জমিদারবাড়ির পথে

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২২, ০৫:৪২ পিএম
জমিদারবাড়ির পথে

মোঘল আমলের স্থাপত্যকলার আদলে গড়ে তোলা ইমারত বাংলাদেশে খুব একটা চোখে পড়ে না, আবার একেবারেই চোখে পড়ে না তাও বলা যাবে না। আছে। যেগুলো আছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা হয় না বললেই চলে। তার পরেও মানবসমাজের নিত্যকার মূল্যবোধ ও জনরুচির রূপান্তর, জীবনযাত্রাগত পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে এ দেশের স্থাপত্যশিল্পের কালানুক্রমিক শোভা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না।

আমি ভ্রমণপ্রিয় মানুষ, তাই যখনই কোনো পুরোনো দিনের ইমারতের কথা শুনি, তখনই চেষ্টা করি সময় সুযোগমতো ঘুরে আসতে। কথা হচ্ছিল আমার অফিসের গ্রাহক হেলাল ভাইয়ের সাথে আমাদের মোঘল আমলের স্থাপত্যকলার ইমারত প্রসঙ্গে। হেলাল ভাই আমার কথার রেশ টেনে ধরে বলেন, বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলার মধ্যে কেবল সিলেটের ছবিই যদি ফিরে দেখা হয়, দেখা যাবে এক-দেড়দশক আগেও নয়নাভিরাম যে বাড়িগুলো নগরীর আনাচেকানাচে ছিল, সেখানে এখন বহুতল অট্টালিকা। মানিক ভাই বললেন, সিলেটে কয়েকটি ভবন এখন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে; জানান দিচ্ছে আমাদের অতীত ঐতিহ্যের। ঠিক তেমন একটি ভবন সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় অবস্থিত। বর্তমানে যা রিজেন্ট পার্ক রিসোর্ট নামে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। সাথে সাথে ছক করে ফেললাম আসছে সপ্তাহেই যেতে হবে। হাবিব ভাইকে বললাম, আপনাকে আমার সঙ্গী হিসেবে থাকতে হবে। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮টা হবে মোবাইল ফোনের ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে উঠতেই হলো। ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নিলাম নতুন গন্তব্য পানে যাব বলে; অপেক্ষা শুধু মানিক ভাইয়ের জন্য। অপেক্ষার প্রহর গোনা সবচেয়ে কঠিন কাজ।


শেষ পর্যন্ত মানিক ভাইয়ের দেখা পেলাম। আমরা চললাম নতুন গন্তব্য পানে। আমাদের চার চাকার গাড়ি চলছে এগিয়ে মহাসড়ক পেরিয়ে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সেই পুরোনো দিনের রাজবাড়ির কাছে, যা বর্তমানে রিজেন্ট পার্ক রিসোর্ট নামে পরিচিত। পুরোনো আমলের চুনসুরকির দেয়াল দেখেই অনুমেয় হলো আমার চলে এসেছি আমাদের গন্তব্যে।

প্রবেশপথের দরজা খোলা হলো, দেখা পেলাম ধানক্ষেত আর পুকুরের। মানিক ভাই বললেন সদর দরজা আরও সামনে। আমি বললাম এখানেই নেমে যাই, হেঁটে ভেতরে যাই। দূর থেকে দেখতে পেলাম রাজবাড়িতে প্রবেশের সদর দরজা। শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ; নেই কোনো কোলাহল। গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যদেবের লুকোচুরি খেলা। পুকুরপাড়ে শানবাঁধানো ঘাট। কয়েক জনকে দেখলাম বড়শি দিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত। আমরা এসে পৌঁছালাম সদর দরজায়। প্রবেশ করলাম জমিদারবাড়িতে। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে কিছু দূর যেতেই হাতের ডানে দেখতে পেলাম পূজামণ্ডপ। এখানে দুর্গাপূজা হতো, তবে বর্তমানে এটি রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ খাবারের ঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন। হাতের বাঁয়েই দেখা পেলাম ধবধবে সাদা রঙের ভবনের। অসাধারণ কারুকাজ দেখেই বোঝা যায় অতীত ঐতিহ্যের।আমি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম দোতলা ঘরে। প্রতিটি ঘর যেন বহন করছে তার মোঘল আমলের স্থাপত্যকলার। আরেকটু সামনে গিয়ে পেলাম কাঠের দোতলা বাড়ি, যা এখন নেই বললেই চলে। দেখতে পেলাম গাছে আম, লিচু ধরে আছে।


এই রিসোর্টের পুরাতন দেয়াল আর ইমারতের ঘুলঘুলি দেখলে সেই সময়ের চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, সম্রাট আওরঙ্গজেব, শেখ মির্জার ছেলে বাবর, বাহাদুর শাহ, শায়েস্তা খাঁ, নূরউল্ল্যাহ খাঁ থেকে দিল্লির লোদী বংশীয় সর্বশেষ সুলতান পর্যন্ত মনে পড়ে যেতে পারে দর্শনার্থীর। সমস্ত রিসোর্ট হেঁটে এসে সানদানী পুকুরঘাটে বসলে মনে হবে ইতিহাসপাতা উল্টানো শেষ হলো। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার সময় কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য অবগত হওয়া গেল।


