সুনির্দিষ্ট করে জান্নাতি ও জাহান্নামী বলা প্রসঙ্গে বিধান

ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২৩, ০৫:১৫ পিএম
সুনির্দিষ্ট করে জান্নাতি ও জাহান্নামী বলা প্রসঙ্গে বিধান

আমরা কি কোনো মুসলমানকে জান্নাতি বা জাহান্নামি বলে ঘোষণা দিতে পারি? না আমরা কোনো মুসলমানকে সে যত সৎকর্মই করুক না কেন জান্নাতি বলে ঘোষণা দিতে পারি না। অনুরূপভাবে কোনো মুসলমান যত মন্দ কাজই করুক না কেন তাকে জাহান্নামি বলেও ঘোষণা দিতে পারি না। কারণ জান্নাতি ও জাহান্নামি হওয়ার বিষয়টি একটি গায়েবি বিষয়।

তাই যিনি জান্নাত ও জাহান্নামের মালিক একমাত্র তিনিই বলতে পারেন তিনি কাকে জান্নাতে দেবেন আর কাকে জাহান্নামে দেবেন। তবে তিনি যেহেতু তার অনেক গায়েরে খবর তাঁর রাসূলকে দিয়েছেন তাই রাসূল সা:ও অনেক সময় কে জান্নাতি হবে আর কে জাহান্নামি হবে সে প্রসঙ্গে কিছু সংবাদ দিয়েছেন।

সুতরাং কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: যাদেরকে জান্নাতি বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তাদের ছাড়া আর কাউকে আমরা জান্নাতি বলে ঘোষণা দিতে পারি না। অনুরূপভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: যাদেরকে জাহান্নামি বলে ঘোষণা দিয়েছেন শুধু তাদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে জাহান্নামি বলে ঘোষণা দিতে পারি না।

কারণ- 

عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِينَ، قَالَتْ دُعِيَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلَى جَنَازَةِ صَبِيٍّ مِنَ الأَنْصَارِ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ طُوبَى لِهَذَا عُصْفُورٌ مِنْ عَصَافِيرِ الْجَنَّةِ لَمْ يَعْمَلِ السُّوءَ وَلَمْ يُدْرِكْهُ قَالَ ‏ "‏ أَوَغَيْرَ ذَلِكَ يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ لِلْجَنَّةِ أَهْلاً خَلَقَهُمْ لَهَا وَهُمْ فِي أَصْلاَبِ آبَائِهِمْ وَخَلَقَ لِلنَّارِ أَهْلاً خَلَقَهُمْ لَهَا وَهُمْ فِي أَصْلاَبِ آبَائِهِمْ ‏"‏ ‏

"উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি আনসার বালকের জানাযায় অংশ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হলেন। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই বালকটি তো ভাগ্যবান। সে তো জান্নাতের চড়ুই পাখিদের অন্যতম। সে মন্দকাজ করেনি এবং পাপ তাকে স্পর্শ করেনি। তিনি বললেন, এ ছাড়া অন্য কিছু হে আয়িশা! (ভাবো ও বল) নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা জান্নাতের অধিবাসীদের সৃষ্টি করেছেন তাদের তার (জান্নাতের) জন্যই পয়দা করেছেন এবং যখন তারা তাদের বাপ দাদা (পূর্ব পুরুষের) ঔরসে ছিল। আর তিনি সৃষ্টি করেছেন জাহান্নামের জন্য তার যোগ্য অধিবাসীদের। যখন তারা তাদের বাপ দাদাদের ঔরসে ছিল।"

عَنْ خَارِجَةَ بْنِ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ أَنَّ أُمَّ الْعَلَاءِ امْرَأَةً مِنْ نِسَائِهِمْ بَايَعَتْ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم أَخْبَرَتْهُ أَنَّ عُثْمَانَ بْنَ مَظْعُونٍ طَارَ لَهُمْ فِي السُّكْنَى حِيْنَ اقْتَرَعَتْ الأَنْصَارُ عَلَى سُكْنَى الْمُهَاجِرِيْنَ قَالَتْ أُمُّ الْعَلَاءِ فَاشْتَكَى عُثْمَانُ عِنْدَنَا فَمَرَّضْتُهُ حَتَّى تُوُفِّيَ وَجَعَلْنَاهُ فِيْ أَثْوَابِهِ فَدَخَلَ عَلَيْنَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْكَ أَبَا السَّائِبِ شَهَادَتِيْ عَلَيْكَ لَقَدْ أَكْرَمَكَ اللهُ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَمَا يُدْرِيكِ أَنَّ اللهَ أَكْرَمَهُ قَالَتْ قُلْتُ لَا أَدْرِيْ بِأَبِيْ أَنْتَ وَأُمِّيْ يَا رَسُوْلَ اللهِ فَمَنْ قَالَ أَمَّا هُوَ فَقَدْ جَاءَهُ وَاللهِ الْيَقِيْنُ وَاللهِ إِنِّيْ لَارْجُوْ لَهُ الْخَيْرَ وَمَا أَدْرِيْ وَاللهِ وَأَنَا رَسُوْلُ اللَّه مَا يُفْعَلُ بِيْ قَالَتْ فَوَاللهِ لَا أُزَكِّيْ أَحَدًا بَعْدَهُ قَالَتْ فَأَحْزَنَنِيْ ذَلِكَ فَنِمْتُ فَرِيْتُ لِعُثْمَانَ بْنِ مَظْعُونٍ عَيْنًا تَجْرِيْ فَجِئْتُ رَسُوْلَ اللهِ فَأَخْبَرْتُهُ فَقَالَ ذَلِكِ عَمَلُهُ

