ভুয়া প্রতিষ্ঠানের খোলসে পাচার!

ইসলামী ব্যাংকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারি

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২২, ১২:৩৯ এএম
ইসলামী ব্যাংকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারি

ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত ব্যাংকগুলোতে চলছে ঋণের নামে হরিলুট। ঋণ বিতরণের কোনো নীয়মনীতি মানা হচ্ছে না। নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণে টাকা ঢেলে যাচ্ছে তিনটি ব্যাংক। বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণের নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের খোলসে পাচার হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন ও ব্যাংকগুলোর নথিপত্র অনুযায়ী, অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রভাবশালী চক্র।

সূত্রের তথ্য মতে, বিপুল এ ঋণকেলেঙ্কারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা  এবং কয়েকজন পরিচালক এ লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছেন।

তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-আইবিবিএল থেকে ১১টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রভাবশালী চক্রের যোগসাজশে গায়েবি প্রতিষ্ঠানে তিন ইসলামি ব্যাংক বিপুল পরিমাণ এ অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথাকথিত এই ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানির নামে অর্থপাচারে জড়িত থাকতে পারে। তাই ওভার ইনভয়েসিং ও ব্যাক টু ব্যাক এলসির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ ইতোমধ্যে বিদেশে চলে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসএস স্ট্রেইট লাইন নামে গত ৮ আগস্ট রেজিস্ট্রার অব জয়েন স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) থেকে একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন দুজন ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সামিউল আলিমের বাড়ি রাজশাহীর দাওকান্দি, কলুপাড়া এলাকায়। একই জেলার পবা এলাকার মো. শাহজাহান আলী আছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে। কৃষিপণ্য উৎপাদন, আমদানি ও বিপণনের উদ্দেশ্যে তিন কোটি টাকা মূলধনে তারা দু’জন মিলে কোম্পানিটি গড়ে তুলেছেন। বনানীর বি-ব্লকের ২৩ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়িতে (সিলভার স্টোন শাফায়ার) কোম্পানিটির অফিস। তার ঠিক এক মাস পর ১১ সেপ্টেম্বর একই ঠিকানায় একই ধরনের ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে সমপরিমাণ মূলধনে আরও দুটি কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন হয়েছে আরজেএসসিতে। এ প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকও দুজন করে। এর মধ্যে মেডিগ্রিন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল রাকিবের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুবিন আহমেদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে।

এছাড়া খুলনার মো. আবদুল্লাহ শেখ মার্টস বিজনেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। এ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন। তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। এ তিনটি প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-আইবিবিএল থেকে শত কোটি টাকা করে ফিক্সট ডিপোজিট (ইসলামী ব্যাংকের পরিভাষায় টিডিআর/এমটিডিআর) জামানত রেখে মোট দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অপর একটি প্রতিষ্ঠান এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৫০ কোটি টাকা জামানতে ঋণ নিয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। আরজেএসসিতে প্রতিষ্ঠানটির তথ্য নেই। কিন্তু ঋণের নথিপত্র অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. জাহান বকশ। ব্যবসায়িক ঠিকানা রাজশাহীর পবা এলাকার দাওকান্দির তেকাতাপাড়ায়।

