খেঁজুর গাছ-রসের স্বাদ পেতে ঐতিহ্য রক্ষা জরুরি

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২২, ০১:৫২ পিএম
খেঁজুর গাছ-রসের স্বাদ পেতে ঐতিহ্য রক্ষা জরুরি

খেজুর গাছ ছয়-সাত বছর বয়স থেকে রস দেওয়া শুরু করে। ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত রস দেয়। গাছ পুরনো হয়ে গেলে রস কমে যায়। আর পুরনো খেজুর গাছের রস খুব মিষ্টি হয়। মাঝ বয়সী গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করা গাছের জন্য আবার অনেক ক্ষতিকর। রস সংগ্রহের জন্য কার্তিক মাসে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়। কার্তিক মাস থেকে রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাগুন মাস পর্যন্ত। শীতের সঙ্গে রস ঝড়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শীত যত  বেশি পড়বে রস তত বেশি ঝরবে। রসের স্বাদও তত মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ মাস হলো রসের ভরা মৌসুম।

এই বুনো গাছটির রসে চুমুক দেওয়ার মজাটাই আলাদা। এই শীতের কুয়াশা ঢাকা সকালে গ্রামে ঘুম থেকে খুব ভোরে উঠে হাত পা মুখ ধুয়ে খড়- কুটোয়ে আগুন জ্বালিয়ে হাত-পা গরম করার মতোই আনন্দের খেজুর রস। রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হবে গুড়। সেই গুড়ের আবার রকম ফের আছে। যেমন পাটালি গুড়, ঝোলা গুড়। এসব গুড় বিভিন্নভাবে খাওয়া হয়। শীতে খেজুর গাছের রস থেকে যে গুড় তৈরি হয় তা দিয়ে দুধের পিঠা, পুলি পিঠা, সেমাই পিঠাসহ আরো কত পিঠাই না তৈরি করা হয়। পাঠালি গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া খাওয়া ও ঝোলা গুড় দিয়ে মচমচে মুড়িও গ্রাম বাংলার  একটি পরিচিত খাবার। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি রসের পিঠা খুবই সুস্বাদু হয়ে থাকে। আর খেজুর গুড়ের প্রচলিত সন্দেশও হয়। রস সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি বেশ শ্রমসাধ্য। গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের শাখা কেটে ছেঁচ পরিষ্কার করে সেই কাটা অংশের নিচে বরাবর দুটি খাস কাটার প্রয়োজন পড়ে। সে খাস থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা হয়। এই সরুপথের নিচে বাঁশের তৈরি নলি বসানো হয়। এই নলী বেয়ে হারিতে রস পড়ে। নলির পাশে বাঁশের তৈরি খিল বসানো হয় ।সে খিলে মাটির হাড়ি টাঙ্গিয়ে রাখা হয়। বিকাল থেকে হাঁড়িতে রস জমা হতে হতে সারা রাত্রিতে হাড়ি পূর্ণ হয়ে যায়। গাছ কাটার পর দুই তিন দিন রস পাওয়া যায়  প্রথম দিনের রসকে বলে জিরান কার্ড। জিরান কার্ড রস খুবই সুস্বাদু। প্রথম দিনের রস থেকে ভাল পাঠালি গুড় তৈরি হয়। দ্বিতীয় দিনের রসকে বলে দোকাট। তৃতীয় দিনে রসকে বলে তেকাট। রসের জন্য খেজুর গাছের একবার কাটার পর আবারও ৫-৬ দিন পরে কাটতে হয়। গাছের কাঁটা অংশ শুকানোর জন্য এ সময় দেওয়া প্রয়োজন পড়ে। খেজুর গাছ কাটা অংশ শুকানোর সুবিধার জন্যই সাধারণত পূর্ব পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলো সরাসরি কাটা অংশে পড়ে।

গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়। হারিকে কেউ কেউ ভাড়ও বলে থাকেন। ভাড়টি খুব ছোট আকৃতির হয়ে থাকে। মাঝারি আকৃতির ১০ বা ১৫ ভাড় রস জ্বাল দিয়ে এক ভাড় গুড় হয়। সে এক ভাড় গুড়ের ওজন ৬ থেকে ৮ কেজির মত হয়ে থাকে। গুড় তৈরির জন্য রস জাল দেওয়া হয় মাটির জালায়  বা টিনের তাফালে। খুব সকালে রস নামিয়ে এনেই জ্বালানো হয়। জাল দিতে দিতে এক সময় রস ঘন হয়ে গুড় হয়ে যায়। এগুলোর কিছু অংশ তাফালের এক পাশে নিয়ে বিশেষভাবে তৈরি একটি খেজুর ডাল দিয়ে ঘষতে হয়।ঘষতে ঘষতে শক্ত হয়ে যায়। আর শক্ত অংশকে আবার কেউ কেউ বীজ বলে থাকে। বীজের সঙ্গে তাপালের বাকি গুড় মিশিয়ে স্বল্পক্ষণের মধ্যে গুড় জমাট বাঁধতে শুরু করে। তখন এ গুড় মাটির হাড়ি বা বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে রাখার প্রয়োজন পড়ে। সে গুড় দেখলে বুঝা যাবে, একেবারে জমাট বেঁধে পাত্রের আকৃতি ধারণ করেছে।

তাছাড়া সারাদেশে খেজুর গুড়ের একটি অর্থনৈতিক উল্লেখযোগ্য দিকও আছে। খেজুর রস বা খেজুর গুড় এদেশের খাদ্য সংস্কৃতির একটি অবধারিত অংশ । প্রাচীন প্রাচীন কাল  থেকে চলে আসা এই খেজুর রস, খেজুর গুড় দেশের প্রতিটি মানুষের প্রতি বছরের স্মৃতি। শীত মানেই খেজুর রস; খেজুর রস ছাড়া যেন শীতটা জমতেই চায় না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, শীতের এই অবধারিত উপাদানের উৎসব, খেজুর গাছ, যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। খেজুর গাছ ও রসের স্বাদ ও সংস্কৃতি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি মনে করছি এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে সময়ের দাবি।

লেখক: সাংবাদিক গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, বুড়িচং, কুমিল্লা।

এসএম