শোনা গেল, এই রিসোর্টের সবগুলো স্থাপনাই শত-শত বছরের পুরোনো। পঁচিশ বিঘা জমির উপর করা এই রিসোর্টটি একসময় একজন জমিদারের বাড়ি ছিল। জমিদারের নাম ছিল প্রসন্ন কুমার চত্রুবর্তী, উনার পিতা শ্রী পদ্মলোচন চত্রুবর্তী। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বছরে, ১৯৭১ সালে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে-আগে পারিবারিক সুবিধার জন্যেই ওপার-বাংলার মুসলিম জমিদার করিমগঞ্জের আব্দুল আজিজ চৌধুরীর সঙ্গে তাদের জমিদারিত্ব এবং তৎসংক্রান্ত সমস্ত সম্পত্তির বিনিময় হয়। এর পরের ইতিহাস তো বহু চড়াই-উৎরাই পেরোনো। সময়ের সেতু পার হতে-হতে বাড়িটি মানুষশূন্য হয়ে পড়ে। শূন্য বাড়িতে মাকড়সার জাল ঝুলে রয় বটের ঝুরির মতো, বয়স বাড়ে কেন্নো কীটপতঙ্গের, বানর বাদুরসহ আরও নানান পশুপাখি ঠিকানা করে নেয় ঘরের কোণে, কেউ ঘরের ছাদে, কেউ বা গাছের ডালে। এমন নিঃসঙ্গ আর শূন্য ঘরবাড়ি একনজর দেখতে একদিন দেশে ফেরেন জমিদার আব্দুল আজিজ চৌধুরীর চার ছেলের একজন মনজু চৌধুরী। দেশে ফিরলেও বাড়িতে তাদের আর থাকা হয় না, তারা শহরের কুমারপাড়ায় বাসা করে নিয়েছেন, বাসার নাম দিয়েছেন করিমগঞ্জ হাউস। একদিন পুরাতন দুই বন্ধুকে নিয়ে আসেন বাপদাদার আমলের পুরোনা বাড়িটা দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। আর এই দেখে যাওয়াটাই ছিল স্বপ্ন বুননের রাস্তা। মনজু চৌধুরী অচিরে তাঁর দুই বন্ধুর হাতে তুলে দেন পাখির নিশ্চিন্ত নীড় আর উইপোকার ঢিবিগুলো। চৌধুরী সাহেবের দুইবন্ধু মো. ফখরুজ্জামান ও হেলাল উদ্দিন তাঁদের সশ্রম মেধা ও সৃজনকুশলতা খাটিয়ে উইপোকার ঢিবিগুলোকে রূপান্তর করেন মোঘল সাম্রাজ্যের মিনিয়েচার ভার্সন হিসেবে। নাম রাখেন ‘রিজেন্ট পার্ক রিসোর্ট’। দেখতে দেখতে কীভাবে তিনটি ঘণ্টা পার করে দিলাম টেরই পেলাম না। আমাদের বিদায়ের কাল চলে এলো; আমরা ফিরে চললাম আমাদের কুটির পানে।


যেভাবে যাবেন

সিলেটের বাইরে থেকে যাঁরা আসবেন, তাঁরা শহর সন্নিকট হওয়ার বেশ আগে, সুরমা নদী পেরোনোর আগে অর্থাৎ দক্ষিণ সুরমায়, আব্দুস সামাদ ই-স্কয়ারে নেমে যাবেন। নেমেই দেখবেন সুবিশাল নর্থ-ইস্ট মেডিকেল কলেজের কম্পাউন্ড চোখে পড়বে। এখান থেকে আপনাকে নর্থ-ইস্ট মেডিকেলের সামনের দিক দিয়ে জলালপুর রোডের গাড়ি ধরতে হবে। শেয়ারের সিএনজিচালিত ট্যাক্সি করে গেলে জনপ্রতি লাগবে ১০ টাকা, টাউনবাসে করে গেলে ৫ টাকা। ট্যাক্সি কিংবা বাস বা রিকশা সবই পাওয়া যায়। ট্যাক্সি রিজার্ভ চুক্তিতে গেলেও স্কয়ার থেকে ৫০-৬০ টাকার বেশি ভাড়া লাগার কথা নয়। সিলাম রিজেন্ট পার্ক রিসোর্ট বললে যেকোনো চালকই ঠিকঠাক রিসোর্ট তোরণে নামিয়ে দেবেন আপনাকে। এই রিসোর্ট থেকে সিলেটের যেখানেই যেতে চাইবেন সহজে এবং অনায়াসেই পারবেন।