ব্যাংক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী এ চারটি প্রতিষ্ঠান বিপুল ঋণের নামমাত্র যে জামানত রেখেছিল তার ৯০ শতাংশ উত্তোলন করে নিয়েছে। (ইসলামী ব্যাংকের টিডিআর বা এমটিডিআর থেকে আমানতের টাকা উত্তোলনের সুযোগ রয়েছে। যদিও ডিপোজিট জামানত রাখলে উত্তোলন সুবিধা রহিত হয়ে যায়) অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান চারটির তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে জামানত আছে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা। তবে আরজেএসসিতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে লোনের কোনো তথ্য নেই। নিয়ম অনুযায়ী আরজেএসসিকে লোনের তথ্য দেয় ব্যাংক। এর জন্য তারা ৬০ দিন সময় পায়। প্রতিষ্ঠানগুলোর লোন স্টেটম্যান্টের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংকের ১৯৭৫তম ইসি মিটিংয়ে এসএস স্ট্রেইট লাইন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়েছে। ৩৪৩ নং ম্যামোর ওই ঋণটি দুদিন পর ২১ সেপ্টেম্বর ৬৮৬ নং স্মারকে সেনশন হয়েছে। এর একমাস পর ২৪ অক্টোবর ইসলামী ব্যাংকের ১৯৭৮তম ইসি মিটিংয়ে মেডিগ্রিন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়েছে; যার ম্যামো নং ৪২৩। একই মিটিংয়ে মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ৯০০ কোটি (ম্যামো নং ৪২২) ও  এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ৫০০ কোটি টাকা (ম্যামো নং ৪২১) ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গত ২৬ ও ২৭ অক্টোবর ৮০৮, ৮১১ ও ৮১২ নং স্মারকে ঋণ তিনটি সেনশন হয়েছে। ঋণ অনুমোদনের সময় এসব প্রতিষ্ঠানের বয়স হয়েছিল মাত্র একমাস।

কোনোরকম ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও মাত্র দেড় মাস বয়সের স্বল্প মূলধনী এসব প্রতিষ্ঠানকে একরকম বিনা জামানতে বিশাল অঙ্কের এ ঋণ অস্বাভাবিক মনে হয়েছে আমার সংবাদের কাছে। তাই ঋণের নথির তথ্য অনুযায়ী প্রথমে আরজেএসসিতে খোঁজ নেয়া হয়। আরজেএসসিতে কোম্পানিগুলোর দেয়া ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায় ‘সিলভারস্টোন শাফায়ার’ নামের ভবনটি একটি আবাসিক ভবন। যার সামনে লেখা আছে ‘অফিস ভাড়া দেয়া হয় না’। অথচ ইসলামী ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের লোন নেয়া অন্তত চারটি কোম্পানি এই ভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেছে।

ভবনের নিরাপত্তাকর্মী হারুন অর রশীদ বলেন, ‘এটি একটি আবাসিক ভবন। এখানে কোনো অফিস নেই। যদি কেউ নিজের ফ্লাটে কোনো প্রতিষ্ঠানের অফিস হিসেবে ব্যবহার করত তাহলো অন্তত এই নামগুলো তারা জানতেন। সেখানে উপস্থিত ভবনের বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা আরও কয়েকজনের কাছে জানতে চাওয়া হয় আশেপাশে এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা তারা জানেন কি-না। তারা জানান, এ ধরনের নাম তারা প্রথম শুনেছেন। এরপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের নাম বলা হয়।

তারা জানায়, এসব নামের কারও বাসা নেই এবং এমন কাউকে তারা চিনেন না। হারুন অর রশীদ বলেন, আমি অনেকদিন এখানে কাজ করছি, যদি এসব নামের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এখানে থাকত; তাহলে কেউ না কেউ তাদের চিনত। এরপর যাওয়া হয় লোনের নথিতে ব্যবহার করা ঠিকানায়। বনানীর ডি-ব্লকের ১৭ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় নাবিল গ্রুপের অফিস। সেখানে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আশেপাশের ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাইলে তারা এসব নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা শুনেননি বলে জানান। প্রতিষ্ঠানগুলো নাবিল গ্রুপের কি-না তা জানেন না খোদ গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম স্বপন।

তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আমি এখনি বলতে চাচ্ছি না। তবে তথ্য সংগ্রহ করে পরে জানাতে পারব।’ কিন্তু পরবর্তীতে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল রাজশাহী জেলার পবা থানার দাওকান্দি এলাকার তেকাতাপারায় অবস্থিত নাবিল গ্রুপের একটি অফিসের ঠিকানা ব্যবহার করেছে। গ্রুপটির এমডি আমিনুল ইসলাম স্বপনের গ্রামের বাড়ি ওই এলাকায়।

