সাধারণত ‘মানুষ’ হিসেবে যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণ, প্রতিষ্ঠা, চর্চার বিষয়টিকেই ‘মানবাধিকার’ মনে করা হয়। মানবাধিকারের হলো মানুষের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়, যা সকল মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার। অতএব, এক কথায় আমরা বলতে পারি মানুষের জীবন, অধিকার, সমতা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ সুবিধাগুলোই মানবাধিকার। গবেষণায় জানা যায়, মানবাধিকারের ধারণাটি সর্ব প্রথম এসেছে আঠারো শতকে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশকালের ফসল হিসেবে।
তবে কি সময়ের প্রয়োজনেই বিশ্বব্যাপী এই দিবস আজ একবিংশ শতাব্দীতেও এত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন জাগে, এই মানবাধিকার বা মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা, এত আলোচনা? কেনই বা প্রতি বছর ‘মানবাধিকার’ নামক একটি দিবস পালিত হয়? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধ্বংসযজ্ঞের অভিজ্ঞতা থেকে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক একটি সনদ হিসেবে সর্বসাধারণের মৌলিক অধিকারের ধারণার বিকাশ ঘটে যা আজ ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’ (ইউডিএইচআর) International Declaration of Human Rights (UDHR) নামে পরিচিত।
বর্তমানে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে বিশেষ করে যে কোন বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকারের ধারণা যেন একটি প্রাথমিক কাঠামোগত ভিত্তি হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত; যেখানে মানব সত্তার মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। ইউডিএইচআর-এর ১নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে যে, ’সকল মানুষই স্বাধীন অবস্থায় সম-মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের সমতা, ন্যায্যতা, অধিকার, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সবার আগে যেটি প্রয়োজন, তা হলো মানবিকতা। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। এটি কেউ কখনো কারো কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে না। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয়।
সেখানে মানুষের মৌলিক মানবাধিকারগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জন্য ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। একই সাথে আন্তর্জাতিকভাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ হিসেবে ১৬ দিনব্যাপী গণসচেতনতামূলক ও সংবেদনশীলমূলক নানা কর্মসূচি ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পালিত হয়ে থাকে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শিশুর সার্বিক উন্নয়নে প্রত্যয়ী আন্তর্জাতিক সংস্থা ’ওয়ার্ল্ড ভিশন’ তার কর্ম এলাকায় প্রতিবছরের ন্যায় এবারো মানবাধিকারের একটি বড় অংশ হিসেবে শিশু সুরক্ষা, সার্বিক উন্নয়ন তথা জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে বর্ণিল কর্মসূচি পালন করেছে।
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশের সংবিধানেও আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত মানবাধিকারের মূলনীতিগুলিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকারের সুরক্ষায় বিভিন্ন বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বিশ্রাম ও চিত্ত বিনোদন এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানবাধিকারসমূহ এবং নাগরিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সুরক্ষার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মানবাধিকারের মূল লক্ষ্যই হলো, পরিবারে, সমাজে এমনকি বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সকল মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করা এবং সর্বদাই সমতা-ঐক্য-শান্তি-স্বাধীনতা বজায় রাখা। আর তাই মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের সর্বমোট ৩০টি ধারায় মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সার্বিক কল্যাণোর্থে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে সুষ্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে; যাতে একটি মানব প্রাণ সত্যিকারের মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে। অন্তত স্বাধীনভাবে চলতে পারে, ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ বজায় রেখে মতামত ব্যক্ত করতে পারে, অথচ বাস্তবতায় এর ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ে প্রতিটি পরতে পরতে। প্রতিবছরের ন্যায় এবারো মানবাধিকার দিবস এলো। বর্ণিল সাজে সাজলো চারপাশ। গোল টেবিলে, মুক্ত মঞ্চে অলোচনায় মুখরিত হয় সুশীল সমাজ। পত্র-পত্রিকা খুললেই দিবসের তাৎপর্য, বিশ্লেষণ আর টেলিভিশনের টক শো দেখে মনটা জুড়িয়ে যায়, লিফলেটে ছাপানো মন জুড়ানো সম্ভাবনার কথা। মানুষের অধিকার তথা মূল্যবোধের আহ্বান দেখে নিজেকে অনেক সময় গর্বিত নাগরিক মনে হয় বৈকি, আহা, আজ মানবাধিকার দিবস-২০২২, ক্ষাণিক বাদে সম্বিত ফিরে পেলেই হচকচিয়ে উঠে দেহমন।