সিভিএ কর্মসূচিতে ভিডিসি-শিশু ফোরাম ও কমিউনিটি আজ সক্রিয়

তানজিমুল ইসলাম প্রকাশিত: জুন ৮, ২০২২, ০২:১২ পিএম
সিভিএ কর্মসূচিতে ভিডিসি-শিশু ফোরাম ও কমিউনিটি আজ সক্রিয়

বাংলাদেশের রাজশাহী ও রংপুর অন্যতম দুটি বিভাগ। ভৌগোলিকভাবেই এখানকার মানুষেরা কিছুটা পশ্চাৎপদ বলেই ধরা হয়। তুলনামূলকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার কম হতে হয় বলেই কি-না খুব অল্পতেই তুষ্ট এ জনপদের মানুষ! 

অনেকটা শান্তিপ্রিয় পরিবেশেই বেড়ে উঠার স্বপ্ন তাদের শৈশব থেকেই। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখ  পুরো দেশ ও বিশ্বের সাথে তারাও আজ তাল মিলিয়ে চলছে। কিছুটা পশ্চাৎপদ জনপদে সমস্যা অন্ত নেই বটে, তন্মধ্যে অন্তত শিশু কল্যাণের ব্রত নিয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড? ভিশন এ দুটি বিভাগের কমপক্ষে ১৮টি উপজেলায় কাজ অব্যাহত রেখেছে যেখানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প ছাড়াও পুরো দেশে ৫৫টি উপজেলায় নিয়মিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। নিয়ম অনুযায়ী সংস্থাটির কর্ম এলাকার প্রতিটি গ্রামে একটি করে ‘গ্রাম উন্নয়ন কমিটি’ একটি করে ‘শিশু ফোরাম ও প্রয়োজন অনুযায়ী সিভিএ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে। প্রতিটি গ্রামে উক্ত কমিটিগুলো নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। 

মূলত গ্রামবাসী তাদের উদ্ভূত ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা চিহ্নিত করণের মাধ্যমে কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নিজ এলাকার উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো অনেক বেশি সক্রিয়। গ্রামের বিভিন্ন কর্নার থেকে আগত মানুষগুলো আজ সত্যিকারের স্বেচ্ছাব্রতীর মর্যাদা লাভ করেছে। 

উত্তরাঞ্চলের প্রায় আট শতাধিক গ্রামের  উন্নয়নকল্পে হাজার হাজার স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ আজ নতুন করে সুন্দর আগামীর স্বপ্নে বিভোর। ব্যক্তিজীবনে তারা কেউ গৃহিণী, কেউ কৃষক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকুরে, কেউ বা ছাত্র হলেও কালক্রমে তারা সকলের অতি প্রিয়মুখ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। উদ্যমী-উদ্যোগী এই স্বেচ্ছাব্রতী মানুষগুলোকে দেখে সমাজ পরিবর্তনের শপথ নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বেড়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ভিশনের’ কারিগরি সহযোগিতায় স্ব-প্রণোদিত এ কমিটিগুলোর সদস্যবৃন্দ মূলত শিশু কল্যাণার্থে নিজ গ্রামে নিয়মিত খানা পরিদর্শন, কার্যক্রম পরিদর্শন, পরীবিক্ষণ, মাসিক সভা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষন গ্রহণ ও প্রদানের কাজটি করে আসছে নিরলসভাবে। এক্ষেত্রে অনেকে আবার প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ইতোমধ্যে ‘শিশু সুরক্ষা’, ‘শিশু অধিকার’, ‘নেতৃত্ব বিকাশ’, ‘নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা’, ‘দল ব্যবস্থাপনা’সহ নানাবিধ বিষয়ে ওরিয়েন্টেশনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে তারা উদ্বুদ্ধও করেছেন। 

সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে এ পদক্ষেপে একদিকে যেমন জনগণের উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে, পক্ষান্তরে এটি যেন তাদের নেশায় পরিণত হয়েছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেয়ার দীপ্ত শপথ নিয়ে যারা স্বেচ্ছাব্রতী সেজেছে, তারা কি আর পিছপা হতে পারে? পিছপা হয়নি আজো। কোভিড-১৯ এর কড়াল গ্রাসে সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশও যেখানে আজ কাঁপছে থরথর, আট শতাধিক গ্রামের মহান স্বেচ্ছাব্রতী মানুষগুলো তখন আত্ম-মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে দ্বিধা করেনি।  হতাশা-দুশ্চিন্তাকে গলা টিপে হত্যা করে তারা প্রত্যেকে আজ ভয়ংকর ‘করোনা’ প্রতিরোধে নিজ নিজ অবস্থানে জনসচেতনতায় ব্যস্ত অহর্নিশ। বেলায়-অবেলায় ব্যস্ত সময় কেটেছে তাদের। সময়ের প্রয়োজনে পরিস্থিতির বিবেচনায় তারা যখন জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে একজোটে কাজ করেছে, যখন কিনা দেশের অনেক স্বার্থপর জনগোষ্ঠী কেবল নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত।

