গুম কমিশনের প্রতিবেদন

গুম তদন্তে প্রধান বাধা ‘অস্বীকারের সংস্কৃতি’

আমার সংবাদ ডেস্ক প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০২৫, ০৮:১২ পিএম
গুম তদন্তে প্রধান বাধা ‘অস্বীকারের সংস্কৃতি’
ছবি : সংগৃহীত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত গুম সংক্রান্ত কমিশন তাদের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, ‘অস্বীকারের সংস্কৃতি’ বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় গুমের সত্য উদঘাটন ও দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে সত্য ও জবাবদিহিতার পথে একটি বড় বাধা হলো- গুম ইস্যুতে গড়ে ওঠা অস্বীকারের সংস্কৃতি।’ 

সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার বরাবরই গুমের সংগঠিত কাঠামোর অস্তিত্ব অস্বীকার করে এসেছে এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরও এই অস্বীকারের মানসিকতা ভাঙা কঠিনই থেকে গেছে, কারণ অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তি এখনো ক্ষমতার অবস্থানে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

কমিশনের ভাষ্যে, প্রমাণ নষ্ট, প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সম্ভাব্য সাক্ষীদের ভয় দেখানো এবং ভয়ভীতির সংস্কৃতি তাদের তদন্তে বাধা সৃষ্টি করেছে।

তবে পুরো কাঠামো উদঘাটনের চেষ্টা আবার সেই ভুক্তভোগীদের পুনরায় নিপীড়নের মুখে ফেলতে পারে বলেও সতর্ক করে কমিশন। যদিও তারা এ-ও বলেন যে এই কাঠামো উদঘাটনে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি, এমনটা বলা সঠিক নয়।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, অনেক ভুক্তভোগী নিজেরাই এগিয়ে এসেছেন; জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো তাদের কাহিনি তুলে ধরেছে, যার মাধ্যমে গোপন আটক কেন্দ্রগুলোর অস্তিত্ব সামনে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে এই কেন্দ্রগুলোর কয়েকটি পরিদর্শন করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয়।

কমিশনের ভাষ্যে, ‘এই গোপন কেন্দ্রগুলোর অস্তিত্ব এখন অনস্বীকার্য সত্য।’ তবে বহু নির্যাতনকারী বা সহায়তাকারী এখনো নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে কর্তৃত্বশীল অবস্থানে রয়েছেন। এই বাস্তবতা ভয়ের ও নীরব থাকার সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যা এখনো ভাঙা সম্ভব হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের বিশ্লেষিত তথ্যভাণ্ডারে অন্তর্ভুক্ত ২৫৩ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হওয়ার সময় সাধারণ ডায়েরি, মামলা কিংবা গণমাধ্যম প্রতিবেদন ছিল- যা নিশ্চিত করে যে তারা নিখোঁজ ছিলেন। পরে তারা যখন ফিরে আসেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মামলা করে- যা প্রমাণ করে তারা রাষ্ট্রীয় হেফাজতেই ছিলেন।

এই ব্যক্তিরা জীবিত এবং তারা তাদের সেই সময়কার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। অনেকে গোপন বন্দিশালায় একে অপরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং তাঁদের বর্ণনার মিল একটি সংগঠিত, কাঠামোবদ্ধ গুম নীতির প্রমাণ দেয়।

কমিশনের ভাষ্য, ‘আমরা এমন ২৫৩ জনের তথ্য পেয়েছি, যারা এক দশকেরও বেশি সময়জুড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করলেও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর মিল রয়েছে। এরা একে অপরকে চিনতেন না, অথচ তাদের অভিজ্ঞতার মিল কোনো পূর্বপরিকল্পিত যোগাযোগ ছাড়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।’

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ‘জঙ্গিবাদ দমনের ছদ্মাবরণে আওয়ামী লীগ এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী বোঝাপড়ায় গিয়েছিল, যেখানে উগ্রবাদের ভয়কে রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহতকরণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ও শাসন দীর্ঘায়িত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।’

এ লক্ষ্যে তারা বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে দলীয়করণ করে, এবং নির্যাতন ও গোপন আটককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় বলেও উল্লেখ করা হয়।

কমিশন মনে করে, এভাবে জঙ্গিবাদ দমনকে কাজে লাগিয়ে একটি দমন-পীড়নের রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল, সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের মামলার প্রবাহ বিশ্লেষণেও যার প্রমাণ মেলে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫৩ জন ভুক্তভোগীর রাজনৈতিক পরিচয় মূলত সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেও গুম হন।

সব ক্ষেত্রেই তারা একই রকম ‘আনুষ্ঠানিকতা’র মধ্য দিয়ে গেছেন, নির্যাতন, মিডিয়ায় জঙ্গি পরিচয়ে হাজির, একই ধরনের আইন প্রয়োগ ও ভাষা ব্যবহার, যা একটি সমন্বিত দমনমূলক পদ্ধতির ইঙ্গিত দেয়।

কমিশন এ-ও বলে যে ‘সন্ত্রাসবাদ সত্যিই বাংলাদেশের জন্য হুমকি’, তবে এর মোকাবেলায় সুসংবদ্ধ বিশ্লেষণ, প্রাতিষ্ঠানিক দৃঢ়তা ও সততা প্রয়োজন।

২০১৬ সালের গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার কথা উল্লেখ করে কমিশন জানায়, এটি ছিল এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত, যেখানে এক হামলাকারী ছিলেন একজন আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান। এটি প্রমাণ করে, উগ্রবাদ কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি বা দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে তারা উল্লেখ করে যে, যেসব ব্যক্তি দীর্ঘদিন গুম ছিলেন, তাদের এখন সাজানো মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা যখন আটক ছিলেন, তখন যেসব অপরাধ হয়েছে সেসব মামলার আসামি হিসেবে তাদের হাজির করা হয়েছে। এটি বিচারব্যবস্থার চরম বিকৃতি ও আইনের মৌলিক নীতিমালার লঙ্ঘন।

কমিশন স্বীকার করেছে, এই গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যেও কেউ কেউ প্রকৃতপক্ষে চরমপন্থী মতাদর্শ ধারণ করতে পারেন। কিন্তু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে কাউকে কেবল তার সংঘটিত অপরাধের জন্যই অভিযুক্ত করতে হবে।

সিনিয়র পুলিশ ও সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে কমিশন জানায়, অনেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা মনে করেন, সামরিক নির্ভর মার্কিন কৌশলের পরিবর্তে পুনর্বাসন ও প্রতিরোধকেন্দ্রিক কার্যক্রমের দিকে যাওয়াই হবে কার্যকর কৌশল।

তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল চারটি স্তম্ভে দাঁড়িয়ে- প্রিভেন্ট, পারস্যু, প্রটেক্ট ও প্রিপেয়ার। এটি প্রাথমিক হস্তক্ষেপ, সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ এবং উগ্রবাদ প্রতিরোধকে গুরুত্ব দেয়।

বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল মূলত নজরদারি ও সামরিক হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল।

কমিশনের ভাষ্যে, বাংলাদেশ গত এক দশকে যুক্তরাজ্যের ভাষাগত মডেল অনুসরণ করলেও বাস্তবে মার্কিন সামরিক নির্ভর মডেলই অনুসরণ করেছে, যেখানে গোপন আটক, নির্যাতন ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার দেখা গেছে।

প্রতিবেদন শেষে সুপারিশ করা হয়, বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল হবে একটি পূর্ণাঙ্গ, পুনর্বাসনভিত্তিক কাঠামোর দিকে অগ্রসর হওয়া, যা চরমপন্থার আদর্শিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকেই সমাধান করতে পারে। -বাসস

আরএস