এ বিষয়েও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আমিনুল ইসলামের বাবা মো. জাহান বকশ এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনলে প্রোপ্রাইটর (মালিক)। তিনি নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও আছেন। আর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা কেউ তার আত্মীয় কেউ ব্যবসায়িক সহযোগী। অর্থাৎ প্রতিটি ঋণের নেপথ্যে নাবিল গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতাপশালী কারও যোগসাজশে একটি আঞ্চলিক গ্রুপের এমডি আর্থিক খাতের নয়া মাফিয়া হয়ে উঠছেন। ইসলামী ব্যাংকের মতো একটি স্বনামধন্য ব্যাংক থেকে এভাবে বেনামি লোন সৃষ্টি করা বিস্ময়কর বলছেন খোদ ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা।

রাজশাহীর একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার সংবাদকে বলেন, ‘সমপ্রতি প্রকাশিত প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সারে ছয় হাজার কোটি টাকা বেনামি ঋণ কেলেঙ্কারির কোনো তদন্ত বা বিচার হয়নি। অদৃশ্য ইশারায় পার পেয়ে যাচ্ছে দেশের অখ্যাত এই শিল্প গ্রুপটি। এর ফলে আরও বেপোরোয়া হয়ে পড়েছে আর্থিক খাতের এই নয়া মাফিয়া।’

এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘নাবিল তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নামে শতশত কোটি টাকা লোন করেছে। নাবিলের একজন পিয়নের নামে শতকোটি টাকা লোন রয়েছে; যিনি সাইকেল চালিয়ে অফিসে আসেন।’ইসলামী ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে বিপুল এ অর্থ লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে প্রথমে অন্য প্রতিষ্ঠানে, এরপর সোজা বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রতাপশালী গ্রুপটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এস এস স্ট্রেইট লাইনকে ৯০০ কোটি টাকা দিয়েছে রাজধানীর কাকরাইল এলাকায় অবস্থিত ইসলামী ব্যাংকের ভিআইপি রোড শাখা।

শাখার ব্যবস্থাপক মজনুজ্জামানের কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়াই অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে লোন দেয়া হয়েছে।

তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘লোন দেয়ার আগে আমরা নিয়ম মেনে পরীক্ষা করে তারপরই লোন দিয়েছি।’ যেহেতু বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব নেই তাই জেনে বুঝেই কারসাজির উদ্দেশ্যে লোনটি দেয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ প্রশ্নের উত্তর প্রধান কার্যালয় দেবে। তাদের নির্দেশনা মেনেই আমরা ঋণ দিয়েছি। ঋণটি পরীক্ষা করেই এক্সিকিউটিভ কমিটি পাশ করেছে।’ মেডিগ্রিনকে ৯০০ কোটি টাকা দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের নবাবপুর শাখা। এ বিষয়ে শাখা ব্যবস্থাপকের মন্তব্য নিতে তার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।’

মার্টস বিজনেস লিমিটেডকে ৯০০ কোটি টাকা দিয়েছে ব্যাংকটির ফার্মগেট শাখা। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে লোন দেয়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি শাখা ব্যবস্থাপক আবদুর রব মৃধা। জামানত হিসেবে থাকা এমটিডিআর প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে উত্তোলন করল জানতে চাইলে তিনি, নীরব থাকেন। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় সব হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ৫০০ কোটি টাকা দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা।

অন্য দিকে,  ব্যাংকটির গুলশান-২ শাখা থেকে নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডকে ৯৫০ কোটি টাকা ও রাজশাহী শাখা থেকে নাবিল ফিড মিলস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ বা বিনিয়োগ চলতি বছরের ২১ মার্চ ব্যাংকের ৩০৮তম বোর্ডসভায় অনুমোদন দেয়া হয়। যা জামানতবিহীন সন্দেহজনক ঋণ; বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ব্যাংকটির গুলশান-২ শাখা থেকে নাবা অ্যাগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে আরও এক হাজার ১৪৮ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজশাহী শাখা থেকে গত কয়েক মাসে বিপুল অঙ্কের ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্ট প্যালেসকে ৫০০ কোটি, নাবা ফার্ম লিমিটেডকে ৪৮৯ কোটি, নাবিল ফিড মিলস লিমিটেডকে পুনরায় ১৭০ কোটি, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে এক হাজার কোটি, শিমুল এন্টারপ্রাইজকে এক হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই কাগুজে। সরেজমিন এগুলোর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে লোনগুলো মুরাবাহা টিআর পদ্বতিতে বিনিয়োগ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের স্বত্ব্বাধিকারে পণ্য ক্রয় করতে হয়। এরপর ওই পণ্যের রশিদের বিপরীতে অর্থায়ন করে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো। কিন্তু এসব লোনের ক্ষেত্রে পণ্য ক্রয়ের রশিদ ছাড়াই নগদ অর্থ দেয়া হয়েছে। যা ইসলামী ব্যাংকিংয়ে শরিয়তসম্মত নয়।