খারিজাহ ইবনু যায়দ ইবনু সাবিত (রা.) বলেন, উম্মুল ‘আলা’ (রা.) নাম্নী এক আনসারী মহিলা নবী (সা.)-এর হাতে বায়‘আত করেন। তিনি বর্ণনা করেন, যখন মুহাজিরদের বাসস্থানের ব্যাপারে আনসারদের মধ্যে লটারী হয় তখন ‘উসমান ইবনু মায‘উনের বসবাস আমাদের অংশে পড়ল। উম্মুল ‘আলা (রা.) বলেন, এরপর তিনি আমাদের এখানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমি তার সেবা শুশ্রূষা করলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়ে গেল। আমরা কাফনের কাপড় পরিয়ে দিলাম। তারপর নবী (সা.) আমাদের এখানে আসলেন। ঐ সময় আমি ‘উসমান (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলছিলাম। হে আবূ সায়িব! তোমার উপর আল্লাহর রহমত হোক। তোমার সম্পর্কে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তোমাকে সম্মানিত করেছেন।

তখন নবী (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেমন করে জানলে যে, আল্লাহ্ তাকে সম্মানিত করেছেন? আমি বললাম, আমার মাতা-পিতা আপনার উপর কুরবান হোক। হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো জানি না। তবে কাকে আল্লাহ্ সম্মানিত করবেন? নবী (সা.) বললেন, আল্লাহর শপথ! ‘উসমানের মৃত্যু হয়ে গেছে। আল্লাহর কসম! আমি তার সম্পর্কে কল্যাণের আশা পোষণ করছি। আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহর রাসূল হওয়া সত্ত্বেও জানিনা আল্লাহ আমার সাথে কী ব্যবহার করবেন।

উম্মুল ‘আলা’ (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ, আমি এ কথা শুনার পর আর কাউকে পূত-পবিত্র বলব না। উম্মুল ‘আলা’ (রা.) বলেন, নবী (সা.)-এর এ কথা আমাকে চিন্তিত করল। এরপর আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম যে, ‘‘উসমান ইবনু মায‘উন (রা.)-এর জন্য একটি নহর জারি রয়েছে। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নিকট গিয়ে আমার স্বপ্নটি বললে তিনি বললেন, এ হচ্ছে তার সৎ ‘আমল’’।

عَنْ جُنْدَبٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حَدَّثَ ‏ "‏ أَنَّ رَجُلاً قَالَ وَاللَّهِ لاَ يَغْفِرُ اللَّهُ لِفُلاَنٍ وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى قَالَ مَنْ ذَا الَّذِي يَتَأَلَّى عَلَىَّ أَنْ لاَ أَغْفِرَ لِفُلاَنٍ فَإِنِّي قَدْ غَفَرْتُ لِفُلاَنٍ وَأَحْبَطْتُ عَمَلَكَ ‏"‏ ‏.‏ أَوْ كَمَا قَالَ ‏.‏

জুনদাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এক লোক বলল, আল্লাহর শপথ আল্লাহ অমুক লোককে মাফ করবেন না। আর আল্লাহ তা’আলা বলেন, সে লোক কে? যে শপথ খেয়ে বলে যে, আমি অমুককে মাফ করব না? আমি তাকে মাফ করে দিলাম এবং তোমার আমল (শপথ) কে নষ্ট করে দিলাম, কিংবা সে যেমন বলেছেন।

আলিমগণের মতে উপরিউক্ত হাদীস তিনটিতে "القطع على علم الغيب" অর্থাৎ অদৃশ্যের বিষয়ে সিদ্ধান্তের ঘটনা ঘটেছে। তাই নবীজি (সা.) অজানা বিষয়ে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। দুটো কারণে অদৃশ্য বিষয়ে কথা বলা ইসলামে নিষিদ্ধ:

এক. আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে অজানা বিষয়ে কথা বলতে পবিত্র কুরআনে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, 
وَ لَا تَقۡفُ مَا لَیۡسَ لَکَ بِهٖ عِلۡمٌ ؕ اِنَّ السَّمۡعَ وَ الۡبَصَرَ وَ الۡفُؤَادَ کُلُّ اُولٰٓئِکَ کَانَ عَنۡهُ مَسۡـُٔوۡلًا

"আর যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না; কান, চোখ, হৃদয়- এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।"

কারো জান্নাতি হওয়া না হওয়া ইলমুল গাইবের বিষয়। সুতরাং কাউকে জান্নাতি বা জাহান্নামী বলা নিষিদ্ধ।