সাধারণ জনগণের কল্যাণার্থে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করার জন্য অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তারাই যথাযথ উপকারভোগী নির্বাচনে ভূমিকা রাখে। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষগুলোর নেতৃত্বে প্রতিটি গ্রাম, উপজেলা, জেলা আজ নতুনভাবে আলোকিত হচ্ছে। এখন আর আগের মতো শিশু নির্যাতন, নারী নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতনের খবর পাওয়া যায় না অথবা সংবেদনশীলতার ফলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। গ্রামের সরল মানুষগুলোর মধ্যে আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করছে এসব ‘গ্রাম উন্নয়ন কমিটি’, শিশু ফোরাম ও সিভিএ ওয়ার্কিং গ্রুপ। সুহূদ ঐ আত্মত্যাগী মানুষেরা আজ আবাল-বৃদ্ধবনিতার কাছে যেন এক আপন ঠিকানা। 

ইতোমধ্যে পুরো বছরজুড়ে স্ব-উদ্যোগে তারা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে নিজেকে ব্রত করেছে, আজকাল এসব কর্মএলাকায় বাল্যবিয়ে পড়ানোতে ঘোর আপত্তি কাজি সমপ্রদায়ের। যারা ইতিপূর্বে অনেক গণসচেতনতামূলক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাই এখন নিজ গ্রামের বাইরে দূরে কোথাও পালিয়ে বাল্যবিয়ে সংঘটিত হচ্ছে, এক্ষেত্রে শিশু ফোরাম কিংবা ভিডিসির কিছুই করার করার থাকেনা।  

শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনায় ওয়ার্ল্ড ভিশন ‘সিটিজেন ভয়েস অ্যান্ড অ্যাকশন (সিভিএ)’ নামক অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোগী জনগণকে সম্পৃক্ত করে। ‘সিভিএ’ অথবা ‘সামাজিক জবাবদিহিতা’ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ্রোচ, যার মাধ্যমে সেবাগ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী উভয়পক্ষকে একই প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করা যায়। বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ভিশন মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকায়ন, শিশু সুরক্ষা বিষয়ে সিভিএ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সেবাগ্রহীতার জন্য বরাদ্দকৃত সেবা নিশ্চিত করতে সেবাগ্রহীতাসহ স্থানীয় জনগণ এতে অংশগ্রহণ করে। সিভিএ  ওয়ার্কিং গ্রুপকে মৌলিক বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাধারণ সভায় তাদের সমস্যার ইস্যু নির্ধারণ করে। ধাপে ধাপে সরকারি পরিষেবা সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা পায়। এমনি করেই সিভিএ ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্যবৃন্দ অতি সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছায়, সরকারি পরিষেবা নিশ্চিতকরণের জন্য নির্ধারিত মনিটরিং স্ট্যান্ডার্ডসমূহের মাধ্যমে তাদের সন্তুষ্টির মান যাচাই করেন। 

পরবর্তীতে সিভিএ ওয়ার্কিং গ্রুপের আয়োজনে ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, অভিভাবক, শিক্ষক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি, স্থানীয় সাধারণ জনগণ, ছাত্রছাত্রী, পুলিশের কর্মকর্তা, গ্রাম উন্নয়ন কমিটি, শিশু ফোরামের সদস্য এমনকি অতি সাধারণ মানুষের মুখোমুখি হয়। ন্যায্যতার ভিত্তিতে সিভিএ ওয়ার্কিং গ্রুপ উক্ত ইন্টারফেইস মিটিংএ ‘শ্রেণিকক্ষের অপ্রতুলতা, সীমানা প্রাচীর না থাকা ও পয়নিষ্কাশন ব্যববস্থার সীমাবদ্ধতা, স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা ও বিভিন্ন আইনের সীমাবদ্ধতা ও প্রয়োগসহ শিশু সুরক্ষা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের করণীয় সম্পর্কে তুলে ধরেন। পুরো প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ওয়ার্ল্ড ভিশন কেবলমাত্র ওয়ার্কিং গ্রুপকে প্রশিক্ষণ পদান করে থাকে। এ বছর ৩৬টি কমিটিতে প্রায় ৬৩৪ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। 

