সমপ্রতি বাংলাদেশ সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করেছে। এরই মধ্যে এটি বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন নিয়ম-কানুন প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু এ সম্পর্কে কতগুলো বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা দরকার। কারণ জনমনে কিন্তু এখনো এ বিষয়ে কিছুটা প্রশ্ন উঠেছে-যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার অর্থটা সরকার এখন নিচ্ছে; নির্দিষ্ট সময়ের পর পেনশনের টাকাটা মানুষ পাবে। এ সময় পর্যন্ত অর্থটা সরকারের কাছে থাকবে এবং সময়মতো এগুলো যারা পাবে, তারা নির্বিঘ্নে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে সুফল পাবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। বিশ্বের অনেক দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আছে।
পেনশনব্যবস্থা ছাড়া আমাদের আরেকটি বিষয় খুব জরুরি দরকার, স্বাস্থ্য বিমা। পেনশন বিমার একটা সুদূরপ্রসারী বেনিফিট পাওয়া যাবে। এটা একটা উচ্চাশা বা উচ্চাকাঙক্ষা স্কিম। আমি মনে করি, স্বাস্থ্য বিমা চালু করা দরকার। কারণ কত বছর পর পেনশনের টাকাটা পাবে-কি পাবে না; কত টাকা পাবে সেখানে চিন্তাভাবনা থাকবে। অনেক লোকজন হয়তো করতে চাইবে না, কারণ সেখানে সীমিত টাকা
বাংলাদেশও করেছে। তবু এ ব্যাপারে কতগুলো বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিত। ২০১৬ সালে বাজেট পেশকালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, বেসরকারি পর্যায়ে সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা করা হবে। অবশ্য এটা বহুদিন পরে, প্রায় ছয়-সাত বছর পরে চালু করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সরকারের আরও কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে। তবে এসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অনেকটা অস্বচ্ছতা, এমনকি দুর্নীতিরও কথা শোনা যাচ্ছে। সময়মতো সঠিক লোকজন এগুলো পায় কি না, সহায়তার পরিমাণ যথেষ্ট কি না-এমন অনেক কথা আছে। অতএব অনেক ভালো উদ্যোগ অনেক সময় অনিয়ম, দুর্নীতি, অপর্যাপ্ততার কারণে মুখ থুবড়ে পড়ার নজির আমাদের সামনে আছে। এ জন্য উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে, বিশেষ করে পেনশনের ক্ষেত্রে।
আমরা এখন প্রবৃদ্ধির কথা বলছি, কিন্তু এর সুষম বণ্টন এবং সুফলও অনেকে পায়নি। যারা আনুষ্ঠানিকভাবে, অনানুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি খাতের সঙ্গে যুক্ত, তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও সুফল তেমন পায় না। আমাদের যে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে সেগুলো থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তরা যে খুব সুবিধা পায় সেটা প্রতীয়মান হয় না। সে জন্য এই কতগুলো বিষয় কিন্তু এখানে লক্ষ্য করতে হবে।
প্রথমত, মানুষ এ ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্সের অর্থ কিন্তু প্রিমিয়াম দিতে থাকবে। এই প্রিমিয়ামটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দিতে থাকবে। অনেক সময় দেখা যায় যে ম্যাচিউরিটি মানে নির্দিষ্ট সময় পার হলেও অর্থ পেতে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা দেখেছি যে অনেকে লাইফ ইন্স্যুরেন্স করে, কিন্তু সেগুলো থেকে টাকা পেতে তাদের অনেক বিড়ম্বনা ভোগ করতে হয়। অনেক রকম সমস্যায় পড়তে হয়। সবচেয়ে বড় একটা জিনিস হলো, অনেক সময় দেখা যায় যে কয়েকটি প্রিমিয়াম যদি কেউ মিস করে, কেউ যদি না দিতে পারে, তখন জটিলতা সৃষ্টি হয়। এমনও হতে পারে, কোনো মানুষ পেনশনের সঙ্গে এনলিস্টেড হলো বা তার নাম লেখাল। কিন্তু প্রিমিয়াম সবসময় দিতে পারছে না, তখন সেটা নিয়মিত করার জন্য কোনো অসুবিধা হবে কি? পেনশনব্যবস্থায় এটা করার পদ্ধতি থাকলেও বাস্তবে সেটা পরিপালন হবে কি না এ বিষয়ে জনগণের মনে শঙ্কা থাকতে পারে।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা ও কিছু কথাসরকারের পেনশনভোগী যারা আছে, যারা সরকারি চাকরি করে তাদেরও বহু রকম বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। অফিসে যেতে হয়, কাগজপত্র দিতে হয়, সেগুলো দিতে গিয়ে নানা রকম তথ্য, নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এগুলো পার হয়ে পেনশনের টাকা পেতে অনেক সময় দেরি বা ভোগান্তি হয়। সর্বজনীন পেনশন যেটা করেছে সেটা আরো ব্যাপকতর। বহু লোকের এখানে অংশগ্রহণ থাকবে। অতএব যেভাবে এসব বিধি-বিধান করা হয়েছে এবং এসব বিধি-বিধান আপাতদৃষ্টিতে খুব ভালো মনে হয়। বিধি-বিধানগুলো বাস্তবায়ন করা, পরিপালন করা-এখনকার পরিস্থিতিতে কিন্তু বাংলাদেশের জন্য একটু কঠিন হয়ে যেতে পারে। এই বিষয়গুলো যদি আমরা সঠিকভাবে না করি, তাহলে কিন্তু মানুষ এগুলোর সুবিধা না-ও পেতে পারে।