দুই. একজন ব্যাক্তির জান্নাতি হওয়া না হওয়া তাঁর সর্বশেষ অবস্থার উপর নির্ভর করে। সাধারণ চোখে যা প্রতিভাত হয়, বাস্তবতা তার ভিন্নও হতে পারে। কারো ঈমানের সর্বশেষ বাস্তবতা জানা অসম্ভব।

নবীজি (সা.) বলেছেন,

عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ السَّاعِدِيِّ، ..... فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ إِنَّ الْعَبْدَ لَيَعْمَلُ فِيمَا يَرَى النَّاسُ عَمَلَ أَهْلِ الْجَنَّةِ، وَإِنَّهُ لَمِنْ أَهْلِ النَّارِ، وَيَعْمَلُ فِيمَا يَرَى النَّاسُ عَمَلَ أَهْلِ النَّارِ وَهْوَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ، وَإِنَّمَا الأَعْمَالُ بِخَوَاتِيمِهَا ‏"‏‏.‏
সাহল ইবনু সা’দ সাঈদী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, কোন বান্দা এমন কাজ করে যায়, যা দেখে লোকেরা একে জান্নাতী লোকের কাজ মনে করে। কিন্তু বাস্তবে সে জাহান্নামিদের অন্তর্ভুক্ত। আর কোন বান্দা এমন কাজ করে যায়, যা মানুষের চোখে জাহান্নামীদের কাজ বলে মনে হয় অথচ সে জান্নাতী লোকদের অন্তর্ভূক্ত। নিশ্চয়ই মানুষের যাবতীয় আমল পরিণামের সাথে নির্ভরশীল।

আহলু আস-সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকিদা
১. কারো জান্নাতি ও জাহান্নামী হওয়া ইলমুল গাইবের বিষয়। একমাত্র আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে জানেন।

২. নবীজি (সা.)-কে কারো কারো জান্নাত ও জাহান্নাম লাভ সম্পর্কে জানানো হয়েছে। তাই একমাত্র নবীজি (সা.) যাদেরকে জান্নাতি বলেছেন, তাঁরা জান্নাতি। তাদের মাঝে "আল-আশারা আল-মুবাশশিরা" অর্থাৎ দশজন সুসংবাদপ্রাপ্ত ও অন্যান্য কয়েকজন সাহাবী রয়েছেন। নবীজি (সা.) যাদেরকে জাহান্নামী বলেছেন, তাঁরা জাহান্নামী। তাদের মাঝে আবু জাহল, আবু লাহাব, আবু তালিব রয়েছেন।

৩. সাধারণভাবে সকল মুমিন মৃত্যুর পর জান্নাতি ও সকল মুশরিক জাহান্নামী। কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে কাউকে জান্নাতি বলা নিষিদ্ধ; তবে কারো জন্য জান্নাতের আশা করতে সমস্যা নেই।

বাংলা জান্নাতি ও আরবী জান্নাতি শব্দের অর্থ

বাংলা ভাষায় জান্নাত শব্দের শেষে ই প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ব্যক্তিবাচক শব্দ জান্নাতি। এর অর্থ জান্নাতের একজন অধিবাসী। আরবী ভাষায় জান্নাত শব্দের শেষে সর্বনাম ‍‍`ইয়া‍‍` যুক্ত হয়ে সম্বন্ধবাচক বাক্য ঘটিত হয়। এর অর্থ আমার জান্নাত। কোনো ব্যাক্তি হৃদয়ের ভাবাবেগ প্রকাশে নিজ মাতাকে ‍‍`আনতি জান্নাতি‍‍` বলার অর্থ "মা! আপনি আমার জান্নাত।" স্ত্রীকেও বলতে পারে "আনতি জান্নাতি"। এভাবে ব্যাক্তি জান্নাতের সাথে মাকে কিংবা স্ত্রীকে তুলনা করতে কোনো সমস্যা নেই। পবিত্র কুরআনে মিসরের নীল নদ ও মেমফিস নগরীর বাগানকে ‍‍`জান্নাত‍‍` বলা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, كَمْ تَرَكُواْ مِن جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ* وَزُرُوعٍ وَمَقَامٍ كَرِيمٍ* وَنَعْمَةٍ كَانُواْ فِيهَا فَاكِهِينَ*
"তারা পিছনে রেখে গিয়েছিল অনেক উদ্যান ও প্রস্রবণ; শস্যক্ষেত্র ও সুরম্য প্রাসাদ, আর বিলাস উপকরণ, তাতে তারা আনন্দ পেত।"

কাউকে জান্নাতের অধিবাসী বলা আর কাউকে জান্নাতের সদৃশ বলার মাঝে ভিন্নতা রয়েছে। সুনির্দিষ্ট কাউকে জান্নাতি বা জাহান্নামী বলা ইসলামে নিষিদ্ধ। তবে আপনার কাজ জান্নাতের কাজের সদৃশ বলাতে কোনো সমস্যা নেই।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়