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব ‘মানুষ’ কর্তৃক অন্য মানুষের প্রতি অমানবিক/পৈশাচিক নির্যাতন, সভ্যতার এই যুগে বর্বরতার চিত্র দেখে বড্ড অসহায় লাগে। বাক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ভোটাধিকারের স্বাধীনতা, মুক্ত মঞ্চে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীন সার্বভৌমত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বাধীনতা যেন কাগজে-কলমের মুদ্রণ মাত্র। দিনের পর দিন সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য আচরণ, বিশেষ করে সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রতি বৈরী আচরণ। চাকরি ক্ষেত্রে মেধাবী সত্ত্বেও রাজনৈতিক মতাদর্শের অমিল ঘটলেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করানো যেন একটি অতি সাধারণ বিষয় বলেই বিবেচিত হয় আমাদের কাছে। কর্মক্ষেত্রে দৈহিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃত নিবেদিতপ্রাণ চাকুরের পদোন্নতির স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
রাজনৈতিক মদতপুষ্ট হবার ফলে পদে পদে সাংবাদিকদের কোণঠাসা করে রাখার সংস্কৃতি। স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতন এমনকি গুম, খুনের কথা শুনে শিহরিত না হয়ে কোন উপায়ই থাকে না। শিশুশ্রমের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে লক্ষ-লক্ষ অনাগত ভবিষ্যৎ। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত বুভুক্ষ শিশুরা চার দেয়ালে বন্দি হয়ে কেবল গৃহ পরিচারিকার কাজই করে না বরং অলিখিতভাবে অকালেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতীত্ব বিকিয়ে দিতে বাধ্য থাকে আশ্রিত ফ্ল্যাটের বড় বাবুদের কাছে। এমন নির্মম ঘটনার সাক্ষী হই আমরা প্রতিনিয়তই। লঘু পাপে গুরুদণ্ড দিয়ে ছিঁচকে চোরকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অহরহ নজির রয়েছে এ সমাজে, এ দেশে। ধনীর দুলালদের জন্য তাই আইনের প্রতিফলনটি ঘটে ভিন্নভাবে। জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী এই ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’-এর উদ্যাপনের প্রায় হীরক জয়ন্তী হতে চলেছে অর্থাৎ ইতোমধ্যে ৭৪ বছর পেরিয়ে গেছে, তথাপি, আদৌ কি সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? জাতির বিবেকের প্রতি মুহূর্তে এমন প্রশ্নের উদ্রেগ হলেও উত্তর মেলা বড়ই ভার।
আজ মানবাধিকার দিবসের প্রত্যাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করলে অবচেতনভাবেই এ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো দৃষ্টিপাত হয় আমাদের হূদয়ের গভীর থেকে। আজ একবিংশ শতাব্দীর প্রায় এক চতুর্থাংশ পেরিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার বাড়লেও আনুপাতিক হারে প্রকৃত মানুষের সংখ্যা বাড়েনি বললেই চলে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিকের তকমা গায়ে লাগিয়ে দিনের পরে দিন অমানবিক কর্মসূচির হোতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে এক শ্রেণির সূধীজন। সৌভাগ্যক্রমে তারাই আবার ক্ষমতার জোড়ে মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনায় মুখ্য ব্যক্তি বনে যান। কী হাস্যকর, কী প্রহসনমূলক চিত্র বটে। এত কিছুর পরেও স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পরে আমরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতিতে অনেকাংশেই এগিয়েছি। সেই অনুপাতে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে কতখানি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? এটি যেন আজ একটি জাতীয় প্রশ্ন হওয়া উচিত।
সত্যিকারের ‘মানুষ’ হলে নিশ্চয়ই, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আমাদের বিবেককে নাড়া দেবে। সমস্বরে চিৎকার দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে চাইবে সকলে। ১০ ডিসেম্বর ক্যালেন্ডারের পাতায় কেবল একটি দিনই নয় বরং মানবজাতির ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ তথা সার্বিক উন্নয়নের জন্য এটি একটি নতুন প্ল্যাটফর্মও বটে। মানুষ হয়ে আরেক মানুষের সেবা করা বা তাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি, মতামত, দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাই যেন প্রকৃত মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
তাই, আজকের দিনের প্রত্যয় হোক, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আর এজন্য সবার আগে প্রয়োজন, প্রকৃত ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলা। কেননা প্রকৃত মানুষ ছাড়া মানবাধিকার সংরক্ষণ কোনভাবেই সম্ভব নয়। মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে সবাই মিলে ছুটে চলি মানুষের কাছে। এমনি করেই একদিন সার্থক হবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। তাই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মানুষ খুঁজি দিবানিশি। আর মনে মনে প্রত্যাশার প্রহর গুনি এই ভেবে যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে নিশ্চয়ই একদিন।
লেখক : কো-অর্ডিনেটর, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড সোশ্যাল একাউন্টিবিলিটি ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।