সর্বজনীন বিমার অর্থটা আসতে থাকবে, সেগুলো সরকার কোথায় রাখবে? কোনখানে সুরক্ষিত থাকবে? কোন অ্যাকাউন্টে রাখবে? বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখলে সেগুলো একেবারে শতভাগ সুরক্ষিত থাকবে- সে ব্যাপারেও প্রশ্ন আছে। অনেক টাকা জনগণ থেকে আহরণ করা হবে। এ টাকা আহরণ করার পর সরকার অন্যখানে বিনিয়োগ করবে কি না? বিনিয়োগ করলে সেটা সুষ্ঠুভাবে করবে কি না? বিনিয়োগ থেকে তো রিটার্ন আসতে হবে। বিনিয়োগ থেকে লাভ আসার কথা, সে লাভ সরকারি খাতে যাবে। যারা পেনশন পাবে তারাই হয়তো লাভটা পাবে। কিন্তু এই টাকাটা যেন সরকারি কোনো ফান্ডে থাকে। এটা বিনিয়োগ করলে বা কোথাও জমা থাকলে সেগুলো সুরক্ষিত থাকবে, এটার নিশ্চয়তা তো দেয়া দরকার।
আর এ ছাড়া আরেকটা জিনিস লক্ষণীয় যে দেশে মূল্যস্ফীতির হার দিন দিন বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে আলটিমেটলি দেখা যাবে, যে টাকাটা জমা রাখছে, তার বিনিময়ে যে রিটার্ন পাবে সেটা কতটা যুক্তিসংগত। বর্তমানে যে ১০০ টাকা, পাঁচ বছর পর হয়তো সেটা ৫০ টাকার সমমানও থাকবে না। অতএব, ভবিষ্যতে প্রাপ্য টাকাটা যে পাবে, এটার ব্যাপারে তখন অনেকে বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করবে। এখন রেখে দিচ্ছি, বেশ কয়েক বছর আমার টাকাটা সেখানে আটকে থাকবে। পরে আমি যেটা পাব সেটা কতটুকু, কিভাবে পাব। এই পরিপ্রেক্ষিতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমটা কতটুকু জনপ্রিয় ও সফল হতে পারবে তা দেখার বিষয়।
অনেক সময় হয় কি, সরকার অনেক রকম অর্থ আহরণ করে বিভিন্নভাবে। বিভিন্ন স্কিমে নিয়ে আসে। বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিম আছে, প্রাইজ বন্ড আছে। এগুলো নিয়ে সরকার তখন সরকারি বিভিন্ন খরচ নির্বাহ করে। অবশ্যই ওই সব সঞ্চয় স্কিমের টাকা অথবা প্রাইজ বন্ডের টাকা লোকজন যথাসময়ে রিটার্ন পাচ্ছে, প্রাইজ মানি পাচ্ছে, কিন্তু এখানে পেনশনের টাকা বিশাল অঙ্ক এবং বেশ কিছুদিন জমা করতে থাকবে লোকজন। অতএব, সরকারি সঞ্চয় স্কিম এবং অন্য, আমি যেটা প্রাইজ বন্ডের কথা বললাম বা ওই ধরনের বন্ড আছে সেগুলো যত সহজে বাস্তবায়ন করা যায়, এই পেনশন স্কিমের জন্য তত সহজে বাস্তবায়ন করা যাবে না। আমাদের যে দক্ষতা, আমাদের যে নিষ্ঠা, আমাদের যে সততা, এগুলো কিন্তু তখন চলে আসবে সামনে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অতি প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে পেনশন স্কিমটাকে আরও বিশদভাবে লোকজনকে বোঝানো এবং আরও একটু সহজতর করা। লোকজন যেন সহজেই, কোনো রকম বিড়ম্বনা ছাড়াই এটার সুবিধা পায়, এই জিনিসটা লক্ষ করতে হবে।
কাজেই এটা ব্যাপকভাবে চালু করার আগে যেটা করা যেতে পারে-সীমিত আকারে কিছুদিন দেখতে হবে লোকজনের কাছ থেকে কেমন সাড়া আসে, কী রকম মন্তব্য আসে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্কিমটাকে পরিবর্তন, পরিমার্জন করে এর পরিধি বাড়াতে পারে। কিন্তু এখনই চট করে বিরাট একটা স্কিম নিয়ে, বিশাল অঙ্কের টাকা আহরণ করে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকাগুলো যেন অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং এটা সরকারের কর্তব্য।
পেনশনব্যবস্থা ছাড়া আমাদের আরেকটি বিষয় খুব জরুরি দরকার, স্বাস্থ্য বিমা। পেনশন বিমার একটা সুদূরপ্রসারী বেনিফিট পাওয়া যাবে। এটা একটা উচ্চাশা বা উচ্চাকাঙক্ষা স্কিম। আমি মনে করি, স্বাস্থ্য বিমা চালু করা দরকার। কারণ কত বছর পর পেনশনের টাকাটা পাবে-কি পাবে না; কত টাকা পাবে সেখানে চিন্তাভাবনা থাকবে। অনেক লোকজন হয়তো করতে চাইবে না, কারণ সেখানে সীমিত টাকা। কিন্তু স্বাস্থ্য যদি কারো ঝামেলা হয়, তাহলে তার কিন্তু সব সঞ্চয় চলে যায়, বিশেষ করে বেসরকারি খাতে কর্মরত মানুষ, সেই সঙ্গে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের জন্য স্বাস্থ্য বিমা খুব জরুরি। এদিকে এখনই নজর দেয়া দরকার।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়