বাংলাদেশে বন্যা একটি পুনঃপুন সংঘটিত ঘটনা। বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাস এ দেশের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমপ্রতি বাংলাদেশের উত্তর পূর্বে সিলেট সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। এই দুই জেলায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রশাসনের হিসাবে বলা হচ্ছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে সুনামগঞ্জ শহর পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বর্ষণের কারণে ১২ ঘণ্টাতেই সুনামগঞ্জে চার ফুট পানি বেড়ে যায়। চেরাপুঞ্জিতে ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ১২২ বছরে এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড। সেই বৃষ্টির পানি খুবই দ্রুতগতিতে সুনামগঞ্জ এবং সিলেট অঞ্চলে নেমে এসেছে। সে জন্য বন্যা অল্প সময়ে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সুনামগঞ্জ শহর পানিতে ডুবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পুরো দেশ থেকে। সুনামগঞ্জে দুটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পুরো জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।
মোবাইল নেটওয়ার্কও কাজ করছে না। বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধারে সিলেট এবং সুনামগঞ্জের আটটি উপজেলায় সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গ কি.মি. অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড বন্যাকবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সমগ্র দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখণ্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। বাংলাদেশে বন্যার সংজ্ঞা স্বতন্ত্র।
বর্ষাকালে যখন নদী, খাল, বিল, হাওর ও নিচু এলাকা ছাড়িয়ে সমস্ত জনপদ পানিতে ভেসে যায় এবং ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সহায়-সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে, তখন তাকে বন্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বন্যার সঙ্গে ফসলের একটা সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যাকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় ক. মৌসুমি বন্যা : এই বন্যা ঋতুগত, নদনদীর পানি ধীরে ধীরে উঠানামা করে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। খ. আকস্মিক বন্যা : আকস্মিক পাহাড়ি ঢল অথবা স্বল্প সময়ে সংঘটিত প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে কিংবা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট বাঁধ ভেঙে এ ধরনের বন্যা সংঘটিত হয়; এবং গ. জোয়ারসৃষ্ট বন্যা : সংক্ষিপ্ত স্থিতিকাল বিশিষ্ট এই বন্যার উচ্চতা সাধারণত তিন থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং ভূ-ভাগের নিষ্কাশন প্রণালিকে আবদ্ধ করে ফেলে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর বাৎসরিক সম্মিলিত বন্যার প্রবাহ একটিই নির্গম পথ অর্থাৎ লোয়ার মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে।
এ কারণে লোয়ার মেঘনার ঢাল ও নিষ্ক্রমণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। নদীর পানির স্তরের এই উচ্চতার প্রতিকূল প্রভাব সারা দেশেই পড়ে। কারণ বন্যার পানি নিষ্ক্রমণের অবস্থা ও ক্ষমতা দুটোই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে ছোট ছোট নদীর প্রবাহ কমে যায় এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানির আভিকর্ষিক নিষ্ক্রমণ শুধুমাত্র বন্যার উপরে জেগে থাকা ভূমিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। নিষ্ক্রমণ প্রতিবন্ধকতার কারণে সৃষ্ট বন্যা দেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের উঁচুভূমি ও পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান।
দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ডান দিকের প্লাবনভূমিগুলোকে রক্ষা করছে। উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে পার্বত্য পরিবাহ নিষ্ক্রমণ আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে। দক্ষিণ-মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকাংশ স্থানে বন্যা জোয়ারভাটা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস ও অপর্যাপ্ত নিষ্ক্রমণ দ্বারা প্রভাবিত। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের নিষ্ক্রমণ ব্যবস্থা গঙ্গার পলি আবৃত সাবেক শাখা নদীগুলোর মাধ্যমেই প্রধানত চালু আছে। অগভীর বন্যার প্রাদুর্ভাব এ অঞ্চলে খুব বেশি।
বাংলাদেশের বন্যা সংঘটনের জন্য দায়ী কারণগুলো হচ্ছে : ১. সাধারণভাবে নিম্ন উচ্চতাবিশিষ্ট ভূ-সংস্থান যার উপর দিয়ে প্রধান প্রধান নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীগুলো তাদের শাখা-প্রশাখা এবং উপনদীর সমন্বয়ে ঘন বিন্যস্ত নিষ্কাশন জালিকা গড়ে তুলেছে; ২. দেশের বাইরে নদ-নদীর উজান এলাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে ভারী বৃষ্টিপাত; ৩. হিমালয় পর্বতে তুষার গলন এবং প্রাকৃতিকভাবে হিমবাহের স্থানান্তর সংঘটন; ৪. পলি সঞ্চয়নের ফলে নদনদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, নদীর পার্শ্বদেশ দখল হয়ে যাওয়া ও ভূমিধস সংঘটন; ৫. প্রধান প্রধান নদীসমূহে একসঙ্গে পানি বৃদ্ধি এবং এক নদীর ওপর অন্য নদীর প্রভাব বিস্তার; ৬. প্রকৃতির ওপর মানবীয় হস্তক্ষেপ; ৭. জোয়ার-ভাটা এবং বায়ুপ্রবাহের বিপরীতমুখী ক্রিয়ার ফলে নদ-নদীর সমুদ্রমুখী প্রবাহ ধীরগতি প্রাপ্ত হওয়া; ৮. সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া; ৯. ভূ-গাঠনিক বিশৃঙ্খলা অর্থাৎ ভূমিকম্প, নদীর প্রবাহ ও ভূরূপতত্ত্বে পরিবর্তন; ১০. সম্ভাব্য গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি।
