রোমাঞ্চকর গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে মানুষের ঢল

কে এম সালেহ, ঝিনাইদহ প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২৪, ১০:১৬ এএম
রোমাঞ্চকর গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে মানুষের ঢল
ছবি: আমার সংবাদ

আবহমান কাল থেকে কৃষকের হালচাষের  একমাত্র ভরসা ছিল গরু। আর মাঠ থেকে কৃষি পণ্য বহনের জন্য ব্যবহার করা হতো গরুর গাড়ি। কালের বির্বতনে সে সবের পরিবর্তে এখন শুরু হয়েছে যান্ত্রিক চাষাবাদ ও পরিবহন ব্যবস্থা। এখনো সেই পুরাতন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বছরের এই সময়ে কৃষকের গরু এবং গরুর গাড়ি নিয়ে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় সাথে আয়োজন করা হয় গ্রামীন মেলার।

জোয়াল কাঁধে দেওয়ার পর কর্তার হাতের ছোঁয়ায় যেন মুহূর্তে পাল্টে যায় চরিত্র। একে অপরকে পেছনে ফেলতে ছুটতে থাকে বিদ্যুৎ গতিতে। যা দেখে উচ্ছসিত হাজার হাজার দর্শক। তেমনই এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না ইউনিয়নের বেতাই গ্রামের মাঠে ।

শনিবার (২০ জানুয়ারি) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ দৌড় পতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আর এই খেলাকে কেন্দ্র করে বসে গ্রামীণ মেলা। মেলায় স্থান পায় মিষ্টি, মিঠাই, মেয়েদের বিভিন্ন প্রসাধনী, বাচ্চাদের জন্য ছিল নাগরদোলা ও চরকি খেলা।

মেলায় গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যন্ত পল্লী ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বেতাই গ্রামের মাঠ। ঘনকুয়াশা, বৈরী আবহাওয়া ও প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে আশেপাশের জেলাসহ কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে শুধুমাত্র গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী ব্যতিক্রমী গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগীতা ও গ্রামীণ মেলা উপভোগ করতে। বেতাই মাঠ জুড়ে যেন উৎসবে পরিণত হয়। আমন মৌসুমের ধান কাটার পর ফাঁকা মাঠে এই গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। গরুর গাড়ির এমন রোমাঞ্চকর প্রতিযোগিতা দেখতে আশপাশের কয়েক গ্রামের নারী, পুরুষ ও শিশুরাও অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে সকাল থেকে মাঠে উপস্থিত হয়। দুর-দুরান্ত থেকেও দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়াও বিভিন্ন খাবারের দোকান ও শিশুদের জন্য নাগরদোলাসহ বিভিন্ন স্টল বসেছিল মাঠটিতে।

আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইদহের  সদর, মহেশপুর, যশোরের  চৌগাছা, এবং চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর, আলমডাঙ্গা থেকে আগত ১১টি গরুর গাড়ীর দল এ প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিজয়ী ১ম পুরস্কার ২০ হাজার টাকা, ২য় পুরস্কার ১৫ হাজার টাকা, ৩য় পুরস্কার ১০ হাজার টাকা। এছাড়াও পত্যেক অংশগ্রহণকারী দলকে সান্তনা পুরস্কার দেওয়া হয়।

যশোর চৌগাছা থেকে গরুর গাড়ির দৌড় দেখতে আসা আলী হাসান জানান, আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি। আধুনিক যুগে এসে গরুর গাড়ির এমন দৌড় প্রতিযোগিতা দেখে আমাদের খুব ভালো লাগছে।

ঝিনাইদহের ডাকবাংলা এলাকা থেকে খেলা দেখতে আসা রবিউল জানান, তিনি এর আগে কখনো এই খেলা দেখেননি। লোকের মুখে শুনেছেন। এজন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এ ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি দৌড় খেলা দেখতে এসেছেন।

খেলায় অংশ নেওয়া হাবিবুর রহমান বলেন, এর আগেও বিভিন্ন অঞ্চলে খেলাই অংশগ্রহণ করেছি। খেলায় অংশ নিয়ে খেলা করা খুবই আনন্দের। এরকম আয়োজন বার বার হলে নতুন প্রজন্ম আমাদের গৌরবান্বিত ইতিহাস সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবে। তাই প্রতি বছর আয়োজন করা দরকার।

খেলা দেখতে আসা সেলিনা খাতুন  বলেন, ১০ বছর ধরে এই খেলা দেখে আসছি। আমার এখানে বাবার বাড়ি। গরুর গাড়ি যে মানুষকে এত আনন্দ দিতে পারে তা এখানে না এলে বোঝা যাবে না। এমন খেলা যেন প্রতিবছর হয় আমরা সেটাই চাই।

আসিয়া খাতুন জানান, তার স্বামীর বাড়ি শৈলকুপা উপজেলার ভাটই বাজারে। এখানে তার বাবার বাড়ি। প্রতিবছর খেলার সময় আসলে ভাইয়েরা ফোন করে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসে। পরিবারের সবাই মিলে খেলা দেখতে আসেন। এটা তাদের কাছে ঈদের আনন্দের চেয়েও বেশি।

খেলার আয়োজক গান্না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতিকুল হাসান মাসুম বলেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতেই প্রতিবছর এই খেলার আয়োজন করা হয়। আগামীতে আরও বেশি উৎসব মুখোর ও বড় পরিসরে এই খেলার আয়োজন করার ইচ্ছা আছে । এই খেলার মাধ্যমে দেশীয় ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই।

তিনি আরও বলেন, এবারের প্রতিযোগিতায় ঝিনাইদহ জেলা মহেশপুর উপজেলার মিরাজ হোসেনকে ১ম পুরুস্কার হিসেবে ২০ হাজার টাকা, যশোরের জোড়াদাহ থেকে আয়ুব হোসেন ২য় হওয়ায় তাকে ১৫ হাজার টাকা এবং চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর গঙ্গারামপুর মিয়ারাজ ৩য় হওয়ায় তাকে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অংশগ্রহণকারী সবাইকে শান্তনা পুরুস্কার হিসেবে ২ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।

গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। তিনি  বলেন, সমাজ থেকে অন্যায়, অপরাধ ও মাদক দুর করতে হলে এ ধরনের বিনোদনের কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে যুবসমাজকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে হলে, তাদের নিয়মিত খেলার মাধ্যমে বিনোদনের মধ্যে রাখতে হবে। এছাড়াও দেশের ঐতিহ্যবাহী খেলার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পরিচিতি করানোর জন্য হলেও সরকারিভাবে এইসব আয়োজন করা উচিৎ।

এআরএস