এসব বিষয়ে জানতে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। জনসংযোগ বিভাগের প্রধান ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলামের কাছে এমডির বক্তব্য চেয়ে লিখিত আবেদন করা হয়। এ ছাড়া এমডির হোয়াট্সঅ্যাপে একাধিক ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয়েছে; কিন্তু কোনো মাধ্যমেই তিনি সাড়া দেননি।

এছাড়াও চলতি বছরের ২৩ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৪৬তম বোর্ডসভায় নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস ও শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। একই বছরের ৩০ মে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম বোর্ডসভায় গুলশান শাখা থেকে নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান নাবিল ফিড মিলস ও শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে এক হাজার ১২০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে সন্দেহজনক ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ঋণের বিষয়ে জানতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাঈদ ওয়াশিক মো. আলীকে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে বেরিয়ে আসে এসআইবিএলের বিশাল এক ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য। পণ্য আমদানি বাবদ ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে ব্যাংকটির বনানী শাখা থেকে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শার্প নিটিং অ্যান্ড ডায়িং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। যার পুরো অর্থ পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। লাইসেন্সবিহীন এই প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে পরিদর্শনের সারসংক্ষেপ পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এতে দেখা যায়, কোনো প্রকার বৈধ বন্ডেড ওয়ারহাউজ লাইসেন্স লাইসেন্স ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৮৮৯টি ব্যাকটু ব্যাক এলসি খুলেছে। এর পরিমাণ ১৫৮ কোটি মার্কিন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় বর্তমান রপ্তানি নগদায়ন বিনিময় মূল্য ১০০ টাকা হিসাবে এর পরিমাণ ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বিপুল এ অর্থের এলসির বিপরীতে পণ্য রপ্তানি করার কথা থাকলেও বাস্তবে কোনো কাঁচামাল আমদানি বা রপ্তানি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকদল প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় আমদানিকৃত কাঁচামাল বা প্রস্তুতকৃত কোনো পণ্যের মজুত পায়নি। অর্থাৎ রপ্তানি ছাড়াই আমদানির এলসি খুলে বিপুল এ অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইসলামী ধারার তিন ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।

এ বিষয়ে এসআইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলমের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত পরিদর্শন ছিল। এ ধরনের অভিযোগ পেলে তো আমরা নিজেরাই ব্যবস্থা নেবো।’ ছয় বছর ধরে চলে আসা এ অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে অবগত আছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি আমার এমডি হিসেবে যোগদানের আগের। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সার্বিক বিষয়ে স্বচ্ছতার সাথে পরিচালনার চেষ্টা করছি।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘ব্যাকিং সেক্টরে মোটা দাগে দুটি বড় সমস্যা রয়েছে। একটি হলো এনপিএল বা খেলাপি ঋণ। যা সরকারি ব্যাংকে বেশি ঘটে। অন্যটি হলো আরপিএল বা রিলেটেড পার্টি ল্যান্ডিং। বেসরকারি ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আরপিএল। যার মাধ্যমে খোলস তৈরি করে অর্থ সরিয়ে নেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত আরপিএলের প্রকৃত তথ্য বের করে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।’

তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের একটি অনুমানভিত্তিক রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতে আরপিএলের পরিমাণ মোট ঋণের ২০ শতাংশের বেশি। এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, রপ্তানি আদেশ ছাড়া ব্যাংক থেকে ডলার দিয়ে এলসি খোলার কোনো সুযোগ নেই। যদি এমনটা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া।’