বছরের অর্ধেক দগ্ধ শীতে

মাহমুদুল হাসান প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩, ০৩:০৯ পিএম
বছরের অর্ধেক দগ্ধ শীতে
  • সারা দেশে বছরে আনুমানিক পাঁচ লাখ মানুষ আগুনে পুড়ে যায়
  • অন্য মৌসুমের চেয়ে শীতকালে প্রায় তিনগুণের বেশি দগ্ধ হয়
  • শিশুরা বেশি দগ্ধ হয় গরম পানিতে নারীরা আগুন পোহাতে গিয়ে
  • ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে ২০২২ সালে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে ৯৮৪ জন
  • চাপ সামলাতে প্রস্তুত করা হলো ঢামেকের ১৪ আইসিইউ শয্যা

শীতে বাড়ে দগ্ধ রোগী। সম্প্রতি হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে। এতেই দেশের হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে দগ্ধ রোগী। গত বুধবার রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দগ্ধ এক গর্ভবতী নারীর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এবার শীতে দগ্ধ চারজনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। শীত নিবারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে আগুন পোহানো হয়। আর সারা দেশে বৃদ্ধ ও শিশুদের গোসলে গরম পানির ব্যবহার হয়। 

এই দুই উৎস থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ দগ্ধ হয়। কেরানীগঞ্জের রসুলপুর থেকে দেড় বছরের পুত্র আফিফকে নিয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এসেছেন ইমরান ও কানিজ দম্পতি। গতকাল দুপুরে এই প্রতিবেদককে কানিজ বলেন, বাচ্চার (আফিফের) গোসলের জন্য পানি গরম করেছিলাম। গোসলখানায় পানির পাত্র রেখে পাশের রুমে বাচ্চার কাপড় নিতে গিয়ে শুনি বাচ্চার চিৎকার। এসে দেখি খেলতে খেলতে আফিফ গরম পানিতে হাত দিয়ে দগ্ধ হয়েছে। 

আবার কুমিল্লার এক শিশুর অভিভাবক আব্দুর রাজ্জাক জানান, তার ১০ বছরের ভাগ্নে রাকিব গত মঙ্গলবার শীতের সকালে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়। খড়কুটোর আগুন রাকিবের গায়ের সোয়েটারে লেগে যায়। এতে তার শরীরের প্রায় ৩৫ শতাংশ পুড়ে যায়। তার অবস্থা এখনও আশঙ্কামুক্ত নয়। শুধু আফিফ কিংবা রাকিব নয়, এবার শীতের তীব্রতার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে রোগীও। গত বছরের রোগীর হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের মোট রোগীর মধ্যে শীতে প্রায় ৪৫ শতাংশ রোগী বেড়েছে। অন্য মৌসুমের চেয়ে এবার প্রায় তিনগুণ বেশি দগ্ধ রোগী ভর্তি হয়েছে বলে জানা গেছে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এবারের শীত মৌসুমে গরম পানি, গরম দুধ, তেল, চা অর্থাৎ গরম তরলে পুড়ে হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা ৫৫ শতাংশের মতো। এই ৫৫ শতাংশের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা ৯০ শতাংশ। আর বড়রা আসছেন ফ্লেম বার্নে অর্থাৎ আগুন পোহানো, আগুন ধরে যাওয়ার মতো অগ্নিকাণ্ডে। এ সংখ্যা ৩৩ থেকে ৩৫ শতাংশ রোগী। আর বৈদ্যুতিক এবং অন্যান্য কারণে আসছে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫০০ শয্যা পূর্ণ। 

কেবল সাধারণ শয্যাই নয়, ইনস্টিটিউটের ২০টি আইসিইউ এবং ৭০টি এইচডিইউ বেডের একটিও ফাঁকা নেই। এ সংকট উত্তরণ এবং বার্ন ইনস্টিটিউটে চাপ কমাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আগুনে পোড়া রোগীদের জন্য ১৪টি আইসিইউ শয্যা বরাদ্দ করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন শয্যাগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। 

এদিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, বছরে আনুমানিক পাঁচ লাখ লোক আগুনে পুড়ে যায়। প্রতিবছরই এই সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শীত এলে এর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। গত এক বছরে শুধু বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮৩ হাজার ২৪৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৫ হাজার এবং নারী ৩৮ হাজার ২৪৫ জন। জানুয়ারিতে পাঁচ হাজার ৯৪৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ হাজার ৯৪১ জন, মার্চে ছয় হাজার ৫০ জন, এপ্রিলে চার হাজার ৪৭০ জন, মে চার হাজার ৮৭৭ জন, জুনে পাঁচ হাজার ৪৮০, জুলাই পাঁচ হাজার ৬৪, আগস্টে পাঁচ হাজার ৯৩৮, সেপ্টেম্বরে পাঁচ হাজার ৭৮৩, অক্টোবরে ধছয় হাজার ৬৯৯, নভেম্বরে ছয় হাজার ৩৬৪, ডিসেম্বরে ছয় হাজার ৯৮ জন। মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছয় হাজার ৪২৮ জন। তার মধ্যে পুরুষ তিন হাজার ৭৩৭ এবং নারী দুই হাজার ৬৯১ জন। তাদের মধ্যে ৪৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ ছিল শীত মৌসুমে। আর এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৯৮৪ জনের।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, শীত ও বসন্ত দুই সময়ে পোড়া রোগীর সংখ্যা বাড়ে। পোড়া রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রান্তিকে নিয়ে যাওয়া দরকার। অগ্নিদগ্ধদের ভুল চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়। দগ্ধ রোগীকে ঘরের কাছে সঠিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হলে দগ্ধদের মৃত্যু ও আহতদের শারীরিক ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। দেশে ৫০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, প্রায় ১৫ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। 

এখানে যদি বার্ন রোগী ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদান সম্ভব হয় তাহলে ক্ষতি কমে আসবে। তিনি বলেন, বার্ন রোগীর ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে আমরা ২০১২-১৪ সালে একটি কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেই কর্মকৌশলকে এগিয়ে নিলে দগ্ধদের ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। 

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. এস এম আইয়ুব হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, শীত মৌসুমে আমাদের ৫০০ বেডের হাসপাতালটিতে রোগীতে পূর্ণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৪টি আইসিইউ বেড প্রস্তুত করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পোড়া রোগী দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে আসে। শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে নারীরা বেশি দগ্ধ হয়। আর বাচ্চাদের গরম পানিতে গোসল করাতে গিয়ে বেশি দগ্ধ হয়। প্রতিদিন মাত্র ১০ থেকে ১২ জন রোগী ভর্তির সুযোগ রয়েছে। 

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন আমার সংবাদকে বলেন, শীত মৌসুমে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি দগ্ধ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু গরম পানিতে দগ্ধ হয়। এ পর্যন্ত আমার জানা মতে, সারা দেশে আগুন পোহাতে গিয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। শিশুদের পোড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, শীতে বাচ্চাদের গোসল করাতে মায়েরা গরম পানি ব্যবহার করেন। এই গরম পানি পাতিলে করে চুলা থেকে ওয়াশরুমে নেয়ার পথে অনেক সময় পা ফসকে পড়ে যায়। আবার ওয়াশ রুমে নেয়ার পরও বাচ্চারা হাত দিয়ে ধরতে যায়, এতে বাচ্চাদের দগ্ধ হওয়ার হার বেশি। সামান্য সচেতনতাই পারে এসব দুর্ঘটনা এড়াতে। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, গরম পানি চুলা থেকে বালতিতে বহন করলে দুর্ঘটনার হার কমে আসবে।