চার বছর মেয়াদি প্রকল্পের সময় শেষ হয়েছে গত ৩০ জুন। এর আগেই দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বহুল আলোচিত ইউনিক আইডির তথ্য সংগ্রহের সময়। তথ্য গরমিলে বেড়েছে ভোগান্তির জটও। এ প্রকল্পের আওতায় প্রথমদিকে এক কোটি ৬০ লাখ শিক্ষার্থীকে ‘ইউনিক আইডি’ দেয়ার কথা। তবে মেয়াদ শেষ হলেও একজন শিক্ষার্থীর হাতেও ইউনিক আইডি তুলে দেয়া সম্ভব হয়নি। প্রকল্পটির শুরুতেই নানা জটিলতায় শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির শিকার হলেও এ মুহূর্তেই সে ভোগান্তির ইতি টানা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সব কাজ অচলাবস্থায় থাকায় প্রকল্পের সময় বাড়াতে জোর তদবিরে ব্যস্ত সংশ্লিষ্টরা। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্য একটি ইউনিক আইডি তৈরি এবং সমন্বিত শিক্ষাতথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রণয়ন করতে এ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পের আওতায় এ আইডিতে শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুলের ফি, পরীক্ষার ফলাফল, রক্তের গ্রুপ, বই সংগ্রহ, রেজিস্ট্রেশন, বৃত্তি-উপবৃত্তির অর্থ নেয়া অর্থাৎ যত ধরনের নাগরিক সেবা আছে তার সবকিছুই পাওয়ার কথা রয়েছে। এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইইআইএমএস) প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা চার পৃষ্ঠার ফরমে শিক্ষার্থীর নাম, জন্মনিবন্ধন নম্বর, জন্মস্থান, জেন্ডার, জাতীয়তা, ধর্ম, অধ্যয়নরত শ্রেণি, রোল নম্বর, বৈবাহিক অবস্থা, প্রতিবন্ধিতা (ডিজঅ্যাবিলিটি), রক্তের গ্রুপ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কি-না, মা-বাবার নামসহ বেশকিছু তথ্য ঘর রয়েছে।
বৈবাহিক অবস্থার অপশন হিসেবে অবিবাহিত, বিবাহিত, বিধবা, বিপত্নীক ছাড়াও স্বামী-স্ত্রী পৃথক বসবাস, তালাকপ্রাপ্ত, বিয়েবিচ্ছেদের তথ্যসহ সর্বমোট ১৫ ধরনের তথ্য সরবরাহ করতে অভিভাবকদের নির্দেশ দেয়া হয়। সে সময় প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৩৫৩ কোটি ২১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (ব্যানবেইস)। যেহেতু শিক্ষার্থীদের জন্ম নিবন্ধন সনদের ওপর ভিত্তি করে এই আইডি দেয়া হবে সেহেতু জন্ম নিবন্ধন সনদে অসঙ্গতি থেকেই পুরো প্রক্রিয়াটি স্থবির হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার গড়িমসিতেই প্রকল্পটি গতি হারিয়েছে বলেও অভিযোগ অনেকের।
এদিকে জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে প্রকল্পটির ধীরগতি নিয়ে ব্যানবেইস থেকে এ পর্যন্ত পাঁচবার তাগাদাপত্র দেয়া হলেও কোনো সাড়া দেয়নি জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়। অপরদিকে ব্যানবেইসের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করছে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়।
ইউনিক আইডি সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘স্টাবলিশমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ (আইইআইএমএস) উপ-প্রকল্প পরিচালক ড. মো. নাসির উদ্দিন গনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়ের সার্ভারের জটিলতা, তাদের জনবলের অভাব ও কর্মকর্তাদের গড়িমসির কারণেই এ সমস্যা হয়েছিল।
তবে আশার কথা হচ্ছে, গত এক সপ্তায় এ সমস্যা অনেকটাই কমে এসেছে। এই এক সপ্তাহেই আমরা প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থীর ইউনিক আইডির কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছি। অপরদিকে এক কোটি ষাট লাখ শিক্ষার্থীর মাঝে এক কোটি শিক্ষার্থীর ডাটা এন্ট্রিও সম্পন্ন হয়েছে। সার্ভার জটিলতা এবং টেকনিক্যাল সমস্যার বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা প্রতি ১০ মিনিটে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর তথ্য ইনপুটের অনুরোধ পাঠাচ্ছি। সে অনুযায়ী আমাদের অনুরোধের বিপরীতে তারা ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর তথ্য রেসপন্স করতে পারছে। বাকি ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর কারো নামের বানান ভুল, কারো জন্ম তারিখে অসঙ্গতি, কারো বাবা-মায়ের আইডির সাথে অসামঞ্জস্যতার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। আমরা আশা করছি, আগামী ডিসেম্বরের মাঝেই শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি হাতে তুলে দিতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের যে জটিলতা ছিল তা কেটে গেছে। করোনাকালীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ প্রকল্প গতি হারিয়েছিল। এখন করোনা না থাকায় দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে চলছে। ইউনিক আইডি পেতে যেহেতু শিক্ষার্থীদের চার পৃষ্ঠার তথ্য নিয়ে অনলাইনে ইনপুট করতে হয়, সেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা প্রকল্পটি ধীরগতির অন্যতম কারণ। আইডি প্রত্যাশী একজন শিক্ষার্থীকে তার স্বাক্ষর, বাবা-মায়ের এনআইডি, জন্ম নিবন্ধন নাম্বারসহ অনেক তথ্য সরবরাহ করতে হয়। করোনার কারণেই এ সব তথ্য পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।’
উপ-প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে অনলাইন জন্মনিবন্ধন নাম্বার একটি নতুন ধারণা। অনলাইনে এই জন্মনিবন্ধন নিতে গিয়ে সেবাপ্রত্যাশীরা ইউনিয়ন পরিষদে যে পরিমাণ ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তা এখনো কাটেনি। তবে আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এ সমস্যা কিছুটা কমে এসেছে। আমরা এক কোটি শিক্ষার্থীর ডাটাবেজ সম্পন্ন করেছি। আরও ৬০ লাখ শিক্ষার্থীর তথ্য পাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা ধারণা করছি, পুরো ৬০ লাখ শিক্ষার্থীর তথ্য পাওয়া যাবে না। কারণ অনেক জায়গায় দ্বৈত ছাত্রত্ব রয়েছে। অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের এমপিওভুক্তি এবং রেজিস্ট্রেশন সচল রাখাতে তাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি দেখায়। সুতরাং লোক দেখানো এরকম তালিকার শিক্ষার্থীরা দুইবার আইডি পাবে না। এ কারণে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা থেকে কিছু কম হবে। এমন আছে যে, মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেখিয়েছে ৬০০ জন অথচ সে মাদ্রাসায় প্রকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৫৭ জন।
সুতরাং এক কোটি ৬০ লাখ শিক্ষার্থীর জায়গায় আমরা এক কোটি ২০ থেকে ২৫ লাখ শিক্ষার্থীর তথ্য পেতে পারি।’ এ বিষয়ে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।