জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং নজরুলের আদর্শ, সৃজনশীলতা ও মানবতাবাদী চিন্তাধারাকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার এক উজ্জ্বল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে এটি জ্ঞানচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞান, আইন ও কলাতত্ত্বের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রসারিত করে এটি আধুনিক জ্ঞানচর্চার পথ সুগম করছে, যা বিশ্বের সঙ্গে সমতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
১৯৯০-এর দশকে ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে ও দাবিকে সংগঠিত করে। ২০০৪ সালে একনেকের বৈঠকে প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ২০০৫ সালের ১ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৬ সালের ২৫ মে দুটি অনুষদের ভবন উদ্বোধন হয় এবং ২০০৭ সালের ৩ জুন থেকে প্রথম ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়। কুমিল্লায়ও কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উঠলেও ত্রিশাল চূড়ান্ত গুরুত্ব পায়।
প্রতিষ্ঠার উনিশ পেরিয়ে বিশতম বর্ষে এসে ৫৭ একরের বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৫৭ একরে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। দীর্ঘ বিশ বছরের পথচলায় সংকট-সম্ভাবনা সবকিছু মিলিয়ে নজরুলের আদর্শে গড়া সমৃদ্ধ এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে দুটি (নতুন ও পুরাতন) প্রশাসনিক ভবন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি অ্যাকাডেমিক ভবনে ছয় অনুষদের পঁচিশটি বিভাগের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। রয়েছে ২২০ এর অধিক শিক্ষক এবং ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী।
কিছু বিভাগ ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় সকল বিভাগেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীর কার্যক্রম চালু রয়েছে। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে সেশনজট দূর করতে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন, সামাজিক বিজ্ঞান, আইন, চারুকলা এবং কলার বিষয়গুলো পড়ার সুযোগ পান। তবে শিক্ষার্থীরা যে বিভাগেই পড়ুক, নজরুলের চেতনা ও আদর্শ সকল শিক্ষার্থীর মাঝে ছড়িয়ে দিতে প্রতিটি বিভাগেই প্রথম বর্ষে ‘নজরুল স্টাডিজ’ নামে একশত নম্বরের বাধ্যতামূলক একটি কোর্স পড়ানো হয়। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করতে প্রতিবছর গবেষণা মেলা, আন্তর্জাতিক কনফারেন্স প্রভৃতি আয়োজন করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে চারটি আবাসিক হল। হলগুলোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে মোট শিক্ষার্থীর ৪০-৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এই সুবিধা পেয়ে থাকে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্য আরও দুটি আবাসিক হল নির্মাণাধীন রয়েছে।
অন্যদিকে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে ছয়টি আবাসিক ভবন। এবং নির্মাণাধীন রয়েছে আরও একটি আবাসিক ভবন। কর্মচারীদের জন্য রয়েছে একটি আবাসিক ভবন।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে স্থাপিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন কেন্দ্রীয় মসজিদ। এছাড়াও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল, নজরুলের একটি ভাস্কর্য, দুটি ম্যুরাল, অঞ্জলী লহ মোর ভাস্কর্য ও ৭২ এর সংবিধান আঙিনা। এছাড়াও নির্মাণাধীন রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রবেশদ্বারে দুটি দৃষ্টিনন্দন ফটক, টিএসসি, একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ইনস্টিটিউট ভবন, ইউটিলিটি ভবন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর। এছাড়াও সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আসা হয়েছে সিসিটিভির আওতায়।
বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু নামে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা, ম্যুরাল, ভাস্কর্য ও কর্মযজ্ঞে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের নাম ও স্মৃতি ব্যবহার করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টিই নজরুলময় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠেছে। কবির ডাকনামে উপাচার্যের বাসভবনের নামকরণ করা হয়েছে 'দুখু মিয়া' বাংলো। বাংলোর ফটক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে রয়েছে কবি একটি করে ম্যুরাল। