আমদানি পণ্যে ২০০ শতাংশ বেশি দাম দেখানো হচ্ছিল: গভর্নর

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১, ২০২২, ০৮:৫৯ পিএম
আমদানি পণ্যে ২০০ শতাংশ বেশি দাম দেখানো হচ্ছিল: গভর্নর

পণ্যর দাম ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে আমদানি করা হতো বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

তিনি বলেন, ‘আশ্চর্যজকনভাবে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েসিং(অতিরিক্ত মূল্য দেখানো) করে পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এরকম ১০০ এলসি বন্ধ করেছি আমরা।’

বৈদেশিক বাণিজ্যে পণ্যর দাম কম বা বেশি দেখিয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ‘ট্রেড বেজড’ মানি লন্ডারিং(অরথপাচার) বন্ধ হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ(বিআইডিএস) আয়োজিত ৩ দিনব্যাপী বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের প্রথম দিন  গভর্নর এসব কথা বলেন। রাষ্ট্রায়ত্ব গবেষণা সংস্থাটির  উদ্যোগে ৩দিনব্যাপী বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলন বৃহস্পতিবার শুরু হয় রাজধানীর গুলশানের হোটেল লেকশোর

প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় এবারের উন্নয়ন সম্মেলনটি অনুষ্টিত হচ্ছে। ‘অ্যানুয়াল বিআইডিএস কনফারেন্স অন ডেভেলপমেন্ট(এবিসিডি) ২০২২’ শীর্ষক এ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।

করোনাভাইরাস মহামারী পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে বাড়তে থাকে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলা এবং নিষ্পত্তির পরিমাণ। এ ধারা অব্যাহত থাকে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও। আমদানি বাণিজ্য বৃদ্ধির বিপরীতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স সেভাবে বৃদ্ধি না পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপে পড়ে বাংলাদেশ। আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছরের আগস্টে থাকা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ বুধবার ৩৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়নে নেমেছে।

আর চলতি হিসাবে ঘাটতি ক্রামগত বৃদ্ধি পাওয়ায় গত এপ্রিল থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও কড়াকড়ি আরোপ করতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বছরের শুরুতেও গড়ে প্রতি মাসে ৮ বিলিয়নের উপরে হওয়া আমদানি অক্টোবরে ৪ বিলিয়নের ঘরে নামিয়ে এনেছে সরকার।

এই কড়াকরি আরোপের পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকেই অভিযোগ করছেন  বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে আমদানি ঋনপত্র (এলসি) খুলতে দেওয়া হচ্ছে না ।

বিষয়টিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে গভর্নর বলেছেন, ‘আমরা কোনো এলসি বন্ধ করিনি, এটি সত্য নয়। আমরা ‘প্রাইস কন্ট্রোল(মূল্য নিয়ন্ত্রণ)’’ করছি। যাতে সঠিক দরে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হয়।’

বিলাসী পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে মাত্র। কারণ হচ্ছে, আপাতত এসব বিলাসী পণ্য কম আসলেও কোনো সমস্যা হবে না।

গভর্নর বলেন, অতিরিক্ত ও কম মূল্য দেখিয়ে করতে চাওয়া এলসি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে তা সংশোধন করে প্রকৃত দরে আমদানি করতে চাইলে এলসি করতে পারছেন ব্যবসায়ীরা।

গভর্নর বলেছেন, ‘জুলাইয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে কি না, তা দেখতে গত বছর ও এবছরের অনেক এলসির তথ্য নিয়ে যাচাই-বাছাই শুরু করি।

এর পর আন্ডার ইনভয়েসিং এর তথ্য হচ্ছে কি না তা যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলে জানান তিনি।

গভর্নর বলেন, ‘একলাখ ডলারের মূল্যর গাড়ি আমদানি করা হয়েছে মাত্র ২০ হাজার ডলারে। এতে বুঝা যায় বাকি অর্থ তারা হুন্ডির মাধ্যমে দিয়েছে।’

তিনি বলেন, আমরা আমদানি ও রপ্তানি পণ্যর দর নিয়ে কাজ করছি যাতে অর্থপাচার বন্ধ হয় বলেও জানান তিনি। বক্তব্যে তিনি বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ ঋণ সুদহার নিয়েও কথা বলেছেন।

গভর্নর বলেন, কৃষি খাতে অনেক দেশই কম সুদে ঋণ দেয়। এটি সরকারের দিক থেকে করা হয়। আর ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে সিএমএসএমই খাতে সুদহার বড়িয়ে ৯ শতাংশের ‘ক্যাপ’ তুলে দেওয়ার দাবি করা হয়। তখন খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি জানিয়েছেন।

এ খাতের খরচ কমিয়ে আনার উদ্যোগ জানিয়ে আবদুর রউফ বলেছেন, খরচ কমিয়ে আনার কৌশল হিসেবে সিএমএসএমই খাতে ব্যাংকগুলোকে ২ শতাংশ সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ অর্থ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে।

এখন তারা কম সুদের তহবিল পাওয়ায় এ খাতে সুদহার তুলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই বলেও জানান গভর্নর।

ব্যবসায়ীদের জন্য মেয়াদী ও চলতি মূলধনের ঋণ সুদহার সীমা ৯ শতাংশ তুলে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু এখন তার সঠিক সময় না বলে মন্তব্য করেন আব্দুর রউফ।

মহামারি পরবর্তীতে দুটো সমস্যা দেখা গেছে অর্থনীতিতে জানিয়ে গভর্নর বলছেন, ‘একটি হচ্ছে রিজার্ভ ও আরেকটি মূল্যস্ফীতি।’

এই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি মুদ্রা সরবরাহ থেকে আসেনি। এটি আমদানি দর বেড়ে যাওয়ার ঘটনা থেকে হয়েছে।

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, আমদানিতে ডলারের খরচ ও বিনিময় মূল্য বৃদিধতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে। উচ্চ বিনিময় হারকে সমন্বয় কেরলে ঋণ প্রবৃদিধ অনেক কমে যাবে।

ডলারে দাম বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে গভর্নর বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজার অনুযায়ী হওয়া উচিত। এখন তা বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর কারণেই খোলা বাজারে ১২১ টাকায় উঠে যাওয়া ডলার এখন ১১০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

আর আমদানি পর্যায়ে ডলারের দর এখন ১০৩-১০৪ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। যা কয়েক মাস পূর্বেও বেশি ছিল।

আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও নগদ বিক্রিতে ভিন্য ভিন্য দর প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আমরা দর নিয়ন্ত্রণ(রেগুলেটেড ম্যানেজমেন্ট) ব্যবস্তাপনায় যাবো না। আমরা বাজারমূখি করবো ধীরে ধীরে। খুব শীঘ্রই ভিন্য ভিন্য দর একটি সমন্বিত দরে চলে আসবে। এতো বেশি ব্যবধান থাকবে না।

রেমিট্যান্স প্রবৃদিধ কমে যাওয়ায় হুন্ডিকে দায়ি করে গভর্নর বলেছেন, ‘রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার বড় কারণ হচ্চে হুন্ডি। এজন্য রেমিট্যান্স আনা সহজ ও আমদানিতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করা হচ্চে।’

‘রেমিট্যান্স আনা সহজ করতে মোবাইলে আনার সুযোগ হচ্ছে। রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ বন্ধ করা হয়েছে। আগামী ৩-৬ মাস অপেক্ষা করতে হবে। প্রবাসীরা নিজেই রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন। তখন রেমিট্যান্সে একটি বড় উল্লম্ফন দেখা যাবে বলেও মনে করেন তিনি।’

এবি