বাগেরহাটের মসজিদে, শ্মশানে সম্প্রীতির ছোঁয়া

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২২, ০৮:৩১ পিএম
বাগেরহাটের মসজিদে, শ্মশানে সম্প্রীতির ছোঁয়া

বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দুটি নজির নিয়ে আলোচনা এখন দেশজুড়ে। এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যাপক জমি দিয়েছেন মসজিদে আর এক মুসলিম রাজনৈতিক নেতা জমি দিয়েছেন হিন্দুদের শ্মশানে।

তবে কিছু লোক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন যে, তারা দখল করা জমি দান করে নিজেদের মহিমান্বিত করছেন। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে এবং প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লোকের দখলি জমির ‘গল্প’ অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে বৈধ মালিকানার জমিই দিয়েছেন দুজন। এবং জমি দিয়ে তারা প্রচারও চাননি। চাইলে জমি যখন দিয়েছেন তখনই তা প্রচার করতে পারতেন।

গত ২৩ এপ্রিল হাঙ্গার প্রজেক্ট ধর্মীয় সম্প্রীতির কাজ করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দুই অনন্য নজিরের কথা সামনে নিয়ে আসে।

ফকিরহাট বিশ্ব রোডের পাশে মসজিদের জন্য জমি দিয়েছেন ফকিরহাট আজাহার আলী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ। আর ভৈরব নদের তীরে শ্মশানের জন্য জমি দিয়েছেন থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শেখ মিজানুর রহমান।

অধ্যাপক প্রণব কুমার ঘোষ উত্তরাধিকার সূত্রেই অনেক জমিজমার মালিক। ফকিরহাট ডিগ্রি কলেজসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের দানের জমিতেই গড়ে উঠেছে। সেখানকার রেললাইনও তাদের জমির ওপর দিয়ে গেছে।

খুলনা-মাওয়া মহাসড়ক চালু হলে ফকিরহাট সদর ইউনিয়নের আট্টাকি গ্রামের মোড়টি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসা কেন্দ্র হয়ে ওঠে৷ স্থানীয়ভাবে এর নাম হয় বিশ্বরোডের মোড়। ওই মোড়ে প্রণব কুমার ঘোষের অনেক জমি। তিনি সড়কের পাশে বড় একটি মার্কেট করেন। কিন্তু সেখানে কোনো মসজিদ ছিল না। আশপাশে মুসলমানদের মধ্যে কারোই মসজিদ করার মতো জমি নেই। এ কারণে ওই এলাকার লোকজন মসজিদের জন্য জমি চাইলে প্রণব কুমার ঘোষ ৪০ শতক জমি দিয়ে দেন। সেখানে এখন দোতলা মসজিদ হয়েছে। সামনে আরো কিছু জায়গা নিয়ে ঈদগাঁ হয়েছে। এটা ২০০৯ সালের ঘটনা।

প্রণব কুমার ঘোষ বলেন, আমাদের এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক ভালো। দীর্ঘদিন ধরে আমরা এক সঙ্গে বসবাস করি। সবাই আমাকে অনেক সম্মান করে। মুসলমানদের মসজিদ তো দরকার। আমার টাকা নেই, জমি আছে। তাই জমি দিয়েছি। মসজিদ তারাই বানিয়েছে। ঈদগাঁর জন্য জমি দিয়েছি নাম মাত্র দামে।

জমির বৈধতার প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার দাদু ইন্দু ভূষণ ঘোষ ছিলেন জমিদারের ম্যানেজার। এই এলাকায় আমাদের অনেক ভূসম্পত্তি আছে। অনেক প্রতিষ্ঠানকে আমরা জমি দিয়েছি। রেলকেও আমরা জমি দিয়েছি। কেউ কেউ বলতে চান, এটা রেলের জমি। আসলে এটা ঠিক নয়। সেটা হলে তো মার্কেট করতে পারতাম না। আমার পৈত্রিক জমিই আমি মসজিদে দিয়েছি। তাদের কয়েকটা দোকানও করে দিয়েছি।

এদিকে ফকিরহাটের ভৈরব নদের তীরেই ছিল ওই এলাকার হিন্দুদের কেন্দ্রীয় শ্মশান। নদী খননের কারণে শ্মশানটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। মিজানুর রহমান শেখ বলেন, তারপরও হিন্দুরা নদীর তীরে আমার জমিতে মৃতদেহ সৎকার করতো। তারা আমার কাছেও আসে। এরপর আমি তাদের শ্মশানের জায়গা দিই। তারা কাজ শুরু করেছেন। আমার অনেক জমি আছে, তাদের যতটুকু লাগে তারা পাবেন।

তিনি বলেন, আমাদের এলকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক দৃঢ়। আমরা দীর্ঘকাল ধরে একসঙ্গে বসবাস করে আসছি। আর আমি নিজেও জনপ্রতিনিধি। দুইবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাম। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। আমার ভাই ইউপি চেয়ারম্যান। আমরা এখানে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকি।

জমির বৈধতার প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা বিআইডাব্লিউটিএ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে লীজ নেয়া জমি। এটার মূল মালিক অরবিন্দ পাল মনি। তাদের জমি বিআইডাব্লিউটিএ অধিগ্রহণের পর যা তাদের লাগেনি, তা ফেরত দিয়েছে। তারপর আমি তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছি। জমির লাইসেন্স আমার নামেই।

ফকিরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান স্বপন কুমার দাস বলেন, তারা দুইজন যে মাহনুভবতা দেখিয়েছেন তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটা এই এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং সব ধর্মের সহ-অবস্থানকে আরো দৃঢ় করবে।

আর জমি নিয়ে যে বিতর্ক তোলা হয়েছে তার জবাবে তিনি বলেন, শেখ মিজানুর রহমান যে জমি শ্মশানে দিয়েছেন তা বিআইডাব্লিউটিএ থেকে লিজ নেয়া৷ তার একটি অংশ শ্মশানে দিয়েছেন। এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। আর প্রণব কুমার ঘোষ যে জমি মসজিদে দিয়েছেন সেটা তো তার পৈত্রিক সম্পত্তি। এটা সবাই জানে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা বেগম বলেন, আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই দুই ব্যক্তির এই প্রশংসনীয় কাজের কথা জেনেছি। যেখানে আমরা এখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার আতঙ্কে ভুগছি, সেই সময়ে এই কাজ অবশ্যই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।

হাঙ্গার প্রজেক্টের ফকিরহাটের সমন্বয়কারী খান মাহমুদ আরিফুল হক জানান, তারা এই এলাকায় সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক সম্প্রীতি নিয়ে কাজ করেন। প্রণব কুমার ঘোষ জমি দেন ২০০৯ সালে আর শেখ মিজানুর রহমান দেন এক বছর আগে। 

তিনি বলেন, আমরা মনে করলাম এটা সবার জানা উচিত। সবাই জানলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় মানুষ আরো উদ্বুদ্ধ হবে। তাই ২৩ এপ্রিল আমরা একটি অনুষ্ঠান করে ওই দুইজনকে সম্মাননা দিই। তখন এটা সবাই জানে, সংবাদ মাধ্যমেও খবর হয়।

তিনি বলেন, দুটি পরিবারই এই এলাকার দাতা পরিবার। আমি দুই পরিবারকেই অনেক দিন ধরে জানি। এই এলাকায় তাদের আরো অনেক দান আছে। এলাকার মানুষও এটা জানে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ জমির বৈধতা নিয়ে কথা বলছেন। তারা না জেনে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলছেন। তারা তাদের বৈধ জমিই দান করেছেন।

আমারসংবাদ/জেআই