প্রত্যেক বছরই শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো পাঠ্যবই দিতে বেগ পেতে হয়। পাঠ্যবই মুদ্রণ, বাঁধাই ও সময়ের মধ্যে সরবরাহ না করাসহ নানা ধরনের অনিয়মের কারণে এ সমস্যা বছরের পর বছর বেড়েই চলছে। অনিয়মের ফলে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে পড়তে হয় কালো তালিকায়। তবে এর সমাধান করবে কে? এমনই প্রশ্ন উঠেছে অনেকের কাছে।
সেকেলে সিস্টেম দিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপানোর জন্য কার্যক্রম শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি। প্রত্যেক বছরের প্রথম দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীদের হাতে ৩৫ কোটি নতুন বই তুলে দিতে বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে জড়িত এনসিটিবি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেই ১৯৮৩ সালের জনবল ও কিছু সেকেলে সিস্টেম কাঠামোতে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। এর ফলে প্রতি বছরের শুরুতেই তাদেরকে শুনতে হয় নানান কটু কথা। কখনো দেখা যায় নতুন বই বাচ্চারা হাতে পেলেও সেগুলো হয়তো ছেঁড়া, নতুবা প্রিন্টিং এ সমস্যা। আবার সময়মতো সব বই দেশের সব বিদ্যালয়ে পৌঁছানো যায় না।
বই ছাপানোর জন্য এ বছর ইজিপিতে যেতে চেয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়লে প্রাথমিক স্তরের বই ছাপানো বড় হুমকির মুখে পড়তে পারে। পাঠ্যপুস্তক যথাসময়ে মুদ্রণ ও বিতরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আগামী ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ইজিপির (ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) পরিবর্তে আন্তর্জাতিক দরপত্র দেয়া হয়।
প্রাথমিক স্তরের (তৃতীয়-পঞ্চম শ্রেণির) পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের কাজ বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে করা হবে। ইতোমধ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের ব্যবস্থা করেছে। এদিকে চলতি বছরে নির্ধারিত সময়ে নতুন পাঠ্যবই দিতে না পারায় ২৬টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি।
এসব প্রতিষ্ঠান এক থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত এনসিটিবির বই ছাপার কাজে অংশ নিতে পারবে না। প্রতি বছরের শুরুতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেয়া হয়। তবে চলতি বছরে তা দেয়া যায়নি। এবার বই ছাপার কাজের জন্য পুনঃ দরপত্র আহ্বান করতে হয়েছিল। এ জন্য সময়মতো বই দেয়া, নিয়ে আগেই আশঙ্কা করেছিলেন সংশিষ্ট ব্যক্তিরা। এরই মধ্যে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলার কারণে বই ছাপার কাজে আরও দেরি হয়। ফলে সব শিক্ষার্থী সময়মতো বই হাতে পায়নি। এ বছর মোট সোয়া চার কোটি শিক্ষার্থীকে ৩৪ কোটি ৭০ লাখের বেশি পাঠ্যবই বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, শাস্তির মুখে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্র অনুযায়ী পাঠ্যবই মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছে। তারা দরপত্রের সময়ের চেয়ে অস্বাভাবিক দেরি করেছে। ২৯ দিন বা তারও বেশি দিন দেরি করা প্রতিষ্ঠানগুলো শাস্তির মুখে পড়েছে। আরও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ২৮ দিন পর্যন্ত দেরি করেছে যারা, সেগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) মো. মশিউজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের কাজের জন্য যে সংখ্যক প্রেস আছে সেগুলো মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের বই ছাপানোর কাজ নিলে তাদের ওপর চাপ পড়ে যায়।
