আর কত কমাব খরচ

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: মে ২৫, ২০২২, ০১:১১ এএম
আর কত কমাব খরচ

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, মহামারির প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাজার সিন্ডিকেটসহ নানা অজুহাতে বাড়ছে পণ্যের দাম। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তিতর্ক চলে। কিন্তু এসব আলোচনা-সমালোচনায় মূল ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমছে না। লাগামহীন বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে টিকে থাকতে নানা হিসাব-নিকাশ ও খরচে কাটছাঁট চলছে প্রতিটি পরিবারে। 

ঊর্ধ্বমুখী বাজারের বিপরীতে আয় না বাড়ায় কোনো হিসাবই কাজে আসছে না। খরচ কমাতে গিয়ে শখ আহ্লাদ, সন্তানের নানা আবদার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করে খাওয়ানো; বিয়ে, আকিকা, জন্মদিনসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান এমন সব বিষয় গুটিয়ে নেয়ার পরও ক্রমেই থেমে যাচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের সংসারের চাকা। সংসারের যাবতীয় খরচের শুধু খাবারেই ব্যয় বেড়েছে ৪০ শতাংশ। ব্যয় বৃদ্ধির এ সূচক কমার কোনো সুখবর নেই। নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়ার পূর্বাভাস দিয়ে ভোক্তাদের সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। কিন্তু সাধারণ ভোক্তারা বলছেন আর কত কমাব খরচ।

রাজধানীর টিকাটুলিতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন মো. মিজান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আইটি সেবাদানকারী ছোট একটি প্রতিষ্ঠান চালান তিনি। করোনায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দিনরাত ঘামঝরানো পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। প্রতিযোগিতার বাজারে কাজ পাওয়া মুশকিল। কাজ পেলেও পুঁজির অভাবে সব কাজ করতে পারেন না। যেসব প্রতিষ্ঠানের কাজ করেন তারাও আছেন সমস্যায়। নির্ধারিত সময়ে বিল পরিশোধ করে না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। এসব সমস্যার আড়ালে মিজানের মূল প্রতিপক্ষ নিত্যপণ্যের বাজার। 

আমার সংবাদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, খবরে দেখলাম বাণিজ্যমন্ত্রী আমাদের সাশ্রয়ী হতে বলেছেন। আর কত খরচ কমাব বলেন? আগে গ্রাম থেকে অনেকে চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কাজে ঢাকায় এলে আমার বাসায় থাকত। যতটুকু সম্ভব মেহমানদারি করতাম। উপকার হতো তাই সবার প্রিয়পাত্র ছিলাম। এখন আর কাউকে বাসায় নেই না। ব্যাপারটা কেউ বুঝে আবার কেউ বুঝতে চায় না। ছোট ভাইকে লেখাপড়ার খরচ বাবদ প্রতিমাসে দুই হাজার টাকা দিতাম। এখন এক হাজার করে দিচ্ছি। ভাইয়ের টিউশনি নাই বেশি দেয়া দরকার, উল্টো কম দিচ্ছি; উপায় নেই। আইএফআইসি ব্যাংকে চাকরি করেন নাজমুল হাসান (ছদ্মনাম)। থাকেন কমলাপুর এলাকায়। 

তিনি বলেন, গতমাসে বন্ধুর বিয়ে ছিল। অফিসের ব্যস্ততা দেখিয়ে যাইনি। খরচ বাঁচাতে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে চলছি। মেয়েকে কথা দিয়েছিমান কক্সবাজার বেড়াতে নিয়ে যাব। এখন নানা অজুহাতে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। কাটছাঁট করেই সংসার চালিয়ে যাচ্ছি কোনোমতে। দৈনন্দিন খরচের ক্ষেত্রে অন্যসব বাদ দিলেও শুধু খাবার খরচই বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। সে অনুপাতে আয় বাড়েনি কারোই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ২০২১ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, উচ্চমাত্রায় সক্রিয় একজন মানুষের খাদ্যতালিকায় দৈনিক ৩৩৩ গ্রাম চাল, ৩৯ গ্রাম আটা, ৫০ গ্রাম আলু, ৬০ গ্রাম ডাল, ৪৫ গ্রাম ভোজ্যতেল ও ২৫ গ্রাম চিনি দরকার। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারির বাজার দরের তালিকা অনুযায়ী, তখন একজন শ্রমিকের এক দিনের খাদ্যের জন্য এসব পণ্য পরিমাণমতো কিনতে ব্যয় হতো ২৩ টাকার কিছু কম। এখন হয় ৩২ টাকার বেশি। 

এই জরিপে শ্রমিকের খাদ্যতালিকায় এসব পণ্য ছাড়াও বীজজাতীয় খাদ্য, শাক, কলা, মাছ, দুধ ও কাঁঠালের বিচি রয়েছে। সব মিলিয়ে তালিকায় ১৪টি পণ্য রয়েছে, যা দুই হাজার ৩০০ ক্যালরি খাদ্যশক্তির সমান। জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে জরিপকালে একজন শ্রমজীবীর এক দিনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম ছিল ১২৪ টাকা। মাঝারি মাত্রায় সক্রিয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যয় ছিল ৬৮ টাকা আর কম সক্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে ব্যয় দেখানো হয়েছিল ৫৬ টাকার কিছু বেশি। শিশুদের বয়সভেদে ৩৩ থেকে ১২১ টাকার খাদ্যের দরকার ছিল ২০২১ সালে। সব মিলিয়ে দেখা যায়, পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে ২০২১ সালে খাদ্যের ব্যয় ছিল দিনে প্রায় ৪০০ টাকা। খাদ্যপণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, আটা, ডাল, ভোজ্যতেল, শাকসবজি, মাছ, কম দামি ফল, ডিম, দুধ ইত্যাদি। 

বাংলাদেশে সহজে পাওয়া যায় এবং দাম কম, এমন খাদ্য ওই তালিকায় রাখা হয়েছে। বর্তমানে সমপরিমাণ খাদ্যের জন্য ব্যয় হচ্ছে ৫৬০-৬০০ টাকা। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে ও আয় না বাড়লে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমিয়ে দেন দরিদ্র মানুষরা। তারা ডাল, ভাত, আলু ও সবজি খেয়ে কোনোমতে জীবনযাপন করেন। এতে তারা মারাত্মক রোগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন। 

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের প্রয়োজনীয় ক্যালরি এবং নির্দিষ্ট অনুপাতে সুষম খাবার খেতে হয়। খাবারের দাম বেড়ে গেলে একই সঙ্গে ক্যালরি ও সুষম খাবার দুটোতেই ঘাটতি দেখা দেয়। এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী শিশুরা। কারণ শিশুরা আমিষ না পেলে তাদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। সাধারণত দু-তিন বছরের মধ্যে শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটে। এ সময় পুষ্টিকর খাবার না পেলে সারাজীবনের জন্য তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।’ 

অতি দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় দ্রব্যমূল্যের প্রভাব সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, খাদ্যঘাটতির কারণে মানুষ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কমছে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ফলে মৃতুঝুঁকি বাড়ছে। এসব কারণে শিশুমৃত্যু বেড়ে গেলে দেশের গড় আয়ু কমে যেতে পারে বলে মনে করেন এ চিকিৎসা বিজ্ঞানী।