস্থ স্থানসহ আশপাশের কয়েকটি স্থানে নদী থেকে দূরবর্তী স্থানে মাটি কেটে বালুমহাল তৈরি করা হয়েছে। দেখলে যে কারো বোঝার উপায় নেই এটি নদী। যার ফলে মুহুরী নদীর চিরচেনা রূপ বদলে গেছে। প্রতিদিন অবৈধভাবে তোলা বালু মিনিট্রাকে করে বিভিন্নস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে শক্তিশালী একটি চক্র। এ কারণে স্থানীয়রা প্রকাশ্যে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পান না। শুধু তাই নয়, বালু উত্তোলনে জড়িতরা চাইলে নদীর পাশের যে কারো জমি থেকে স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে বিক্রি করেন। এরপর ওই জমিতেই ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করেন।

স্থানীয়ভাবে এই চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক একরামুল হক চৌধুরী পিয়াস, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শাহআলম সোহাগ, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হান্নান, তাদের সহযোগী এমাম হোসেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চলতি বছরে পরশুরাম উপজেলার একমাত্র বালুমহাল বাউরখুমায় ৮২ লাখ ২০ হাজার টাকায় ইজারা নেন মেসার্স শাপলা ট্রেডার্স। অথচ সরেজমিনে দেখা গেছে, ইজারা নেয়া বালুমহাল থেকে নদীর বাইরে দূরবর্তী স্থানে বসানো হয়েছে তিনটি ড্রেজার। সড়কের পাশে রয়েছে বালুর স্তূপ।

সেখানে টিলার ওপর একটি টিনের ঘরে দেখা মিললো স্থানীয় এক ব্যক্তির। তিনি নিজকে কৃষক পরিচয় দিয়ে জানান, প্রতিফুট বালু ১৬ টাকায় বিক্রি করা হয়। এখানে নদী থেকে অনেকদিন বালু উঠে না। এ কারণে পাশের জায়গা থেকে বালু তুলতে দেখি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বালুবাহী ট্রাক চলাচল করার কারণে বেড়িবাঁধ সড়ক বেহাল হয়ে পড়েছে। রাস্তা বেহাল হওয়ার কারণে রিকশা, ভ্যান বা অটোরিকশাসহ ছোট কোনো যানই সড়ক দিয়ে চলাচল করতে পারছে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দক্ষিণ কাউতলী এলাকার স্থানীয় মেম্বার ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলুল বারি মনছুর জানান, ‘মাঝে স্থানীয় এলাকাবাসী রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপর বালু কারবারিরা বেড়িবাঁধের রাস্তা ঠিক করার আশ্বাস দিয়ে পুনরায় চালু করে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরশুরাম পৌরসভার কাউন্সিলর ও স্থানীয় আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান লিটন কথা বলতে রাজি হননি।

অভিযুক্ত একরামুল হক চৌধুরী পিয়াস জানান, আমার কোন বালুঘাট নাই, মেশিনও নাই। পরশুরামে বালু মহালের ইজারাদার শাপলা ট্রেডার্স। তাদের মাধ্যমেই বালু উত্তোলন হচ্ছে। আমি বালু সংক্রান্ত কোন কাজে জড়িত নই।

এদিকে দু-একদিনের মধ্যে নদী থেকে ড্রেজার সরিয়ে না নিলে টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলা।

তিনি জানান, মঙ্গলবার মুহুরী নদীতে ফ্রি স্টাইলে বালু লুটের খবর পেয়ে দুপুরে স্থানীয় পৌর শহরের খন্দকিয়া, মির্জানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ কাউতলী এলাকায় মুহুরি নদী পরিদর্শনে যান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম।

তিনি আরও জানান, পরিদর্শনকালে বালু কারবারে জড়িতদের কাউকে পাওয়া যায়নি। নদীতে ড্রেজার বসানো থাকলেও বন্ধ ছিল। তবুও সেখানে বালু উত্তোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দু-একদিনের মধ্যে ড্রেজার সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেয়া হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলা আরও জানান, পৌর শহরের লাগোয়া একটি এলাকায় এভাবে বালু তোলা হলেও গত ৫ মাসে তিনি টেরই পাননি। এছাড়াও বেড়িবাঁধের উপর বালুবাহী ট্রাক চলাচল করায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

এছাড়াও বাউরখুমা এলাকায় ইজারা দেয়া বালুমহাল পরিদর্শন করতে সার্ভেয়ার সাইফুল ইসলামকে পাঠানো হয়েছে। তিনি বালুমহাল ইজারাদার কর্তৃপক্ষকে চৌহদ্দী ঠিক করে দিয়ে এসেছেন। পরবর্তীতে চৌহদ্দীর সীমানা অমান্য করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

ইএইচ