গুরুত্ব পাচ্ছে না গোয়েন্দা সতর্কতা

আমিরুল ইসলাম ও রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: মে ১৭, ২০২২, ০১:৪৭ এএম
গুরুত্ব পাচ্ছে না গোয়েন্দা সতর্কতা
  • ছয় সুপারিশের একটিও বাস্তবায়নের নজির নেই
  • যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সংকট মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ এখনো অজানা
  • রাশিয়া পরিচালিত প্রকল্পগুলো নিয়ে গোয়েন্দাদের উদ্বেগ নীরব সরকার

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পণ্যের বাজারে টালমাটাল অবস্থা। একদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে আমদানি ব্যয়, অন্যদিকে পণ্যের ঘাটতি। ফলে বাজারে হু হু করে সব জিনিসের দাম বাড়ছে। একই সাথে সংকটের আশঙ্কায় মজুত শুরু করেছে ভোক্তা থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতে ভোজ্য ও জ্বালানি তেলসহ জরুরি প্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত থাকার বিষয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। এ আশার বাণী খুব একটা কাজে আসছে না। 

কারণ পরস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ জনগণের সামনে দৃশ্যমান হয়নি। উল্টো ওএমএস কার্যক্রমে সরবরাহ কমানো হয়েছে। প্রান্তিক মানুষের মাঝে স্বল্পমূল্যে খাবার বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। চালু আছে শুধু শহরে। এর ফলে গম-আটার ঘাটতির বিষয়টি সামনে এসেছে। বাজারে সমানতালে বাড়ছে চালের দামও। 

অথচ যুদ্ধ শুরুর পরপরই একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে আগাম সতর্ক করা হয়। পরিস্থিতির প্রেক্ষাটপ ও ফলাফল তুলে ধরে বেশ কিছু সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে। সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিষয়ে দৈনিক আমার সংবাদকে নিশ্চিত করা হয়েছে।  

গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এতে অর্থনীতিতে যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব, আমদানি ও রপ্তানিতে সম্ভাব্য সংকট, পণ্যবাজারের অস্থিরতাসহ সার্বিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। একই সাথে পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বেশ কিছু সুপারিশ করে রাষ্ট্রের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থাটি। 

বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর পণ্যের বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব সংক্রান্ত ওই বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়— প্রতি বছর রাশিয়া ও ইউক্রেনে সরাসরি ও অন্য দেশের মাধ্যমে তৈরি পোশাক, পাট, হিময়িত খাদ্য, চা, চামড়াজাত পণ্য, সিরামিক পণ্য, তামাক, মাছ, ওষুধ, সবজি ইত্যাদি রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। 

অপরদিকে এই দুই দেশ থেকে বাংলাদেশে গম, ভুট্টা, সরিষা, মটর ডাল, মসুর ভাল, সূর্যমুখী তেল, খনিজসামগ্রী, রাসানিক পদার্থ, যন্ত্রাংশ ও প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন প্রকার পণ্য আমদানি করা হয়। এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশ ও ছোট এই দুই দেশের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় সারা বিশ্বে জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজারে অস্থিরতা এবং মূল্য বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে যুদ্ধের ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং বাংলাদেশেও নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।

যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৫০ লাখ টন গম আমদানি করে থাকে যার দুই তৃতীয়াংশই আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। যুদ্ধের কারণে ইউরেশিয়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক রুট কৃষ্ণসাগরে কোনো ধরনের জাহাজ প্রবেশ করছে না। ফলে দেশ দুটি থেকে গম ও ভুট্টা আমদানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকায় প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে দেশের বাজারে। এ ছাড়া অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশসমূহে বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে গম ও ভুট্টার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, যুদ্ধ শুরু হতেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। 

পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে বা অবনতি হলে জ্বালানি তেলের মূল্য আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা এবং দেশের বাজারে গম, ভুট্টা ও ভোজ্যতেলের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার বিষয়টি সরকারের নজরে আনা হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি এবং পণ্যের বাজার আরো অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। রপ্তানি খাতে যুদ্ধের প্রভাব আলোকপাত করে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। 

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যুদ্ধরত দেশ দুটির সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনের তথ্যমতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি হয় ৪৮৫ দশমিক ২৩ মার্কিন ডলারের। এর বিপরীতে ৬২৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয় ইউক্রেনের সাথে। দেশ দুটির সাথে বাণিজ্যের পরিমাণ কম হলেও যুদ্ধের প্রভাবে অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। 

যেমন— তেল রপ্তানিতে রাশিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়। কিন্তু যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল রপ্তানি বাধাগ্রস্ত এবং পশ্চিমাদের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় কৌশল হিসেবে রাশিয়া জ্বালানি তেল রপ্তানি হ্রাস করে। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বর্তমানে ব্যারেল প্রতি ২০ ডলারের মতো বেড়ে যায়। এর ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া জ্বালানি তেলে সরকারের ভর্তুকি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। একই সাথে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের অংশ হিসেবে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে ‘সুইফট’ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় রাশিয়ার সাথে আন্তর্জাতিক মুদ্রার লেনদেন ব্যাহত হচ্ছে। যার কারণে বাংলাদেশের অতি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত চলমান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্পের কাজ বাধ্যগ্রস্ত হতে পারে। চলমান প্রকল্পসমূহের কাজ ব্যাহত হলে দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। 

এছাড়া এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তায় পড়ায় বিশ্ব পুঁজিবাজারে বড় অংকের দরপতন ঘটেছে। যার প্রভাব দেশের পুঁজিবাজারে পড়তে পারে বলে সরকারকে আগাম সতর্ক করে গোয়েন্দা সংস্থাটি। পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বিকল্প উপায় ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, যুদ্ধের কারণে ৩৬টি দেশের সাথে রাশিয়ার বিমান যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। 

এতে পণ্য পরিবহনও ব্যাহত হচ্ছে। কৃষ্ণসাগর ব্যবহার করতে না পারায় অনেক জাহাজকে বহু দেশ ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে। যার কারণে পরিবহন খাতে আকাশ ও নৌপথে ব্যয় অনেকগুণ বেড়ে গেছে। দেশের বাজারে বেশ কিছু আমদানিনির্ভর পণ্যে ইতোমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তাই বিকল্প রুট অথবা আকাশপথ ব্যবহার করতে হবে। যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলায় গোয়েন্দা সংস্থাটির পক্ষ থেকে কয়েকটি সুপারিশ পাঠানো হয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে। 

সুপারিশগুলো হলো— ১. যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আগেই সরকারিভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে গম ও ভুট্টা আমদানি করে মজুত করা। ২. রাশিয়া ও ইউক্রেন ছাড়াও বিশ্বের নতুন নতুন দেশে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা। ৩. রাশিয়ার ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নে দেশে চলমান প্রকল্পসমূহের কার্যক্রম যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ৪. কৃষ্ণ সাগরের আশেপাশের দেশসমূহে যুদ্ধকালীন পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আকাশপথ ব্যবহার করা। ৫. গম ও ভুট্টার আমদানি-নির্ভরতা কমাতে ও স্থায়ী সমাধানের জন্য দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রান্তিক কৃষকদের এ খাতে ভর্তুকি প্রদানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা। ৬. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দেশে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন অপপ্রচার চালিয়ে বা গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেই বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করা এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা।

কিন্তু তিন মাস পেরিয়ে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। যুদ্ধ প্রেক্ষাপটে গুজব নিয়ন্ত্রণে নেই সচেতনতা কার্যক্রম। সরকারের ক্রয় কমিটিতে পাস হওয়া তথ্যেও নেই যুদ্ধের জন্য আলাদা কোনো প্রস্তুতি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে— রাশিয়া যুদ্ধের কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে কোনো প্রভাব পড়বে না। এ ক্ষেত্রে গোয়ান্দা সতর্কতা আমলে নেয়া হয়নি। কোন তথ্যে সরকারের মন্ত্রীরা এসব বক্তব্য দিচ্ছেন তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য পর্যালোচনা করে নতুন কোনো দেশে রপ্তানির তথ্য মেলেনি। 

আমদানি-রপ্তানিতে বিকল্প পরিবহন ও রুটের যে সুপারিশ করা হয়েছে সে বিষয়েও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এক কথায় যুদ্ধ সতর্কতায় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে যে সতর্ক বাণী দেয়া হয়েছে তা সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু বাজারসহ সার্বিক অর্থনীতিতে যুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সরকার কোন নীতি অবলম্বন করবে তা নিয়ে নাগরিকসমাজের মাঝে  কৌতূহল বাড়ছে।