পরবর্তীতে তারা সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহে কার্যকরী যোগাযোগ স্থাপন করে। প্রয়োজন অনুসারে আজ তারা অবলীলায়, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, এসএমসির সভাপতি, ইউএইচ অ্যান্ড এফপিও, শিক্ষা অফিসার, থানায় কর্মরত পুলিশের সাথে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করে থাকে। আর এ জন্য তারা উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। ইতোমধ্যে শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনায় তারা নানাবিধ সরকারি সেবা নিশ্চিতকরণে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। এখানেই তাদের উন্নয়নের জয়রথ থেমে থাকেনি। তারা প্রতি বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রনয়ণসহ চলমান কর্মসূচি ফলোআপ করছে খুব নিবিড়ভাবে। তারা এ বছর অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের তরফ থেকে অনুদান প্রাপ্তির অগ্রিম স্বীকৃতি/প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে। 

এছাড়া সংশ্লিষ্ট থানায় কর্মরত পুলিশদের আন্তরিক সহযোগিতা লাভ করেছে খুব উল্লেখযোগ্যভাবে, যেখানে ইতোপূর্বে তারা থানা প্রাঙ্গণে যেতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। আশা করা যাচ্ছে অতি শিগগির ওয়ার্ল্ডভিশনের কর্মএলাকার প্রতিটি গাঁয়ে নতুন করে আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে পড়বে। আগামী দিনের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সেদিন নিশ্চয়ই অনুকূল পরিবেশে বেড়ে উঠবে। তবেই সার্থক হবে আজকের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। শিশুর কল্যাণার্থে অগ্রণী ভূমিকা রাখা উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনের ‘সিভিএ’ অ্যাপ্রোচও হয়তো শিগগির খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। সেদিন হয়তো আর দূরে নয়। এমনি করেই সামাজিক জবাবদিহিতার মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাবে নতুন ও সুন্দর দিনের। এমনি করে চলমান অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিয়ে সিভিএ ওয়ার্কিং গ্রুপ একত্রিত হতে পারে ভিন্ন কোন বৃহৎ প্ল্যাটফর্মে! ‘সিভিএ (সিটিজেন ভয়েজ অ্যান্ড অ্যাকশন)’ অথবা ‘সামাজিক জবাবদিহিতা’র মতো গুরুত্বপূর্ণ কোন অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতা ও সেবাপ্রদানকারী মহলকে বিনিড়ভাবে সংবেদনশীল করতে পারি, আমরাও। আসুন, তার আগে নিজেরাই সংবেদনশীল হই। 

১৮টি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে শিশু ফোরাম, ভিডিসি ও সিভিএ ওয়ার্কিং গ্রুপ আজ ব্যপক সু-পরিচিত! অনেক ক্ষেত্রে তারা এলাকায় পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় শিশু সুরক্ষায় তাদের অবদান সত্যিই অনস্বীকার্য। প্রয়োজনের তাগিদেই তারা আজ ইউনিয়ন পেরিয়ে উপজেলা, এমনকি জেলা পর্যায়ের প্রশাসনের কাছেও ছুটে চলে, কাজ করেন সমন্বিত উদ্যোগে। মাতৃভূমিপ্রেমী এই স্বেচ্ছাব্রতী মানুষগুলো স্বপ্ন দেখে ‘এলাকার মানুষ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সুস্থ ও শান্তিতে বেঁচে থাকবে। আজকের কোমলমতি প্রজন্ম আদর্শ জাতি হিসেবে নিজেকে বিকশিত করবে।’ হয়তো সেদিন সন্নিকটেই.... অথবা অন্য কোন স্বেচ্ছাব্রতী জনগোষ্ঠী এর হাল ধরবে, নিখাদ-নির্লোভ এই স্বেচ্ছাব্রতী মানুষগুলো অন্তর থেকে ‘ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের প্রতি তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা কামনা করে সবসময়। পক্ষান্তরে, ওয়ার্ল্ড ভিশন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, তার কর্ম এলাকার হাজার হাজার গ্রামের নিবেদিত প্রাণগুলোর এমন মহতী ও আত্মত্যাগী উদ্যোগের ফলে আগামী প্রজন্মের কাছে তারা বেঁচে থাকুক যুগ-যুগান্তর। হয়তো সেদিন ওয়ার্ল্ড ভিশন তার নোঙর ভেড়াবে অন্য কোন গাঁয়ে, উপজেলায় অথবা জেলায় — সাক্ষী হয়ে বহমান রবে মনোবীনার সমস্ত আয়োজন।  

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক