- ফের ক্ষমতার টার্গেট আ.লীগের, সিরিজ কর্মসূচি বিরোধীদের
- ভারত, চীন, রাশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি বাংলাদেশে
সংঘাত ও প্রভাবের পরিস্থিতি আসবে সবার আগে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে
—আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসতে সরকারি ও বিরোধী দলকে সমঝোতায় বসতে হবে
—ড. প্রণব কুমার পান্ডে
যে কোনোভাবেই হোক আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না
—সিরাজুল আলম খান
২০২২! ঘটনা মুছে যাবে বিস্মৃতির ধুলায়। করোনা, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও রাজনৈতিক সংকট জঞ্জাল-জটিলতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো বছরটি। নতুন প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছে নতুন বছর। এবার দুর্নীতি প্রতিরোধ, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকট মোকাবিলা, বেকার সমস্যা ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জ রয়েছে সামনে। সব কিছুকে ছাপিয়ে নতুন বছর চূড়ান্ত হবে বাংলাদেশে আরেকটি নতুন নেতৃত্বের। উন্নয়নের মাধ্যমে আরেকবার কি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, না-কি সরকারবিরোধীরা রাজপথে আন্দোলন ও বিদেশি হস্তক্ষেপে নতুন কিছু ঘটাবে— তা এ বছরই নির্ধারিত হয়ে যাবে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে হয়তো দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষমতা দখলের বিষয়ে নানা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। এ বছরটি সব দলেরই চ্যালেঞ্জের বছর।
আওয়ামী লীগ নতুন নেতৃত্ব গঠনের মাধ্যমে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন খেলা হবে— খুনের রাজনীতির বিরুদ্ধে, খেলা হবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, খেলা হবে আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, খেলা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, খেলা হবে লুটপাটের বিরুদ্ধে। কেউ মাঠে নেমে বিশৃঙ্খলা করলে আওয়ামী লীগ আঙুল চুষবে না, দাঁতভাঙা জবাব দেবে। অন্যদিকে বিএনপি লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশিত ছক অনুযায়ী রাজপথে নেমেছে। দেশের সব বিভাগে সমাবেশ বাস্তবায়ন করেছে। ঢাকার সমাবেশে যোগ দেয় লাখ লাখ মানুষ। গত শুক্রবার ঢাকাতে গণমিছিলে যোগ দেয় লক্ষাধিক মানুষ। মিছেলের প্রথম অংশ যখন মগবাজার চলে যায় তখনো শেষ মাথা কাকরাইলে থেকে যায় বলে দলটির পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়। বছর শেষে এসেই ২০২৩-এর প্রথম দশকে ঘোষণা করে দেয় নতুন কর্মসূচি। আগামী ১১ জানুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশে পালন করা হবে অবস্থান কর্মসূচি। এক ব্যানারে আন্দোলনে থাকবে জামায়াতসহ ৩২টি রাজনৈতিক দল। এভাবেই সারা বছর সিরিজ কর্মসূচি চলতে থাকবে বলে জানান দল ও জোটটির নেতারা।
অন্যদিকে এবার ভারত, চীন, রাশিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র সব দেশ বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহী। পরিস্থিতি আকর্ষণ করার মতো বলে আকৃষ্ট হচ্ছে। ভূরাজনীতিরও একটি প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে। সবাই চায় বাংলাদেশকে নিজ প্রভাববলয়ের মধ্যে নিতে। সমপ্রতি তার দৃশ্য একেবারে প্রকাশ্যে চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়ে তাদের নিয়ে কথা বলছে। নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্গনের বিষয়ে আওয়াজ তুলছে। অন্যদিকে রাশিয়া তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হস্তক্ষেপের দাবি তুলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাদের এই স্নায়ুযুদ্ধে দেশের ক্ষতি দেখছেন। এটি যদি ২০২৩ এ চলতে থাকে দেশের জন্য খারাপ কিছুও অপেক্ষা করছে।
২০২২ সালটি ছিল রাজনৈতিক উত্তাপের বছর। দেশে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে সার্চ কমিটির মাধ্যমে, কিন্তু বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেনি। এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চলাকালে নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানালেও তারা সাড়া না দিয়ে অনাস্থা জ্ঞাপন করেছে। এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশন এগিয়ে চলেছে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে দেশে অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে। ঠিক একই সাথে সরকারের তরফ থেকে সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এই অবস্থায় আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে ধারণা করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেছেন। ভারত সফরে বাংলাদেশের কী প্রত্যাশা ছিল কিংবা কী প্রাপ্তি হয়েছে সে ব্যাপারে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই সফরকে সফল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি অগ্রাধিকারের শীর্ষে ছিল। যদিও ধারণা করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে এই চুক্তি সম্পাদিত হবে না। এই চুক্তিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নেতিবাচক মনোভাবের কারণেই এই চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি গত ১০ বছরের ওপর। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক না থাকাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেছেন। এ দিকে বছর শেষে দেশের সব বাম-ডান রাজনৈতিক দলের নেতারা এক জোট হয়েছেন। কর্নেল অলি আহমদ, ড. রেজা কিবরিয়া, আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সব বিরোধীরা সংসদ ভেঙে দেয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে ১০ দফা নিয়ে একমত হয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, রুহুল কবির রিজভী গ্রেপ্তারে ক্ষোভ জানাচ্ছেন। এ ছাড়া বিএনপির ২৭ দফা দাবি তোলা স্লোগানেও ঐকমত্য হয়েছে। আলাদা ব্যানার নিয়ে সবাই ঐকমত্য হয়ে রাজপথে নেমে পড়েছে। দেশের এমন পরিস্থিতিতে আসলে ২০২৩ সালে কী ঘটতে যাচ্ছে কেউ স্পষ্ট হতে পারছে না। সমঝোতায় রাজনৈতিক সমাধান আসবে নাকি সঙ্ঘাতে পরিস্থিতি অন্যদিকে যাবে।
নতুন বছরে প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘জনগণের যে প্রত্যাশা, তা পূরণে সরকারকে কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে যে বঞ্চিত মানুষ আছে, তাদের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের সুফল যেন তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে, সে ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার সুফল দেশের সব মানুষের ঘরে পৌঁছানো। তাই দেশের যেসব বিত্তবান মানুষ আছে, তারা যদি বঙ্গবন্ধুকন্যার পাশে থেকে কাজ করে, তা হলে সে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। এ ছাড়া চলতি বছর নির্বাচনি বছর, নানা সঙ্ঘাত ও প্রভাব পরিস্থিতি আসবে। সব কিছুকে ছাপিয়ে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক-প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পান্ডে বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচন হতে চলেছে। গত সাড়ে ১৩ বছরে আ.লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে, সেই উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে চলমান রাখতে হলে দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নির্বাচন সরকার পরিবর্তনের একমাত্র হাতিয়ার। নির্বাচিত সরকার যেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে পারে, তেমনি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রাতিষ্ঠানিক আকার দিতে সাহায্য করতে পারে। ফলে জনগণের প্রত্যাশা, ২০২৩ সালে সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যার মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। এর জন্য সরকারি এবং বিরোধী দলকে সমঝোতায় আসতে হবে। নির্বাচন কমিশন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জনগণের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দূরত্ব ভুলে দেশের এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে এক হয়ে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সহায়তা করবে।’
সমপ্রতি এ নিয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখী হয়ে রাজনৈতিক গবেষক ও রহস্য পুরুষ সিরাজুল আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে-২০২৩ সালে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে এক বছর বাকি। এখনই এ নিয়ে কোনো কিছু বলা ঠিক হবে না। আরো কয়েকদিন যাক, তারপর বলা যাবে। তবে নির্বাচন নির্বাচনের মতোই হবে। ২০১৪ সালেও হয়েছিল। ২০১৮ সালেও হয়েছিল। এবারো যে কোনোভাবে হোক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবেই। আসন্ন নির্বাচন কেউ ঠেকাতে পারবে না। এখনকার যারা রাজনীতিবিদ, তাদের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কিছুই নেই। দেশের ভবিষ্যৎ ভালো হবে না, যদি না নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়। নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। সঠিক হতে হবে। একজন বাঁকা, একজন সোজা হলে চলবে না। দেশটাকে যদি এখন আবার নতুন করে সাজানো যায়, তাহলে এখন যেমনটি হচ্ছে তেমনটি আর থাকবে না। অন্যথায় দেশটার যা কিছু ভালো সব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।’