‘গণমাধ্যমে ভুয়া খবর শনাক্ত ও মোকাবিলা আমার বড় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে’

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: জুন ৫, ২০২৫, ০১:০০ পিএম
‘গণমাধ্যমে ভুয়া খবর শনাক্ত ও মোকাবিলা আমার বড় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব হওয়ার পর থেকেই গণমাধ্যমে ভুয়া খবর শনাক্ত ও মোকাবিলা প্রতিদিনকার বড় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন শফিকুল আলম।

বৃহস্পতিবার (৫ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফাইড পেজে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে এ কথা বলেন তিনি।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহার বাংলাদেশে সাংবাদিকতার সবচেয়ে সংকটজনক সমস্যাগুলোর একটি মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সেখানে লিখেন, পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রায়ই গুরুতর ভুল করে, অথচ সংশোধন করে না। কেবলমাত্র সরাসরি যোগাযোগের পর তারা সামান্য কিছু সংশোধনী আনে।

তিনি লিখেন, গতকাল (৪ জুন) সকালেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চারজন মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা নিয়ে ছড়ানো ভুয়া খবরের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়েছে। আমরা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার পরেও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম সেই মিথ্যা প্রতিবেদন সরাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নেয়, আর অধিকাংশই দুঃখপ্রকাশ পর্যন্ত করে না। তবুও এসব ভুল প্রতিবেদন এমন এক জায়গায় পৌঁছে যায় যে, ভারতীয় গণমাধ্যমসহ অনেকেই আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘পুনর্লিখনের নীতির’ (revisionist agenda) অভিযুক্ত করে।

শফিকুল আলম লিখেন, সেই রাতেই দেশের শীর্ষস্থানীয় এক সংবাদমাধ্যম “মানবিক করিডোর” (হিউমিনিটেরিয়ান করিডোর) ইস্যুতে মারাত্মক একটি অনুবাদগত ভুল করে। আমরা বারবার ব্যাখ্যা দিয়েছি যে, কোনো করিডোরের প্রস্তাব দেওয়া হয়নি তবুও তাদের ভুল অনুবাদে বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় জাতিসংঘ কূটনীতিকের মুখে মিথ্যা বক্তব্য তুলে ধরা হয়। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। একজন প্রথিতযশা রাজনীতিক সেই ভুল অনুবাদের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেন। পরবর্তীতে সেই সংবাদমাধ্যমটি চুপিচুপি প্রতিবেদনটি সংশোধন করে, কিন্তু শুরুতে তারা কোনো সংশোধনী বা দুঃখপ্রকাশ প্রকাশ করেনি, যার ফলে অন্যান্য সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষকরা ওই ভুলটি টেরই পাননি। আমাকে রাত ১২টার দিকে ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগকে ব্যক্তিগতভাবে মনে করিয়ে দিতে হয়েছিল যাতে তারা সংশোধন করে।

প্রেস সচিব লিখেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে সামাজিক ও প্রচলিত গণমাধ্যমে ভুয়া খবর শনাক্ত ও মোকাবিলা করা প্রতিদিনকার একটি বড় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভ্রান্তিকর তথ্যের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, এটি প্রতিরোধে অন্তত ২০০ জনের একটি পৃথক দল প্রয়োজন। সবচেয়ে হতাশাজনক দিক হলো, কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিশ্লেষক ও রাজনীতিকদের কোনো তথ্য যাচাই ছাড়াই বারবার মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে দেখা যায়।

তিনি আরও লিখেন, ভুয়া সংবাদের বাস্তব পরিণতি আছে। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা গণহত্যার ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তিকর তথ্য একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল—যা আজও আমাদের বৈদেশিক নীতিতে ও মানবিক সংকটে গভীর প্রভাব ফেলে চলেছে। ভুয়া তথ্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করতে পারে, এমনকি বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিতে পারে। এক গবেষক একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সামরিক কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ডের পেছনেও ‘ডাল-ভাত কর্মসূচি’ ঘিরে প্রচারিত গুজবের একটি ভূমিকা ছিল। বিশ্বব্যাপীও মিথ্যা তথ্যের কারণে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা দেখা গেছে—বিশেষত ভারতে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে।

শফিকুল আলম লিখেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে মিথ্যা তথ্য প্রচারের জন্য গণমাধ্যমগুলোকে বড় অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়। যেমন, ফক্স নিউজ ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচন নিয়ে মিথ্যা প্রচারের জন্য ৭৮৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছে। যুক্তরাজ্যের পত্রিকাগুলো নিয়মিতভাবে জননন্দিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে মিথ্যা বা মানহানিকর সংবাদ প্রচারের জন্য শাস্তির সম্মুখীন হয়। কিন্তু, বাংলাদেশে এর ঠিক উল্টো চিত্র। বিখ্যাত টিভি আলোচকরা প্রায়ই সেলিব্রেটি ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে যাচাই না করেই ভুল তথ্য প্রচার করে থাকেন। তাদের ব্যস্ত সময়সূচিতে তথ্য যাচাইয়ের সময় থাকে না, আর শাস্তির অভাবে কেউই নির্ভুল তথ্য প্রকাশে তেমন আগ্রহ দেখায় না। যখন মিথ্যা বলার জন্য কোনো শাস্তি নেই, তখন সত্য যাচাই করার আগ্রহও আর থাকে না।

ইএইচ