বুলিং একটি অপরাধ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন

ড. জান্নাতুল ফেরদৌস প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২২, ০৫:০৫ পিএম
বুলিং একটি অপরাধ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন

বুলিং বলতে আমরা বুঝি দুজন ব্যক্তির মধ্যে তর্ক বা কথা কাটাকাটির জের ধরে একজন ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে সবার সামনে দোষারোপ বা খারাপ ভাষায় আক্রমণ করাকে বুঝি। আবার একজনের ছবি বা ভিডিও বিকৃত করে অনলাইনে তুলে ধরাও বুলিংয়ের মধ্যে পড়ে। কেউ আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন করলে (এমনকি বর্ণ বৈষম্যমূলক মন্তব্য করলেও) সেটিও বুলিংয়ের আওতায় পড়ে। এটি একধরনের সাইবার অপরাধ। তবে এসব অপরাধ দমনে আইন রয়েছে দেশে। দরকার শুধু সচেতন থাকা।

শুধু অনলাইন মাধ্যমে নয়, এমনকি ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কাউকে মানসিক বা শারীরিকভাবে হেনস্তা করা, অপমান অপদস্থ করা, সবার সামনে হেয় করা, কাউকে (সাধারণত সমবয়সি) অপদস্থ করে মজা করা ইত্যাদি কাজও বুলিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মাতামাতি করা, টিটকারি করাও বুলিংয়ের আওতায় পড়ে। অনলাইনের বদৌলতে যেটি এখন আরও সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনলাইনে কারও ছবি, ভিডিও শেয়ারের মাধ্যমে হেনস্তা করা, হুমকি দেওয়াও বুলিং। একে সাইবার বুলিং বলে।

সাইবার বুলিং: বৈশিষ্ট্য, কারণ
সাইবার বুলিং বা ভার্চুয়াল হয়রানি একটি আক্রমণাত্মক এবং ইচ্ছাকৃত কাজ যা বারবার সম্পাদিত হয়, কোনও গোষ্ঠী বা কোনও ব্যক্তির দ্বারা। মূলত ভার্চুয়াল এই দুনিয়ায় খুব সহজেই চাইলে নিজের পরিচয় গোপন রাখা যায়। যার জন্য প্রতিনিয়িত সাইবার বুলিংএর শিকার হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন মহলের ব্যক্তিরা।

বাংলাদশে সাইবার বুলিং সবথেকে বেশি আক্রমণের শিকার হচ্ছে নারীরা। স্ট্যাটিস্টা তথ্য মতে বাংলাদেশের শতকরা ৭৬ শতাংশ নারী বিভিন্ন সময় আনলাইনে সাইবার বুলিংএর শিকার হচ্ছেন।

ইউনিসেফের এক জরিপ অনুযায়ী, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ৩৮ শতাংশ মানুষের বয়স ১০ থেকে ১৩ বছর; ৩৬ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ১৫ বছর এবং ২৫ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর। ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে? বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের ওপর চালানো এক জরিপের বরাত দিয়ে ২০১৭ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়- এসব দেশে সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এবং নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে বুলিংয়ের।

ভুক্তভোগী নারীর সংখ্যা বেশি
২০২০ সালের নভেম্বরে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন যাত্রা শুরু করে। প্রথম বছরে এই ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ১৭ হাজার ২৮০ জন নারী। তাঁদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার।

গত বছর ঢাকায় ৯০০-এর বেশি ঘটনা নিয়ে কাজ করেছে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। তাদের হিসাবে, সাইবার বুলিংয়ে নারী ও পুরুষের অনুপাত সমান। তবে ‘সেক্সটরশন’-এর (অন্তরঙ্গ ছবি/ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া) ক্ষেত্রে নারীরা ভুগছেন বেশি।

পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, টাকা না দিলে অন্তরঙ্গ ছবি/ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় পুরুষ ভুক্তভোগীর সংখ্যা ছিল ২৩, অন্যদিকে নারীর সংখ্যা ছিল চার গুণের বেশি, সংখ্যায় ১০০। ভুয়া আইডি থেকে সাইবার বুলিংয়ের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪৯, নারীর সংখ্যা ছিল ১০০। তবে আইডি হ্যাকের শিকার হয়েছেন বেশিসংখ্যক পুরুষ, মোবাইল ব্যাংকিংয়েও পুরুষই বেশি ঠকেছেন।

সাইবার বুলিং থেকে যেসকল উপায়ে বেঁচে থাকা যেতে পারে।
পিতামাতা কিংবা বড়দের জানান।
বুলিংয়ের শিকার একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ ঘটনার বিষয়ে দ্রুততার সাথে অভিজ্ঞদের সাথে বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতা অনেক বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