এ জন্য এ বছর প্রাথমিক স্তরের বই ছাপানোর জন্য ইজিপিতে যেতে চেয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সমস্যার কারণে যাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক দরপত্রেই ছাপানোর কাজ করা হবে। এ বছর ২৬টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এতে করে বই ছাপানোর কাজে সমস্যা কতটুকু হতে পারে এ প্রশ্নের জবাবে মশিউজ্জামান বলেন, সমস্যা তো হবেই। আমরা ৩৫ কোটি বই ছাপায়। সেখানে ওইসব প্রতিষ্ঠানে হয়তো দুই কোটি বই ছাপালেও সেটাই আমাদের চাপ পড়বে। তিনি আরও বলেন, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো ৯ থেকে আট মাস টানা কাজ করলে আমাদের সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
তবে সেটা তো শুরু করতে দেরি হয়ে যায়। প্রতিবারই কেন সমস্যা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, আসলে আমাদের লোকবল ১৯৮৩ সালে যেভাবে এনসিটিবি গঠন করা হয়েছিল সেভাবে আছে। আগে তো আমাদের বই ছাপাতে হতো না। পাবলিক পাবলিশার্সরাই আমাদের পাণ্ডুলিপি তারা ছাপিয়ে সেগুলো বিক্রি করত। এখন ৩৫ কোটি বই ছাপানোর বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। আমাদের সেই আগের লোকবল সেটাপ নিয়েই এই বাড়তি লোডের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এখানে অনেকেই রিটায়ার্ডমেন্টে চলে গেছেন, অনেক পোস্ট খালি আছে, এর মধ্যেই স্বল্পসংখ্যক লোক নিয়েই কিন্তু কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কোনো শুক্র-শনিবার নেই, প্রতিদিনই কাজ করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এনসিটিবিসহ এর সাথে বিভিন্ন সেক্টরের প্রায় এক লাখ লোক জড়িত। এত বিশাল লোকের কর্মযজ্ঞ ম্যানেজ করার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ থাকা দরকার। সেটা কিন্তু এনসিটিবিকে তৈরি করা হয়নি। তার মধ্যে থেকেই আমার কিন্তু কাজ করে থাকি বলে জানান এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. মশিউজ্জামান।
কালোতালিকাভুক্ত যেসব প্রতিষ্ঠান : ১৭টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৫১ দিনের বেশি সময় পর বই দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান আগামী শিক্ষাবর্ষ (২০২৩) থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর এনসিটিবির বই ছাপার দরপত্র অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অযোগ্য থাকবে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— ঢাকার অক্ষর বিন্যাস প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, সেডনা প্রিন্টিং প্রেস আ্যাান্ড পাবলিকেশন্স, প্লাসিড প্রিন্টার্স অ্যান্ড প্যাকেজেস, মনির প্রেস আ্যাান্ড পাবলিকেশন্স, আবুল প্রিন্টিং, মেসার্স টাঙ্গাইল প্রিন্টার্স, হক প্রিন্টার্স, মেসার্স নাজমুন নাহার প্রেস, বনফুল আর্ট প্রেস, পিবিএস প্রিন্টার্স, ওয়াল্টার রোডের শিক্ষাসেবা প্রিন্টার্স, আমাজান প্রিন্টিং, উজ্জ্বল প্রিন্টিং প্রেস, বুলবুল আর্ট প্রেস, প্রেস লাইন, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরের এইচআর প্রিন্টার্স আ্যাান্ড পেপার সেলার ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মহানগর অফসেট প্রিন্টিং প্রেস। ঢাকার ইউসুফ প্রিন্টার্স ও বগুড়ার শরীফা প্রেস অ্যান্ড প্রাবলিকেশন্সকে তিন বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। দুই বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ঢাকার জিতু অফসেট প্রিন্টিং প্রেস, ন্যাশনাল প্রিন্টার্স এবং আর এম দাস রোডের ওয়েব টেক প্রিন্টার্সকে। এক বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ঢাকার বাকো অফসেট প্রেস, দিগন্ত অফসেট প্রেস, এবি কালার প্রেস ও মেসার্স প্রিন্ট প্লাসকে। অঙ্গীকারনামা (৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে) দিয়ে ছাড় পেয়েছে ছয়টি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো— ঢাকার সোমা প্রিন্টিং প্রেস, রাব্বিল প্রিন্টিং প্রেস, মেরাজ প্রেস আাান্ড পাবলিকেশন্স, লেটার এন কালার লি. সমতা প্রেস ও কাশেম আ্যাান্ড রহমান প্রিন্টিং প্রেস।