প্রতি শতাব্দীতে বঙ্গীয় বদ্বীপ প্রায় অর্ধডজন বন্যার মুখে পড়েছে, ব্যাপকতায় যা ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যার প্রায় সমান। ১৯৮৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বন্যায় ভয়ংকর বিপর্যয় হয়। প্রায় ৮২ হাজার বর্গ কি.মি. এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ ধরনের বন্যা ৫০-১০০ বছরে একবার ঘটে। বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে তিন দিনের মধ্যে দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ একই সময়ে ঘটার ফলে বন্যার আরও ব্যাপ্তি ঘটে। রাজধানী ঢাকা শহরও প্লাবিত হয়। বন্যার স্থায়িত্ব ছিল ১৫ থেকে ২০ দিন। ১৯৯৮ সালে সমগ্র দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এলাকা দুই মাসের অধিক সময় বন্যাকবলিত হয়। বন্যার ব্যাপ্তি অনুযায়ী এটি ১৯৮৮ সালের বন্যার সাথে তুলনীয়।
ব্যাপক বৃষ্টিপাত, একই সময়ে দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ ঘটার ফলে ও ব্যাক ওয়াটার অ্যাফেক্টের কারণে এই বন্যা ঘটে। বন্যা-ব্যবস্থাপনা বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্পগুলো বাঁধ, পোল্ডার ও অভিকর্ষিক পরিবাহীর ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল। বন্যা ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত পদ্ধতির ওপর অতি নির্ভরশীলতা এবং একই সঙ্গে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথের মতো অন্যান্য স্থাপনা সমূহ পানির প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে।
এদের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে দেশে বন্যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্পসমূহে প্রচুর পরিমাণ বিনিয়োগ সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে ফলাফল সন্তোষজনক নয়। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যা ব্যাপক ধ্বংসের দুর্ভোগ ও প্রাণহানির কারণ হয়। পর পর দুই বছর এই বন্যার ফলে সরকার পুনঃপুন বন্যা সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপক ও স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্রতী হয়।
এ লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জরিপ চালানো হয়, যার ফলশ্রুতিতে ১৯৮৯ সালে বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা প্রণীত হয়। বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি হ্রাস করার ব্যাপারে কয়েকটি প্রস্তাব করা হয়। অবশ্য এসব প্রস্তাবের অধিকাংশই ছিল গঙ্গা নদীকেন্দ্রিক, যদিও বন্যা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের নির্গমনের মাত্রা গঙ্গা নদীর চেয়ে বেশি।
বর্তমানে বাংলাদেশ বন্যার হাত থেকে জনবসতি ও ফসলি জমি রক্ষার জন্য প্রতিবছর এক লাখ ৩০ হাজার হেক্টর হারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের কৌশল অনুসরণ করছে। মুনাফা ও নিরাপত্তার দিক থেকে এর উপকারিতা ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যদিও দীর্ঘমেয়াদে এর পরিবেশগত প্রভাব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।
বন্যার ক্ষতি ও প্রতিকূল প্রভাব হ্রাস করতে ও অতিরিক্ত পানি সেচকার্যের ব্যবহারের উদ্দেশে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু সংখ্যক বাঁধ তৈরি করেছে ও খাল খনন করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : জি-কে (গঙ্গা-কপোতাক্ষ) প্রজেক্ট, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) প্রজেক্ট, কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্প, উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প, উত্তরবঙ্গের নলকূপ প্রকল্প, ব্রহ্মপুত্র বাঁধ, চাঁদপুর সেচ-প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা প্রকল্প, মনু নদী প্রকল্প, খোয়াই নদী প্রকল্প, পাবনা সেচ প্রকল্প, গোমতী প্রকল্প, মহুরী বাঁধ প্রকল্প, তিস্তা বাঁধ প্রকল্প (পর্যায়-১), ঢাকা সমন্বিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, প্রণালি পুনর্বাসন প্রকল্প এবং জরুরি বাস্তবায়ন প্রকল্প।
উপরোল্লিখিত কাঠামোগত পদক্ষেপসমূহ ছাড়াও বন্যা প্রশমন প্রক্রিয়া ও ক্ষয়-ক্ষতি হ্রাসের একটি বিকল্প কৌশল হিসেবে অ-কাঠামোগত পদক্ষেপের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। অ-কাঠামোগত পদক্ষেপ বলতে বন্যা মোকাবিলায় সামাজিক অভিযোজনকে বোঝানো হচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে : ১. জনগণ যাতে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে সে লক্ষ্যে বন্যার পানির উচ্চতা বৃদ্ধির যথেষ্ট সময় পূর্বে জনগণের কাছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে জোরদার করা; ২. নদ-নদীর উপচে পড়া পানি হ্রাসের লক্ষ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনা সাধন।
এ উদ্দেশ্যে বনায়ন এবং পুনর্বনায়নের সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ ও তার যথাযথ সংরক্ষণ যাতে পরিশোষণ প্রক্রিয়া বৃদ্ধির মাধ্যমে বন্যার পানির উচ্চতা হ্রাস ঘটতে পারে। ৩. ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন এবং বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগ, শস্য উৎপাদন বহুমুখীকরণ তথা, বন্যা প্রতিরোধী বা বন্যা সহনক্ষম শস্য চিহ্নিতকরণ ও রোপণ করা এবং শস্য রোপণ মৌসুমের অভিযোজন; ৪. প্লাবনভূমিসমূহকে বিভিন্ন জোনে বিভক্ত করা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভূমি ব্যবহার জোন তৈরি করা।
অ-কাঠামোগত পদক্ষেপসমূহ স্বল্প ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যেহেতু বন্যা ব্যবস্থাপনা সার্বিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেহেতু আঞ্চলিক সহযোগিতা পানি প্রতিবেশ ব্যবস্থার স্থায়ী সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষে অতি প্রয়োজনীয় যৌথ কলাকৌশলের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে।
লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়