বুলি চিহ্নিত করুন
আপনার পরিচিত এমনকি অপরিচিত যেকেউ কি কারণে আপনাকে বিরক্ত করছে বিষয়টি খুজে বের করুন। একইসাথে কোন কোন শব্দ কিংবা উপায়ে আপনাকে বুলিং করছে সেটি নির্ণয় করুন।

বুলিকে ব্লক করুন
যাদেরকে বা যাকে চিহ্নিত করতে পারবেন প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে তাকে ব্লক করে রাখুন।

বার্তা সংরক্ষণ করুন
যেসকল বার্তা, ছবি কিংবা অন্যান্য তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে বুলিং করা হয়ে থাকে সেগুলো সংরক্ষণ করুন। এমন কোন পোস্ট থেকে থাকলে সেটিও সংরক্ষণ করুন। এগুলো আইনি পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে।

স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিন
যে বা যিনি পরিচিত অপরিচিতদের মধ্যে থেকে একাজে জড়িত হবেন, তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীকে অবশ্যই সাথে সাথে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করুন। এতে পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ হবে।

কিছু কৌশল অবলম্বন করে সাইবার বুলিং নামক ভয়ংকর বিপদ থেকে বেঁচে থাকা যেতে পারে-
১. সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে কোনও অজানা ব্যক্তির বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করবেন না ।
২. ব্যক্তিগত তথ্য যেমন জন্ম তারিখ, ফোন নম্বর সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে কারো সাথে শেয়ার করবেন না।
৩. আপনার মোবাইল বা কম্পিউটারে কখনোই অবাঞ্ছিত সফ্টওয়্যার ইনস্টল করবেন না ।
৪. যদি কেউ আপনাকে একটি অশ্লীল বার্তা পাঠায়, একটি আক্রমণাত্মক উত্তর দিয়ে প্রতিক্রিয়া করবেন না৷
৫. খুব সাবধানে ও সতর্কতার সাথে ফেসবুক ব্যবহার করা উচিত।

বুলিংয়ের শিকার ব্যক্তির যত্নে দায়িত্বশীলদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনায় রাখতে হবে। এরমধ্যে-
১. সন্তানের প্রতি লক্ষ রাখা
২. সন্তানের সাথে নিয়মিত কথা বলা
৩. সাপোর্ট করুন ভিক্টিমকে
৪. প্রতিকারের চেষ্টা করা

অনলাইনে সহিংসতা ও সাইবার হয়রানির শিকার হলে আইনি সহায়তা নেওয়ার জন্য কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সাইবার পুলিশ সেন্টার, হ্যালো সিটিঅ্যাপ, রিপোর্ট টু র‌্যাব অ্যাপ, ৯৯৯ এবং প্রতিটির ফেসবুক পেজেও অভিযোগ করতে পারেন। শিশুদের সহায়তায় ১০৯৮ নম্বরে, নারী ও শিশুদের সহায়তায় ১০৯ হটলাইনে ফোন করেও সেবা নেওয়া যায়।

তবে সাইবার বুলিং থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের সর্বাধিক সচেতনতাই একমাত্র উপশম হতে পারে।  কারণ বাস্তবিক জীবনে আপনার একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য কি সবার সাথে শেয়ার করেন? তাহলে অনলাইনে কেনো? ইন্টারনেটের দুনিয়ায় শেয়ার করা আপনার পার্সোনাল ইনফরমেশন অনেক ক্ষেত্রে আপনার জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তবে সতর্ক থাকাও চাইলেই সম্ভব। অনলাইনে নিজের পুরো নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল আইডি কিংবা পাসওয়ার্ড শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

এছাড়া নিরাপদ থাকতে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। লোকেশন সেটিং বন্ধ রাখার মাধ্যমে নিজের অবস্থান না জানানোই ভালো। আপনার পোস্ট কারা দেখতে পারবে তা ঠিক করে দিতে পারেন। টু-স্টেপ ভেরিফিকেশন চালু রাখতে হবে। ই-মেইল আইডি বা ফোন নম্বর দিয়ে কেউ খোঁজার চেষ্টা করলে পাবে কি না তা ঠিক করে দিতে হবে।

প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উপায়ে আপনার শেয়ার করা ব্যক্তিগত তথ্যের ভুল ব্যবহার হতে পারে। তাই অনলাইন সেফটি সম্পর্কে জানতে হবে এবং ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক: ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

কেএস