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কবি নজরুলের দৃষ্টিনন্দন একটি ভাস্কর্য। বিদ্রোহী কবিতার লাইন থেকে নিয়ে শহিদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের নামকরণ করা হয়েছে "চির উন্নত মম শির"। দুটো ছাত্র হলের প্রথমটির নাম নজরুলের কাব্যগ্রন্থ "অগ্নি-বীণা" নামে এবং অপরটি নামকরণ করা হয়েছে কবির বিখ্যাত কবিতা "বিদ্রোহী" নামে। অপরদিকে ছাত্রীহল দুটোর নামকরণ করা হয়েছে নজরুলের কাব্যগ্রন্থ "দোলনচাঁপা" এবং গল্পগ্রন্থ "শিউলিমালা" নামে। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পাঁচটি আবাসিক ভবনের নাম- "ব্রহ্মপুত্র নিকেতন", "সন্ধ্যা তারা", "গুলবাগিচা", "ছায়াবীথি" ও "তরুণী" নামকরণ করা হয়েছে কবির পাঁচটি গল্পের নামে। অতিথিশালার নাম "সেতু-বন্ধ" এবং কর্মচারী বাসভবনের নাম "বন্ধন" রাখা হয়েছে নজরুলের প্রবন্ধের নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র মেডিকেল সেন্টারের নাম কবির গল্পগ্রন্থের নামে "ব্যথার দান মেডিকেল সেন্টার"। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার নাম কবির কাব্যগ্রন্থের নামে "চক্রবাক"।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাসগুলোর নামও নজরুলের সাহিত্যকর্মের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করে বিদ্রোহী, ধুমকেতু, ঝিঙে ফুল, প্রভাতী, বাঁধনহারা, বিদ্যাপতি, প্রলয় শিখা, দক্ষিণ হাওয়া, সওগাত, সাম্যবাদী প্রভৃতি নামের বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় "গাহি সাম্যের গান মুক্তমঞ্চ", "চুরুলিয়া মঞ্চ" ও "জয়ধ্বনি মঞ্চে"। কবি নজরুল এর জন্মস্থান চুরুলিয়া গ্রামের নামে নামকরণ করা হয়েছে "চুরুলিয়া মঞ্চ"। অন্যদিকে "গাহি সাম্যের গান" ও "জয়ধ্বনি" শব্দ দুটি চয়ন করা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রচলিত বৃত্তিগুলোর নামকরণও করা হয়েছে কবি পরিবারের সদস্যদের নামানুসারে, যেমন- "প্রমিলা বৃত্তি", "বুলবুল বৃত্তি", "কাজী অনিরুদ্ধ বৃত্তি"। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে নজরুলের বইয়ের জন্য রয়েছে আলাদা কর্নার, রয়েছে নজরুলের গল্প, উপন্যাস, জীবনীসহ বিপুল বইয়ের ভাণ্ডার।
নজরুল জন্মজয়ন্তীতে সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে কবিকে স্মরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। অনুষ্ঠানে নজরুল স্মৃতি সংরক্ষণ ও গবেষণা কর্মে অবদান রাখার জন্য দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় 'নজরুল পদক।'
নজরুলের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণায় ইন্সটিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ: নজরুলের সাহিত্য কর্মের উপর উচ্চতর গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ। এই ইনস্টিটিউট থেকে প্রতি বছর নজরুল-বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ, জার্নাল, সেমিনার, কনফারেন্স, গবেষণা প্রকল্প ও বৃত্তি প্রদান করা হয়। ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজে নজরুলের বিভিন্ন গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক সর্বোপরি তার জীবনী এবং কর্মের উপর গবেষণা চলমান রাখার জন্য বিভিন্ন শাখায় পিএইচডি এবং এমফিল কোর্স চালু রয়েছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে শিক্ষা ও গবেষণা কাজে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ এবং ইরানের ফেরদৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।
এছাড়াও ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে দুই বাংলায় কবি নজরুলের নামাঙ্কিত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সমঝোতা চুক্তি। এই সমঝোতার আওতায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকরা পরস্পরের মধ্যে শিক্ষা ও নজরুল গবেষণা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
জাতীয় কবির নামে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেও বেশ সুপরিচিত। বাংলার আবহমান সংস্কৃতিকে ধারণ করেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উৎসব আয়োজিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। তাই উৎসবের আমেজ সারাবছরই লেগে থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। উল্লেখযোগ্য উৎসবগুলো হচ্ছে- নজরুলজয়ন্তী, রবীন্দ্রজয়ন্তী, কুয়াশা উৎসব, নাট্যোৎসব, চলচ্চিত্র উৎসব, পিঠা উৎসব, নজরুল বইমেলা, রস উৎসব প্রভৃতি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় শুধু অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষের কেন্দ্র নয়, বরং এটি বিদ্রোহী কবির জীবনদর্শন, সাহিত্য এবং মানবতাবাদী ভাবনার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ভবিষ্যতে এই বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলচেতনায় দীপ্ত হয়ে দেশের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে আরও অগ্রণী ভূমিকা রাখবে—এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
ইএইচ/বিআরইউ